তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

আড্ডা নিয়ে যত কথা | শুভময় সরকার | পর্ব ১ | ফিচার ১

একত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং নিশিরাতের আড্ডা-যাপন : সে এক মাঝরাতের কাহিনি। পরদিন পঞ্চমীর ভোর। একত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ছুটে চলেছে আন্তঃরাজ্য বাস। পরদিন ভোরে আমার বাস ঢুকে পড়বে প্রিয় শহরে। শহরের মূল রাস্তার পাশেই আমাদের সেই ফ্ল্যাটবাড়ি। হস্টেল থেকে ছেলের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রাতজাগা চোখে দাঁড়িয়ে থাকবে মা, আমি নিশ্চিত। শিলিগুড়ি সেন্ট্রাল বাস টার্মিনাস থেকে রওয়ানা দিয়ে কোচবিহার পৌঁছতে রাত নটা, সাড়ে নটা। মাঝে ফালাকাটা বাসস্ট্যান্ডে মিনিট পনেরো কুড়ির টি-ব্রেক। আজও সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলছে। তবে আজকের মতো নয় সে'সব দিন, এতো আলোর ঝলকানি ছিল না, ছিলনা চারপাশের এই বহুজাতিক বৈভবও। তখনও বিশ্বায়নের এই হাটখোলা পরিবেশ আসেনি। তখনো জাতীয় সড়কের দু'পাশে জোনাকিদের নিশিযাপন দেখা যেত। ফালাকাটা বাসস্ট্যান্ডের পাশেই এস এস বি ক্যাম্পের আশেপাশেও বিস্তর জোনাকি। কোচবিহার থেকে বাস ছাড়া মানে বাস এবার রাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে ঢুকে পড়ার মূল যাত্রা পথে। ঘুম ঘুম চোখ, রাতের বাস, ভেতরে অন্ধকার চালকের সুবিধার্থে। দু'পাশের সবকিছু দুরন্ত গতিতে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে আমাদের আন্তঃরাজ্য রকেট সার্ভিস। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহনের সেইসব পোড়া লাল আর ধূসর রঙের রাতের রকেট বাসগুলো এখন নস্টালজিয়া। 

বেশ রাতে হাইওয়ে ধাবাতে রাতের খাওয়া সেরে ঝিমুনির সময়। কোন গ্রাম, কোন শহর, কোন জনপদ বা বন্দর (উত্তরবঙ্গ এবং অসমের কিছু কিছু অঞ্চলে হাট-বাজার-লোকালয়কে বন্দর বলা হয়, এ বন্দর নদীবন্দর নয়) পেরিয়ে যাচ্ছি ঘুম চোখে আর নজরে আসে না। বিলাসী আসনের পুশব্যাক সিস্টেমে হেলান দিয়ে সে এক স্বপ্নরাজ্যের বাসিন্দা আমি। আধোঘুমে একে একে নেমে আসছে মিঠুন, শ্রীদেবীরা। ডান্সিং ফ্লোরে তখন জিমি জিমি আ যা আ যা…! পরদিন পঞ্চমী। অপেক্ষায় বাড়ি, অপেক্ষায় বন্ধুরা। হঠাৎই সামান্য কথাবার্তা, তারপর কিছু যান্ত্রিক শব্দ। আমাদের সেই রকেট বাস দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার পাশে। ঘুমচোখে একে একে যাত্রীদের নেমে আসা। আমিও আড়মোড়া ভেঙে অবশেষে। নেমে জানা গেল যান্ত্রিক সমস্যা। কিছুটা সময় লাগবে। সরকারী বাসের ড্রাইভার-খালাসি-কন্ডাকটাররা নিজেরাই কাজে পারদর্শী। এক্ষেত্রেও অন্যথা হলো না। তারা নেমে পড়লেন কাজে। প্লাস্টিক পেতে একজন চলে গেলেন বাসের তলায়, বাকিরা সাহায্যে। বাসযাত্রীরাও প্রকৃতির ডাকে সাড়া সম্পন্ন করে যে যারা সিটে। আমার মতো এক-দু'জন এদিক-ওদিক ইতস্তত। পুজোর আগে শরতের আবহাওয়া। মাঝরাত পেরিয়েছে, হাল্কা হিম হিম আসন্ন হেমন্তের জানান দিচ্ছে। আশেপাশের কোনো মফস্বলী পুজোপ্যান্ডেল থেকে মৃদু স্বরে হিন্দিগান ভেসে আসছে। একটু দূরে চায়ের দোকান, মাঝরাতেও খোলা। বাসকর্মীরা জানালেন কাজ হয়ে গেলে ছাড়ার আগে হর্ন বাজাবেন। আমার সঙ্গে জলপাইগুড়ি গভর্মেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্র, ফালাকাটায় চা খেতে গিয়েই আলাপ এবং যথারীতি বেশ ঘনিষ্ঠতা কারণ দুজনেই হস্টেলবাসী, আমি এসি কলেজ, ও একই শহরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। হাল্কা হাওয়ায় আমার সিগারেটের ধোঁয়ার রিংগুলো ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে বৃত্ত থেকে বৃত্তান্তরে। মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়া এই অদ্ভুত রহস্যময় সময়ে চায়ের সেই দোকানে আরও এক রহস্যময় আড্ডায় ঢুকে পড়ি আমরা। চায়ের দোকান বটে তবে আমাদের অনুমানকে সত্যি প্রমাণ করে চায়ের আড়ালে 'টা' -ও বিক্রি হয় বুঝলাম। অদূরে সেই ভেসে আসা গানের উৎস, অর্থাৎ সেই মফস্বলি পুজো প্যান্ডেলের রাতজাগা কতিপয় যুবক সেই দোকানে বসে আছে, সামনে রঙিন তরল। সেই রাত আমরাও আর চা খেয়ে একযাত্রায় পৃথক ফলের দোষে অভিযুক্ত হই কেন! সুতরাং সামান্য দু'পাত্তর গলায় ঢেলেই সেই রাতজাগা যুবকদের সঙ্গে জমে উঠল আড্ডা। বাস ছাড়ল যখন, রাত তখন বার্ধক্যের দিকে। আমরাও টালমাটাল পায়ে উঠে বসলাম বাসে। কয়েকঘন্টা আগেও যাদের সঙ্গে পরিচয় ছিল না, তারা যেন কতকালের প্রিয়জন সেই রাতে, নবমীনিশির পেরিয়ে যাওয়ার সেই আকুতি চতুর্থীর রাতেই যেন আমাদের বুকে সুর তুলছে― পোহায়োনা চতুর্থীনিশি। মধ্যরাতের সেই ক্ষণস্থায়ী আড্ডার প্রসঙ্গ ধরেই না হয় শুরু হোক আমার আড্ডা জীবনের কিছু টুকরো ছবি। মনে পড়ে বেশ রাতে, এক গরমকালে কলেজ হস্টেলের পেছন দিয়ে বয়ে চলা করলা নদীর পাড়ে বসে চারমিনারের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে নেশাতুর কন্ঠে বলেছিলাম- আড্ডা দিয়েই একটা গোটা জীবন ফুঁকে দিলাম রে ভাই! পাশে বসা বন্ধু হেসে বলেছিল― গোটা জীবন! আমার সেদিনের সে'কথায় হয়তো মেলোড্রামা ছিল তবে এই মাঝবয়েসের কথকতায় বলাই যায়, সত্যি সত্যি আড্ডা দিয়েই ফুঁকে দিলাম অর্ধেক জীবন তো বটেই!

