তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

ইছামতীর তীরে | তনুশ্রী পাল | ভ্রমণ ৩


ফেব্রুয়ারির এক সকালে রওনা হলাম ইছামতী তীরের প্রাচীন শহর টাকির উদ্দেশ্যে। ছোট-বড় গঞ্জ, মাছের ভেরি, মাঠ, লোকালয় পেরিয়ে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে চলা। কোলকাতা থেকে সড়ক পথের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিমি, ছোট গাড়িতে সময় লাগল পৌনে দু'ঘন্টার মতো। রেলপথেও চমৎকার যোগাযোগ  ব্যবস্থা আছে। শিয়ালদহ উত্তর থেকে যেকোনো হাসনাবাদগামী ট্রেন ধরে টাকি রোড রেলওয়ে স্টেশনে নেমে টোটো ধরে টাকি শহরে সহজে পৌঁছানো যাবে। যাইহোক আমরা পথের ধারে চায়ের দোকানে খানিক বিরতি নিয়েছিলাম। দিনটি রোদ ঝলমলে। মন ফুরফুরে, বহুদিনের সুপ্ত ইচ্ছেটি পূর্ণ হতে চলেছে। আহা! ইছামতী দর্শন!

ইছামতীর পশ্চিম তীরে বহুপ্রাচীন জনপদ উত্তর ২৪ পরগনা জেলার টাকি শহর, পূর্ব তীরে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা। সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম টাকির ঘোষবাবু পাড়ার প্রতীপ সৈকতের'ইছামতী হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট'-এ। আগে থেকেই বুকিং ছিল দুদিনের। রিসেপশনের বয়স্ক ভদ্রলোক গপ্পে মানুষ, সেখানেই একপ্রস্থ চা-পান সঙ্গে কাগজপত্রের কাজ সারা হল। তিনি  জানান সারা বছরই ট্যুরিস্টদের আসা যাওয়া চলতে থাকে টাকিতে। উইকএন্ডে ভালো ভিড় হয়। তারপর জিজ্ঞেস করেন'কী মাছ খেতে চান বলে দিন, যখন বলবেন লাঞ্চ দিয়ে দেব। লাঞ্চ সেরে একটু রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। চাইলে টোটো ডেকে দেব। নয়তো নিজেরাই নদীর ধারের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন। ভাল লাগবে। বাঁধ ধরে  বাঁ-দিকে এগোলেই টাকি রাজবাড়ী ঘাট পাবেন। ওখান থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরে বেড়ান।'

নদীর একেবারে কোলঘেঁষা রুম। ঘর থেকেই ইছামতীকে দুচোখ ভরে দর্শন করা  যাচ্ছে! কিন্তু ব্যালকনিতে গিয়ে মন ঘুরে গেল, না এই রুম চলবে না। রুম পালটে দিতে বলি।'কেন?' 'ওই যে, দুহাত দূরে বি এস এফের জওয়ানদের চৌকি, সশস্ত্র কয়েকজন রয়েছেন প্রহরায়। বেড়াতে এসে সারাক্ষণ অস্ত্রশস্ত্র দেখতে মন চায়? ব্যালকনিতে নিজের মনে বসে থাকা বা একটু  চা-পান করতেও কী ইচ্ছে করবে? তাঁরা দিনরাত ডিউটি করছেন সেখানে আমাদের অস্বস্তিই হবে।

