পাঠশালা থেকে পাঁঠাশালা : বেত থেকে বেতাল পর্যন্ত এক রম্যপতনগাথা | মোফাজ্জল মণ্ডল | রম্যরচনা ২
একটা সময় ছিল, যেটাকে আমরা এখন আদর করে বলি ‘নব্বইয়ের দশক’। তখন বিদ্যালয় মানে ছিল যেন একখানা আদরের বিদ্যা দান কেন্দ্র, আর শিক্ষক ছিলেন সেই কেন্দ্রের সম্মানিত হোতা। স্কুলে ঢোকার আগে আমরা জুতো খুলে ঢুকতাম না ঠিকই, তবে স্যারের চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমাদের ছিল না। শিক্ষকদের সবাই সম্মান করত। একবার যদি হেডস্যারের চক্ষু রাঙানিটা পড়ে, তাহলে গোটা শরীরে এমন একটা গাম্ভীর্য এসে যেত, যেন গরুর গায়ে হলুদের মত বিদ্যাবুদ্ধি ঢুকে গেছে। এখন স্কুলের চিত্রটা পুরোই উলটো। সরকার ভোট ব্যাংকের উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের মিড ডে মিল, জুতো ও জামা, ব্যাগ বিলি, বই খাতা বিতরণ ও অনলাইন সহ নানা কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। স্কুলগুলিকে যেন রেশন দোকানে পরিণত হয়েছে। গুচ্ছের কাজ আর সেই কাজ করার জন্য কোনো স্টাফ নেই, শিক্ষকদেরই করতে হয়। আর পড়ুয়াদের পড়তে বললেই শুনতে হয় “স্যার, গুগল বলে তো পাস ফেলের কিছু নেই!” তাই কী হবে এত পড়ালেখা করে? এখন যেন ছাত্রদেরকেই সম্মান করতে হয় শিক্ষকদের। নব্বইয়ের দশকে শিক্ষক মানেই ছিল এক অদৃশ্য দেবতা, যার কণ্ঠে রোদ্র, চোখে বজ্র, আর হাতে এক সর্বশক্তিমান বেত। ‘ক্লাসে পড়া পারো না? হাতে বেত্রাঘাত বা দাঁড়াও বেঞ্চের ওপর!’, ‘খাতা ভুলে গেলে কান ধরে দাঁড়াও!’ – এসব ছিল যেমন প্রথা, তেমনি শিক্ষার সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য অনুভব। কিন্তু এখন? এখন শিক্ষক বলতেই বোঝায় একজন আধা-সাংবাদিক, গ্রুপ ডি, আধা-ক্লার্ক, আধা-সার্ভেয়ার, পুরো সময়ের অনলাইন ওয়েব পোর্টাল যোদ্ধা। হাতের বেত এখন আর হাতে নেই– তাকে ধরে রেখেছে ইতিহাস। বেতের ব্যবহার করলেই একদিকে শিক্ষাদপ্তরের শো-কজ বা চাকরি যাবার ভয় অন্যদিকে ছাত্রের অভিভাবকদের শাসানি- "মাস্টার আমার ছেলেকে মারবে কেন? ছোটো থেকে বড়ো হলো আমিই এখনো গায়ে হাত তুলিনি আর মাস্টার মারবে? এত্ত বড়ো সাহস?" এরপরই স্কুলে ঢুকে মাস্টারকে শাসানি অথবা মারধর চলে। আগে বেতের ভয় বা মারের ভয়ে পড়াশোনা করতো আর এখন পড়াশোনা বাদে সবকিছুই করে। পড়ুয়ারাও জানে, শিক্ষকরা মারধর করতে পারবেন না। এ প্রজন্মের শিক্ষকরা বড্ড নিরুপায়।
একদিকে দিল্লির আপ সরকার ‘হ্যাভাভ’ করে স্কুলে পাঠাচ্ছে ফিনল্যান্ডের শিক্ষকদলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অত্যাআধুনিক করেছে আর বাংলায় শিক্ষককে পাঠানো হচ্ছে ‘ডেঙ্গু সচেতনতায় প্যারেড করতে’, ব্যাংকের বই, ‘আধার কার্ড আপডেট করতে’, বা ‘বুথে বসে ভোটার লিস্ট ঠিক করতে’। সবচেয়ে করুণ অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির। ভেংগে পড়া পরিকাঠামো, শিক্ষক নেই। স্কুলে ফান্ড বরাদ্দ নেই। বেসরকারি স্কুলের রমরমায় যা বড্ড বেমানান। বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যেই সরকার যেন ইচ্ছে করেই ফান্ড বরাদ্দ করছে বা স্কুলগুলিতে নজর দিচ্ছে না। প্রশাসনের নাম শুনলেই শিক্ষকগণের বুক ধড়ফড় করে ওঠে– কারণ হয় নতুন অনলাইন এন্ট্রি, নয় তো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচশো রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ। কেউ কেউ বলেন, এই যে "এক শিক্ষকের বিদ্যালয়", এটা আসলে সরকারের “One Teacher Policy”– যেখানে এক শিক্ষক পড়ান, লিখেন, রান্না করেন, মধ্যাহ্নভোজ পরিবেশন করেন, তারপর নিজের মোবাইলে ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে প্রমাণ দেন। আর সেই প্রমাণ? হেডস্যার বলেন, “Photo কমে গেছে কেন?”
