ফিরে পাওয়া জীবনে: নতুন এডভেঞ্চারের খোঁজে | বাবলু সাহা | পর্ব ৪
তারপর ওনারা দুজন মূলত ফিক্কল আসার আগেই মাঝপথে নেমে গেলেন। এর কিছুক্ষণ বাদেই আমাদের গন্তব্যস্থল চলে এলো। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে নেমে দেখি স্থানীয় বহু মানুষ বা যাত্রী দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন ইলাম শহর বাজারে যাওয়ার জন্য। সেইমুহূর্তে কোনও শেয়ারের গাড়ি নেই। অগত্যা আমরাও অপেক্ষা করতে লাগলাম, গাড়ি কখন আসে। ততক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের নানান খোশগল্প চলছে সময় কাটানোর জন্য। রাস্তার ধারের একটি বড় সাইনবোর্ডে নেপালি ভাষায় লেখা বিজ্ঞাপণ দেখিয়ে পিটার হঠাৎ বলে উঠলো, "বাবলুদা, বোর্ডের পুরো লেখাটি পড়ে বলতো কী লেখা আছে?" আমিও গড়গড় করে বলে দেওয়ার পর ও বুঝতে পারলো যে, নেপালী ভাষাটা মোটামুটি আমার রপ্ত। খুশীই হলো বলা যায়। এরকমভাবে আরও বেশকিছুটা সময় অতিবাহিত করার পর, অবশেষে ইলাম বাজার যাওয়ার গাড়ি এলো, তখন সময় দুপুর।
আসার সাথে সাথেই গাড়ি বোঝাই যাত্রী নিয়ে টাটা সুমো চলতে শুরু করল। এখানে একটি কথা বলে রাখি যে, সিকিম বা দার্জিলিং শহরে শেয়ার গাড়িতে যাত্রী বসার যে কঠোর নিয়ম আছে, এখানে সে বালাই নেই, ফলে গাড়ির ভিতরে একপ্রকার গাদাগাদি করেই বসতে হলো। দুরত্ব অনেকটাই; মূল শহর ছেড়ে যত সময় যেতে লাগলো, রাস্তার আশেপাশের দৃশ্যপট ততই বদলে যেতে লাগলো। সুন্দর প্রকৃতি, কোথাও বা ছোট্ট গ্রাম, সাঁকো পেরিয়ে গাড়ি ছুটতে লাগলো। আমাদের রাস্তার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে মাঈ খোলা নদী। বেশ কয়েকঘণ্টা পার করে, সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে গাড়ি ইলামবাজারে গন্তব্য শেষ করলো।
পিটার আমাকে নির্দেশ করে ওকে অনুসরণ করতে বলে, খানিকটা এগোনোর পরেই ব্যস্ত বাজারের পাশে, ইলাম সদর হাসপাতালের ঠিক উল্টোদিকের একটি দুতলা কাঠের হোটেলে প্রবেশ করলো। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই পিটার চলে গেল হোটেল মালিকের সাথে কথা বলতে, এখানে আমরা এক রাত কাটিয়ে পরেরদিন খুব ভোরবেলায় বেরিয়ে যাবো আমাদের পথ চলা শুরু করতে। তাকিয়ে দেখলাম, বেশ ছিমছাম ছোট সাজানো পরিষ্কার হোটেল, ঢোকার মুখেই সংলগ্ন দোকান, সেখানের শোকেসে রেড বুল হেল্থ ড্রিংক, বিয়ারের ক্যান সাজানো এবং টুকিটাকি কিছু প্যাকেটজাত খাবার নুডল চাউ ইত্যাদি।
এরপর আমরা দুজন স্যাক নিয়ে উঠে গেলাম দু তলার একটি ডবল বেডরুমের কাঠের ঘরে। সেখানে পিঠের বোঝা হালকা করে নিচে নেমে এসে হোটেলের ডাইনিং রুমের টেবিলে বসে দু প্লেট পর্ক মোমোর অর্ডার করলাম। সাথে পাহাড়ের প্রিয় দু বোতল হিট বিয়ার।