'ঘর পরিবর্তন হল, এবারে ব্যালকনি ঘেঁষে কচিপাতার বাহার নিয়ে এক তরুণ নিমগাছ, তারপর সিমেন্ট ঢালাই সরু রাস্তা আর তারপরেই ইছামতী, আর নদীর ওপারটাও দেখা যাচ্ছে বেশ! বাংলাদেশের সাতক্ষীরা। ঐতিহ্য মেনে এই নদীতেই বিজয়াদশমীতে ভারত আর বাংলাদেশের বেশ কিছু পূজাকমিটি নৌকায় দুর্গাপ্রতিমাসহ ভ্রমণ সেরে পরে বিসর্জন দেন। পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলির 'বিসর্জন' সিনেমায় সে দৃশ্য চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, সিনেমাটি দেখেছি। ভারতের পতাকা উড়িয়ে জেলে নৌকা, পর্যটকবাহী নৌকা সব চোখের সামনে দিয়েই ভেসে বেড়াচ্ছে! ছোট্ট বারান্দায় বসে নদীর গায়ের গন্ধ পাই, প্রিয় লেখক  বিভূতিভূষণের সেই ইছামতী! আজ সবার আগে নদীবক্ষে ভ্রমণের ইচ্ছে।

ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং হলে। ঝকঝকে কাসার থালা, বাটি, গ্লাসে খাবার সাজিয়ে দিয়েছেন ওঁরা! ঘি, কাঁচালঙ্কা, লেবু, বড়সড় ভাতের থালায় শাকভাজা সহ আরও দুই প্রকার ভাজা, ডাল, সবজি, মাছের ঝোল, চাটনি, মিষ্টি  সব নিয়ে নেমন্তন্ন বাড়ির ভোজ যেন! এতরকম খাবার পেটপুরে খেলে ভ্রমণ স্থগিত রেখে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
খাওয়া সাঙ্গ করে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়া গেল। ডানধারের রাস্তা ধরে এগোই, দু'পাশে স্থানীয় মানুষের ঘরবাড়ি, নদীর কিনারা ঘেঁষা সরু রাস্তা ধরে ঘাটের উদ্দেশে চলতে থাকি। রাস্তাটি ভারি সুন্দর, ডাইনে ছলছল কলকল নদী ইছামতী, আর বাঁহাতে বেশ কিছু গেস্ট হাউস, হোটেল, পার্ক, বাড়িঘর। খানিক এগিয়ে ভগ্নপ্রায় টাকি রাজবাড়ী। আষ্টেপৃষ্ঠে গাছের শিকড় জড়ানো সুদূর   ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে বহুপ্রাচীন ভগ্ন ইটের দেওয়াল! এমন দৃশ্যে মন উদাস হয়! ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই ছোট্ট জনপদটিতে একইসঙ্গে নতুন আর পুরাতনের সহাবস্থান। জমিদারি আমল থেকে রায়চৌধুরী, মুন্সি, ঘোষ, পুবের বাড়ি ইত্যাদি একাধিক জমিদার বাড়ি ও প্রাচীন মন্দিরগুলো বহু পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বেশিরভাগই জরাজীর্ণ, আড়াইশো থেকে তিনশো বছরের পুরনো। ১৮৬৯ সালে টাকির পৌরসভা স্থাপিত হয়েছিল। রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরীর চেষ্টায় টাকিতে আরও অনেক সম্ভ্রান্ত মানুষেরা বসবাস শুরু করেন। ব্রিটিশ আমলে টাকি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। টাকির কাছেই ইছামতী নদীর ধারে বসিরহাটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লবণ ব্যবসার কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। রাজা রামমোহন রায়ের পরামর্শে এবং খ্রিস্টান মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফের পরিচালনায় জমিদার কালীনাথ ১৮৩২ সালে এখানে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর চেষ্টায় ১৮৫১-তে সরকারি স্কুল আর ১৮৬২-তে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।   টাকি সেকালেই শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চায় অনেক এগিয়ে যায়। এখনো শত শত বছরের পুরনো দুর্গাপূজার ঐতিহ্য বেঁচে আছে নতুন প্রজন্মের আন্তরিক চেষ্টায়।