স্যার মৃদু হেসে বলেন, “স্যার, ক্লাস নেওয়ার সময় তো আর সেলফি তোলা যায় না।” হেডস্যার বলেন, “না না, প্রমাণ ছাড়া ক্লাস হয় নাকি!” এক সময় ছিল, শিক্ষক পড়াতেন পাঠ্যবইয়ের বাইরে জীবন শেখাতেন। আর এখন শিক্ষক শুধু ক্লাসে যান "লগইন করতে", রুটিন ফলো করতে, আর ফাইল গুছিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পোস্ট করতে। শিক্ষকরাই বা কী করবেন অনলাইন না করলে যে গালিগালাজ বা শো-কজ। এ যেন শিক্ষকের বদলে ডিজিটাল অপারেটর!
সিলেবাস? আহা, বস্তা পচা সিলেবাস! নব্বইয়ের দশকে অন্তত ছাত্র জানতো – ইতিহাস মানে পলাশীর যুদ্ধ, ভূগোল, এখন তো পাতে দেওয়ার মত নেই। এখন ছাত্র জানে – “এত কী দরকার? পাস তো হবই!” পাস-ফেল তুলে দেওয়া মানে, শিক্ষা নয়, পাশ করার সার্টিফিকেটের গণতান্ত্রিক অধিকার। সরকার বাহাদুরের মোবাইল ট্যাব স্কিম চালুর পরে প্রায় বাড়িতেই মোবাইল আসক্তি। লেখাপড়া চলুক বা না চলুক ইনস্টাগ্রাম, রিলস, ফেসবুক ঠিকই চলছে। বাড়িতে খাবার থাক না থাক মোবাইলের ইন্টারনেট খাবার ঠিকই চালু আছে। তাই মোবাইল থেকে বইয়ের দিকে মুখ করাবে কে? কিন্তু এর মাঝে এক কৌতুক আছে—শিক্ষক যখন বলেন “শুনছো?”, লেখো গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর ছাত্র বলে “স্যার, আজ মন নেই, পাবজি খেলব তারপর ওয়েব সিরিজ দেখব, আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই !” যখন বলেন “লেখো!”, ছাত্র বলে “স্যার, লিখতে ইচ্ছে করছে না গুগলে দেখে নেব।” এই যে অনলাইন শিক্ষার মহারথ, সেখানে শিক্ষক শুধু ভিডিও পাঠান আর ছাত্ররা বলে, “সেন্ড ইন গুগল ফর্ম!” আর নিয়োগ? সে তো আজকাল ভগবানের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল, ৫-১০ বছর পরপর। প্যানেল বানাতে বছর যায়, মামলা করতে যুগ যায়, আর পোস্টে নিয়োগ হয় যখন সরকারকে ‘পাবলিক ইমেজ’ চাই। তার উপর অনিয়ম-দুর্নীতিতে ভরপুর প্যানেল, টাকা দিলেই যেন চাকরি। আবার আদালতের রায়ে চাকরি চলেও যাচ্ছে।
এদিকে বেসরকারি স্কুলগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পড়ানো হচ্ছে আইসিডি কোড আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আর সরকার স্কুলে টিচার নেই – আছে “ম্যানেজমেন্ট কমিটি” আর হোয়াটসঅ্যাপের খাতা আর অভিভাবকদের টাকা। তাই বলে সব ম্লান? না না! এখনো কিছু শিক্ষক আছেন যাঁরা বুকের রক্ত দিয়ে ক্লাসে জীবন ঢালেন। যাঁরা ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে চান। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, তাঁরা আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। একজন অভিভাবক বলেন, “স্যার, আমার ছেলের কিছু হবে না?” স্যার বলেন, “আপনি যদি তাকে মোবাইল থেকে আলাদা করেন, তবেই হবে।” অভিভাবক বলেন, “ওটা তো ওর চোখের আলো স্যার!” নব্বইয়ের দশকে শিক্ষার আলোয় সমাজ জ্বলজ্বল করত। আর এখন? LED আলোয় ক্লাসরুম ঝলমল করলেও পড়াশোনা নেই, কারণ "Learning Outcome" এখন "Uploading Outcome"-এ বদলে গেছে। তবুও আশা বেঁচে আছে! কোথাও না কোথাও একজন ‘পুরোনো দিনের শিক্ষক’ এখনও স্কুলে দাঁড়িয়ে আছেন, ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে, ছাত্রদের হৃদয়ে সত্যিকারের শিক্ষার বীজ বপন করতে।
নব্বইয়ের দশকে শিক্ষকের হাতে ছিল বেত, মুখে ছিল বিদ্যা। আজকের দিনে শিক্ষকরা আধুনিক, হাতের বেত কেড়ে নেওয়া হয়েছে, বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে অনলাইনের বিভিন্ন পোর্টালের পাসওয়ার্ড। তফাৎটা বুঝে নিতে সময় লাগে না, যদি আপনি শিক্ষক হন। আগে শিক্ষকদের পড়াশোনা এবং পরীক্ষাতে সরকার হস্তক্ষেপ করতো না কিন্তু এখন হস্তক্ষেপ করে। আগে থেকেই শিক্ষকদের কড়া নির্দেশ থাকে, সব পড়ুয়াদের পাস করাতে হবে এবং ভালো নম্বর দিতে হবে। সরকার এবং শিক্ষাদপ্তর ইচ্ছে করেই শিক্ষকদের সমাজের শ্রেণি শত্রুতে পরিণত করছে। পরিশেষে বলা যায়, “আজকের শিক্ষক, কালকের ক্লার্ক, পরশুর সমাজসেবী – কিন্তু শিক্ষাদান? সরকার বাহাদুরের অজানা বক্তব্য, ওটা এখন ‘কাজের ফাঁকে করো’।”
Comments
Post a Comment