আতর | সৃজিতা চক্রবর্ত্তী | অণুগল্প ১০
মাঝরাতের আলো আঁধারিতে ভারাক্রান্ত জলীয় বাষ্প আলাপ জমায় ভেসে ওঠা কুয়াশার সাথে। ওদের আলাপের উপজীব্য ‘শীত ও জনজাতি’। তাদের গল্পে কোনো বিতর্ক নেই; আছে শুধু একরাশ দুঃখ প্রকাশ আর কিছু আক্ষেপ।
ভাঙা চাতালের ঘরটার মাথায় লালচে টালির ছাত। তার এক কোণে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। ঝুল পড়া দেওয়াল গুলোয় কালচে ছোপ; জায়গায় জায়গায় রঙের পরত খসে পড়েছে, যেনো বিকট সব মুখের ভঙ্গিমা।
এইসব চায়ের দোকানে কোনো রাজনৈতিক আলোচনা বসে না। কারণ, খরিদ্দারের কেউই শিক্ষিত কিংবা বুদ্ধিজীবী নয়। ওরা হতদরিদ্র ভাতাভোগী শ্রমিক শ্রেণীর নেতা। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে তারা বিক্রেতার প্রসংশা করে।
কারও কারও মনে হয়, শ্রীহীন ঘরটায় একমাত্র লোভনীয় বস্তু বিক্রেতা স্বয়ং। রাত বাড়লে যেনো তার মাধুর্যও বাড়ে— নীলচে কালো শাড়িতে মোহময়ী হয়ে ওঠে শরীরটা। এক দুঃসাহসিক ব্যবসায়ীর মতো তীব্র শীতেও বেতের পাটাতনের উপর বসে সে হুকো টানে। কখনও আবার মহুয়া, কিংবা হারিয়া সাজায় পাত্রে পাত্রে। ক্রেতা আকর্ষণের পদ্ধতি নিয়ে তার কোনো পড়াশোনা নেই ,অভিজ্ঞতা আছে।সে জানে, রাত বাড়লে খরিদ্দারও বাড়বে। ধুলো পড়া কাঁচের বয়ামে তাই সে আফিমের জোগাড় করে প্রতিদিন।
খরিদ্দারের আতিথেয়তায় কোনো খামতি রাখে না মহিলা। মাঝরাতে ক্রেতা আসতেই রংবেরঙের পর্দায় ঢেকে যায় ঘর। রেডিওতে স্টেশন ধরা যায় না। গুঙরে ওঠা একটা বোবা চিৎকারের মতো মাঝে মাঝে খবর পড়ে যন্ত্রটা।
হলদে আলোর ভাস্বর বাতিগুলোকে ঘিরে ধরে কুণ্ডলীকৃত বাষ্প। চোখ বুঁজে ফেলে—ওরা সাক্ষী হতে ভয় পায়। ক্রেতার আপ্যায়নে মত্ত হয়ে মহিলা যখন ছিটকিনি দেয় ঘরে, পাশের কোনো জানালা থেকে একটা ছোট্ট মুখ উঁকি দেয় আগ্রহে—
— “আম্মু কহন আইসবা?”
— “তাড়াতাড়ি আইসবো বাবা। তুমি আটের ঘরের নামতা মুখস্ত করো, আমি আইসা ধরবো।”
যবনিকা পতন। আর দেখতে পায় না শিশু চোখ। একটা মিষ্টি আতরের গন্ধে ঘুম নেমে আসে তার কৌতূহলী চোখে। গন্ধটা ভীষণ চেনা। দৈত্যের স্বপ্ন দেখে ছোট্ট ছেলেটা যখন মাঝ রাতে মায়ের বুকে মুখ গোজে, এই গন্ধটা তখন ওকে আশ্রয় দেয়, আশ্বাস দেয়।
জমাট অন্ধকারে ডুবে থাকা রাস্তাটা কালো নদীর মতো ভাসতে থাকে কুয়াশায়। শৈত্যের তীব্রতা বাড়ে ধীরে ধীরে— ‘আট এক্কে আট। আট দ্বিগুণে ষোলো। তিন আটে চব্বিশ...।’
Comments
Post a Comment