নদীর ধারের পথটি ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম টাকি পৌরসভা অনুমোদিত সুসজ্জিত রাজবাড়ী ঘাটে। পর্যটকের অপেক্ষায় অজস্র অটো দাঁড়িয়ে এধারে। ওধারে ট্যুরিস্টের অপেক্ষায় জলে ভাসছে ছোটবড় অনেক নৌকো। ঘাটে নামার সুন্দর একটি গেট, ওপরে লেখা -'স্যার কালীনাথ মুন্সি ঘাট, টাকি পৌরসভা। ইছামতী নদীতে নৌকা ভ্রমণ, মাছরাঙা দ্বীপ ও গোলপাতা জঙ্গল। যন্ত্রচালিত বোটে নৌকা ভ্রমণ হয়।' ঘাটেই টিকিট কাউন্টার, সেখানে ভাড়া মিটিয়ে 'সন্তু'র যন্ত্রচালিত নৌকায় গিয়ে বসি। ঘাট ছেড়ে ভেসে পড়লাম ইছামতীর বুকে। সন্তু গল্প করে- 'এই ঘাটের নাম টাকি বিসর্জন ঘাট... বিসর্জনের সময়  হাজার হাজার লোক আসে দেখতে। সে জানায় নদীর এধারের চল্লিশ ভাগ আমাদের, ওধারের চল্লিশ ভাগ বাংলাদেশের মাঝের কুড়ি ভাগ হল লাইন অব কন্ট্রোল...নদীতে প্রচুর মাছ আছে, মাছ ধরা তার নেশা, পেশা নয়। একবার চার ঘন্টা খেলিয়ে একটা ১৫কেজির ঘাঘর মাছ সে ধরেছিল। বিক্রি করেনি, ঘাটের সবাই ভাগযোগ করে নিয়েছে। বিসর্জন সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় এখান থেকে প্রচুর নৌকা ভাড়া হয়েছিল। তার নৌকাতেই ক্যামেরা ছিল। ভালো পয়সা দিয়েছিল সিনেমাআলারা।'

বলি,'নৌকাটা নদীর মাঝামাঝি নিয়ে চল। বাংলাদেশের দিকে যতটা যাওয়া যায়। খালি এদিক ঘেঁষে চলছ, ওদিকে চল। ফর্টি পার্সেন্ট আমাদের তো, তাহলে যাচ্ছ না কেন? বাংলাদেশের পতাকা লাগানো নৌকাগুলো তো মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। 'নিয়ম মানতে লাগে ম্যাডাম, নাহলে ঝামেলা আছে অনেক। আর ওই যে মিলিটারির বোট, সারা দিনরাত পেট্রোলিং চলে জানেন। ওদিকে বি এস এফের ক্যাম্প আছে।' নদীর অপর তীরের দিকে চেয়ে কেমন এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ঘাটের দিকে ফিরি। কত কাছের হয়েও অদৃশ্য সীমান্তরেখা টেনে দুটো দেশ নদীর দুই কিনারায়!

ঘাটের বাইরে ট্যুরিস্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি অটোওয়ালাদের। দরদস্তুর করে এক তরুণ অটো চালকের সঙ্গে টাকির অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পট দেখতে বেরোই। প্রথমেই প্রাক্তন সেনাপ্রধান শংকর রায়চৌধুরীর আদি বাড়ি। বড় বড় গাছপালার ছায়ায় তিনতলা জনহীন বাড়িটি দাঁড়িয়ে। ভেতর উঠোনে তাঁদের পারিবারিক দুর্গা দালান; সিঁড়িতে বসে ক'জন স্থানীয় মহিলা গল্পগুজব করছেন। কাছেপিঠে সময়ের ছাপ গায়ে মেখে আরও কিছু প্রাচীন দালান। পরের গন্তব্য ৩০০ বছরের পুরনো জোড়া শিবমন্দির। কিন্তু নতুন রঙ করা হয়েছে দেখলাম, এতে মন্দিরের নিজস্বতা ক্ষুন্ন হয়েছে মনে হল। মন্দিরের সামনে বিশাল এক জলাশয়।
আমাদের পরের গন্তব্য ৪০০বছরের পুরনো কূলেশ্বরী কালীমন্দির। লোকবিশ্বাস মতে এই দেবী খুব জাগ্রত। একসময় এই পুজোয় কামান দাগা হত; পাঁঠা, মোষ বলি হত। কথিত হয় জেলেদের জালে উঠে এসেছিল নকশা করা একটি সুন্দর ঘট আর জমিদার গৃহিণী স্বপ্নে নির্দেশ পান ওই ঘট প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাটির এক মন্দির বানিয়ে দেবীর পুজো করা হল। নদীর  কূলে ঘটটি পাওয়া যায় বলে এই মন্দিরের দেবী কূলেশ্বরী নামে খ্যাত হন।