যেহেতু এই টুকরো লেখাগুলো আড্ডার ধারাবাহিক এবং ক্রমানুসারী বর্ণনা নয়, সে'হেতু জীবনের নানা সময়ের আড্ডার টুকরো ছবি আবছা আলোর ভেতর থেকে যেভাবে আসে, সেভাবেই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রিজমের মধ্যে দিয়ে আলো যেভাবে নানা রঙে বিচ্ছুরিত হয়, আমার এই টুকরো লেখাগুলো হয়তো পাঠকের মনে ভিন্ন কোনো রূপে বিচ্ছুরিত হয়ে অন্যরকম এক অভিঘাত সৃষ্টি করবে। কেবল পাঠকের মনেই বা বলি কেন,জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে ফেলে আসা কিছু কিছু আড্ডা হয়তো-বা আমার মনেও আজ সেই প্রিজমের আলোর মতো ভিন্ন এক সুরে গাইবে। জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বয়েসের সঙ্গে স্বভাবিক নিয়মেই পাল্টেছে। এই যে পাল্টে যাওয়া, নিজের এই যে বদলে যাওয়া তাতে অনিবার্যভাবে সময়ের যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনই রয়েছে আড্ডার প্রভাবও। আমার ছাত্রজীবনের একটা বিরাট অংশই জুড়েই হস্টেল। স্কুলবেলার দিনগুলোর পর থেকে একদম ইউনিভার্সিটি অবধি আমার জীবন হস্টেলময়। তো সেই হস্টেলময়তার হ্যাংওভারে আজও আমি জারিত। আমার স্কুলজীবন ছিল ভীষণভাবেই বাড়িকেন্দ্রিক কিন্তু তার মাঝেই আড্ডার রস এবং রসদ আমি খুঁজে পেয়েছিলাম, বলা ভালো খুঁজে নিয়েছিলাম আর এই আড্ডার জন্য সন্ধান করতে হয়নি খুব বেশি কারণ আমাদের বাড়িটাই ছিল আড্ডাময়। বাবা-মা দু'জনেই ছিলেন চূড়ান্ত আড্ডাবাজিতে বিশ্বাসী আর তাদের একমাত্র সন্তান হবার সুবাদে বাড়ির সেই আড্ডায়, বিশেষত রোববারের মজলিশি সকালগুলো আমার আড্ডা জগতে প্রবেশের প্রথম সোপান। বাড়ির সে'সব আড্ডাগুলো থেকে শিখেছিও বিস্তর। বইপড়ার প্রাথমিক নেশাটাই গড়ে উঠেছিল বাড়ির সেইসব মূল্যবান আড্ডাগুলো থেকে। জীবনের এতোটা সময় পেরিয়ে এসে আজ অনুভব করি, কতটা মূল্যবান ছিল বাড়ির সে'সব আড্ডা। বাড়ির সে'সব আড্ডার দু'এক টুকরোও হবে নাহয় যথাসময়। আপাতত বরং অন্যরকম এক আড্ডার কথা বলি…

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.