একটু পরেই টেবিলে চলে এলো গরম গরম মোমো। পুরো খাবার শেষ করে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম ইলাম বাজারের এস বি আই এটিএম কাউন্টারে, বাকী আরও কিছু টাকা তুলে রাখবো বলে। ও বাবা! এখানেও আবার সেই ধাক্কা, তবে এবার অন্যরূপে। কাউন্টারের কাচের দরজা ঠেলে ঢুকে এটিএম মেশিনে কার্ড ঢুকিয়ে প্রথমে ৫০০টাকা তুলে দেখি, ৫০০টাকার সাথে সাথেই আমার ব্যাংক একাউন্ট থেকে per transaction বাবদ ১০০টাকা কেটে নিয়েছে, অর্থাৎ নামেই ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট কার্ড! কী আর করা, সেসময় আমার ব্যাঙ্ক একাউন্টে টাকাও খুব বেশি ছিলনা, যা ছিল তাই নিয়েই বেরিয়ে এলাম। ঘড়িতে তখন প্রায় ৭, ৩০মিঃ সময়, পুণরায় হোটেলে ফিরে এসে টেবিলে বসতেই সামনের চওড়া টি ভি স্ক্রীনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি কাছাকাছি কোথাও তখনকার জনপ্রিয় নেপালী ব্যান্ড ' কুটুম্ব ' র লাইভ প্রোগ্রাম হচ্ছে, TUBORG বিয়ার কোম্পানির স্পন্সরশিপে।
চিরকাল বিভিন্ন ভাষার ব্যান্ড গানের একজন অন্ধ ভক্ত এবং শ্রোতা।
হোটেল মালিক পেমুকে জিজ্ঞেস করতেই ও বললো, হোটেল থেকে কিছুটা দূরেই বড় রাস্তার পাশের একটি বড় মাঠে এই অনুষ্ঠান হচ্ছে।
শুনেই তো আমি দৌড় লাগালাম, গিয়ে দেখি বড় স্টেজে ব্যান্ডের অনুষ্ঠান চলছে। ব্যান্ডের সদস্যরা সবাইই তরুণ বা যুবক, এবং দর্শক শ্রোতাদের ভিড় মাঠ ছাপিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এসেছে। বলা বাহুল্য যে, শ্রোতাদের মধ্যে প্রায় অধিকাংশই তরুণ বা যুবকের দল। সেই ভিড়ে মিশে গিয়ে আমিও বহুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে (এবং ওদের তালের সাথে কোমর দুলিয়ে), ওদের গান বাজনা শুনে হোটেলে ফিরলাম। ততক্ষণে খাবার সময় হয়ে গেছে, হোটেল মালিক এবং তার সহযোগী ও পিটার আমার অপেক্ষাতেই বসে ছিল। আমি যেতেই টেবিলে প্লেট সাজিয়ে রাতের খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আমি জানতামনা যে, পিটার রাতের ডিনার কী অর্ডার করেছে। আহা! যখন খাবার পরিবেশন করলো, তখন দেখলাম গরম সরু চালের ভাত আর পাহাড়ী বকরীর সুস্বাদু মাংস। খাবারে কোনও রকম কার্পণ্য নেই, পেট ভরে খেয়ে উঠে সবাই মিলে একসাথে আড্ডার মেজাজে খোশগল্প করে আমাদের উপরের ঘরে চললাম বিছানায় গা এলিয়ে রাতের নিদ্রা দিতে। পরেরদিন খুব ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম, মনের ভিতরে প্রবল চাপা উত্তেজনা কারণ, আজ আর কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হতে চলেছে আমার মনে দেখা সেই স্বপ্নের ট্রেক।
Comments
Post a Comment