শেষবেলায় হাজির হলাম টাকি পুবের রাজবাড়ীতে। ১০/টাকায় টিকিট কেটে ঢুকতে হল। অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল ভগ্নপ্রায় প্রাসাদটি। বয়স্ক দুজন মানুষ দেখভালের দায়িত্বে। একজন মহিলার সঙ্গে পরিচয় হল। কথায় কথায় জানলাম বহুকষ্টে তিনি আরও কতিপয় মানুষের সহায়তায় লোভী মানুষের হাত থেকে এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, নইলে কবেই এইসব দালানবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে এখানে তিনতারা, পাঁচতারা হোটেল হয়ে যেত। কতকালের পুরনো খড়্গ, তীর, রাম-দা, বল্লম, কাঠের কারুকাজ করা দু'একটা আলমারি বিষন্নতার ধুলো মেখে রয়ে গেছে। বিশাল দুর্গাদালান! ঘুরে ঘুরে পুজোর দালান দেখি, এখনো বিধি মেনে প্রতিবছর দুর্গাপূজা হয়, খুব ভিড়ও হয়।

সন্ধ্যা গড়াতে আমরা রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছই, তখন প্রার্থনা চলছে। মিশন পরিচালিত হাইস্কুল এবং ছাত্রাবাস রয়েছে এখানে। সারাদিনের ভ্রমণ শেষে হোটেলে ফিরি। রাত গড়ায় আকাশের বুকে সরু একফালি বাঁকা চাঁদ। অন্ধকার আর কুয়াশায় অদৃশ্য ওপারের বাংলাদেশ। সারারাত সীমান্ত প্রহরীর টর্চের আলো ঘোরাঘুরি করে জলে ও ডাঙায়; মাঝেমাঝে ওঁদের হুইসিল শুনি। নতুন জায়গায় ভাল ঘুম হয়না। বারবার উঠে বসি, বাইরে আবছা অন্ধকার আর কুয়াশা।

পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরেই টোটো ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমেই গেলাম টাকি ঘোষবাবু বাড়ির পূজা দালান দেখতে। দশ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হবে। প্রধান ফটকের অভিনব প্রকান্ড কাঠের পাল্লা দুটি এখনও অক্ষত এবং দেখবার মতো! অনেকটা জায়গা নিয়ে বিশাল বিশাল দালানগুলোর বেশিরভাগ  জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে! দেখে কষ্ট হল। দুর্গা দালানটি এখনো চোখ টানবে। জানলাম মহাসমারোহে প্রতিবছর দুর্গাপূজা হয় এখানে। দূর দূর থেকেও বহু মানুষ ঐতিহ্যময় এই পুজো দেখতে আসে।
এরপর রওনা দিই গোলপাতা জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবন দেখবার উদ্দেশ্যে। পথটি সরু আঁকাবাঁকা, নতুন জায়গার ঘ্রাণ নিতে নিতে প্রাণ ভরে ওঠে। টোটো গিয়ে থামে বি এস এফ চেকপোস্টের আগেই  পার্কিং-এ। এখান থেকে বাংলাদেশ আরও কাছে। কড়াকড়ি যথেষ্ট।

চেকপোস্টে পরিচয়পত্র জমা রাখা বাধ্যতামূলক। আইডি জমা রেখে ছোট্ট একটি পাকা সেতু পেরিয়ে যাই, সেখান থেকে গোলপাতা জঙ্গল এক কিলোমিটার। হেঁটেও যাওয়া যায় আবার মোটর চালিত ভ্যানের ব্যবস্থা আছে। আমরা ভ্যানে চেপে  আশেপাশে গ্রামের বাড়িঘর, খেতখামার, গোয়াল, গরু, পুকুর এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গোলপাতা জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবন বনের একেবারে  দোরগোড়ায়। এটি ইছামতীর তীর ঘেঁষে একটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। জোয়ারের সময় জল ঢোকে, ভাটার সময় কর্দমাক্ত ভূমি সুতরাং সেখানে হেঁটে জঙ্গল দর্শন সম্ভব নয়। তাই পর্যটকদের জন্যে কর্তৃপক্ষের এই বিশেষ উপহার, গোলপাতার  জঙ্গলে কংক্রিটের সেতুর ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ।

সুন্দরবনের ভেতর ঘুরে বেড়ানোর স্বাদ পেতে চাইলে এখানে আসতে হবে। পথের ধারেই টিকিট কাউন্টার, মাথাপিছু দশ টাকার টিকিট। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এখানে থাকা যাবে। সামান্য এগিয়েই বনের ভেতর নির্মিত হয়েছে নিরাপদ উচ্চতার দীর্ঘ এক কংক্রিটের সেতু, ক্যানপি ওয়াক। সতর্কবার্তা লেখা রয়েছে'ব্রিজ থেকে নিচে জঙ্গলে নামা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ'সবুজ বনের মধ্য দিয়ে সাদা-নীলের রঙিন দীর্ঘ সেতু। সেতুটির দুই ধারে অজস্র গাছ এবং গাছেদের গায়ে পরিচিতি লেখা ছোট ছোট বোর্ড। দেখতে দেখতে এগিয়ে চলি- গেঁওয়া, ওরচাকা(কুঁদ), কালো বাইন, সাদা বাইন, হেতাল, কেওড়া, বাণ, গোলপাতা। গোলপাতার বিরাট  বিরাট ঝোপ; কোনটার গোড়ায় বড় বড় ফল ঝুলছে, সেগুলো অনেকটা আনারসের মতো দেখতে! এ গাছের পাতা মোটে গোল নয় বরং অনেকটা নারকেল পাতার মতো। টাকির গোলপাতার জঙ্গলে বেড়াত এসে ঐশ্বর্যময় সুন্দরবনকে খানিকটা যেন অনুভব করছিলাম।

সেতুটি এঁকেবেঁকে গিয়ে শেষ হয়েছে একটি তিনতলা উচ্চতার ওয়াচ টাওয়ারে। সিঁড়ি বেয়ে একদম ওপরে উঠে নয়ন সার্থক, চারদিকে সবুজের সমুদ্র যেন! পরস্পর গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অসংখ্য গাছ, ওধারে ইছামতী। খানিকটা সময় সেখানে কাটিয়ে ভারি ভালো লাগল। নীচতলায় একটি চা-কফি আরও নানান সব খাবারের দোকান রয়েছে। এককাপ চা খেয়ে ফেরার পথে, ডান ধারে এই সেতুর আরেকটি শাখা একেবারে ইছামতীর খুব কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে।

ওপারের বাংলাদেশও এখান থেকে সামান্য দূরে। মনে হচ্ছিল নদী পেরিয়ে চলে যাই সাতক্ষীরায়। সবমিলিয়ে ঘন্টা দেড়েক গোলপাতার জঙ্গল ভ্রমণ শেষে বেরিয়ে এলাম। সেই একই পথে ফেরা। পথের ধারে মহিলারা পেয়ারা, কামরাঙা কাসুন্দি মাখা, বোতলে খেজুরগুড় বিক্রি করছেন। আমরা পেয়ারা মাখা খেলাম চমৎকার স্বাদ। পথের ধারে তাঁতে বোনা গামছার পসরা নিয়ে বসে পিতাপুত্র, দুটো ক্রয় করলাম আরও অনেকেই কিনলেন দেখলাম। বেশ বড়সড় গামছাগুলো! আবার সেই ভ্যানে চেপে ফিরে আসা। চেকপোস্ট থেকে আই ডি কার্ড সংগ্রহ করে টোটোয় গিয়ে বসি, সবুজে সবুজ মিনি সুন্দরবনটিকে মনের এলবামে বন্দী করে এবারে শহরের দিকে ফেরা। দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। খিদে পেয়েছে সবারই। আমাদের সারথি’র পছন্দের হোটেলে  টাটকা মাছের ঝোল, ভাতে আহার সেরে হোটেলে ফিরি। আজকের রাতটুকুই বাকি, কাল সকালে ঘরে ফেরার পথ ধরতে হবে। এখন দু-চোখ ভরে শুধু প্রিয় ইছামতী দর্শন।

রাতের খাওয়া সেরে এসে ব্যালকনিতে বসে থাকি, ওপারের বাংলাদেশ অন্ধকারে আবছা দেখায়। চারদিক ক্রমে নিস্তব্ধ হয়ে আসে নদীর মৃদু কন্ঠস্বর ক্রমে স্পষ্ট হয়। হোটেলে অতিথি প্রায় নেই। শনি-রোববারে হুজুগে শহর এসে ভিড় জমাবে এখানে! সদাজাগ্রত সীমানা প্রহরী টর্চের আলো অন্ধকার চিরে ঝলসে ওঠে! ঘুম তেমন আসে না! আবছা একটা চাঁদ সারারাত চেয়ে চেয়ে ইছামতীর রূপ দর্শন করে। ইছামতীতে জোয়ার জাগে। অদ্ভুত কুয়াশামাখা পবিত্র এক ভোর ধীর লয়ে নেমে আসছে সুপ্রাচীন শহরের বুকে! ভোর যেন ধ্যানের সময়। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখি ভাটার টান লেগেছে, ইছামতীর বুকে জেগে আছে দীর্ঘ এক চর! নদীর ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়ায় মনে প্রশান্তি জাগে।

সকালের চা শেষে ব্যাগ গোছানোর পালা। হোটেলের ঠিক করে দেওয়া গাড়ি চলে আসে যথাসময়ে। ব্রেকফাস্ট সাঙ্গ করে সবার কাছে বিদায় নিয়ে রওনা দিই। বিদায়বেলায় মনে হয় যেন কোনও আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলাম। গাড়ি চলতে শুরু করতেই, মনের বাসনাটি ড্রাইভার সাহেবের কাছে ব্যক্ত করি-' আচ্ছা আপনি চন্দ্রকেতু গড় নিয়ে যেতে পারবেন? খনা-মিহিরের ঢিপি। এখান থেকে মাত্রই ৩৪/৩৫ কি.মি.দূরত্ব।'হ্যাঁ, আমি ট্যুরিস্ট নিয়ে যাই তো। আমাকে একটু টাকা বাড়িয়ে দিন নিয়ে যাবো। অসুবিধা নেই।' 'বেশ বেশ চলুন'
গাড়ি ছুটতে শুরু করে সেই প্রাচীন প্রত্নস্থল চন্দ্রকেতুগড়ের উদ্দেশ্যে। যার ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের প্রাক মৌর্য যুগ থেকে শুরু করে শুঙ্গ-কুষাণ, গুপ্ত ও পাল-সেন যুগ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষের বসতি আর বিকাশের ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রাচীন গঙ্গারিডি রাজ্য এরই অংশ বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদেরা। আর এইসঙ্গে অবশ্যই দর্শন করবো পার্শ্ববর্তী খনা মিহিরের ঢিপি। সেদিন বহুকাঙ্ক্ষিত সাধটিও পূর্ণ হয়েছিল। সে বৃত্তান্ত পরে কখনও সময় সুযোগ মতো লিখবো নিশ্চিত।

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.