তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

পাহাড় বানানোর কারিগর | রঙ্গন রায় | মুক্তগদ্য ১

শীতের শেষে একটা বৃষ্টি হয়, সেটা গরম পড়ার পূর্বাভাস। তেমনই শরতের শেষেও বৃষ্টি হয়, তার মাধ্যমে আসে শীত। মানে বৃষ্টি দূতের মতো সময়ে সময়ে দুই ঋতুকেই বলে, এবার আপনার পালা, আসুন, আসরে নেমে পড়ুন। মেঘকে দূতের কাজ শুধু কালিদাসের কাব্যে নয়, বরাবরই করে আসতে হয়েছে। 

দুর্গাপূজা আমাদের প্রভূত আনন্দ দিয়ে চলে যায়। তার সাথে সাথেই বিদায় নেয় শরৎ। প্রতিবছরই এই নিয়মের কোনও ব্যত্যয় হয় না। বাতাসে থাকে নরম একটি ছোঁয়া। সকাল বেলা সবুজ ঘাস জমিতে সেজেগুজে পড়ে থাকে শিউলি ফুলের দল। এ এক এমন সময়, যখন ফ্যান না চালালে গরম লাগে, আর ফ্যান চালালে ঠান্ডা। স্বস্তি মেলে না কিছুতেই। 

যখন ছোট ছিলাম, দুর্গাপূজা শেষ হলেই মন খারাপ লাগত। মন খারাপের সঙ্গত কারণ অবিশ্যি অন্য ছিল। প্রতিমা বিসর্জন ও প্যান্ডেল খুলে ফেলার পর নগ্ন জমি বেশি করে মনে করিয়ে দিত, এখনই, হুট করেই এসে পড়বে কালীপূজা, আর সেটা শেষ হলেই করাল দর্শন বার্ষিক পরীক্ষা। তবে দুর্গাপূজা থেকে কালীপূজার এই মাঝখানের পনেরো দিন অন্য একটা কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারতাম। সেই কাজ ঈশ্বর বা ইঞ্জিনিয়ার, কারুর চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। 

আমরা পাহাড় বানাতাম। উত্তর আধুনিকতা এবং করোনা পরবর্তী যুগে যেখানে হারিয়ে যাচ্ছে খেলাধুলোর দিন, যেখানে ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকছে মোবাইলের ভেতর, তাদের কাছে এই পাহাড় বানানোর ব্যাপারটা বিস্ময়করই। 

বাড়ির সামনের ফাঁকা উঠোনে, রাস্তার ধারের খালি জায়গায় শহরের প্রায় সব পাড়ার- সব বাড়ির বাচ্চারাই বালি, মাটি, পাথর, ভাঙা আঁধলা ইঁট, পুরোনো কাপড়, চুন-জল দিয়ে বানাত দুর্দান্ত পাহাড়। 'দুর্দান্ত' বলছি এই কারণে, সে বয়সে নিজেদের সৃষ্টিই যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, এটা ভাবাটাই সাংবিধানিক নিয়ম ছিল।

বালক বয়সে সকালবেলা রোজ বাবার সঙ্গে রাজবাড়ি দীঘিতে সাঁতার কাটতে যেতে হত। আজকের মতো তাতে উন্নয়নের কোনও ছাপ তখন পড়েনি। সবার অবাধ প্রবেশাধিকার। প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে রাজার দীঘি আমাদের পাহাড় বানানোর উপকরণ সাপ্লাই দিত। কী উপকরণ?  না, ভূগোল ক্লাসে পড়া তিন প্রকারের মৃত্তিকার সেই বিখ্যাত 'এঁটেল মাটি'। দীঘির ধার থেকে মাটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে বাড়ি আনা, তারপর সেগুলোকে চমৎকার করে জল দিয়ে ভিজিয়ে তাল বানিয়ে, রোদে শুকিয়ে পাহাড়ের শক্ত রাস্তা বানানো, সে এক অপূর্ব রোমাঞ্চকর ব্যাপার! 

বড় হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতা পড়েছিলাম– "অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।"

আজ মনে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে যদি আমার দেখা হত, তাহলে আমি তো তাঁকে প্রতি বছর বছর নতুন নতুন পাহাড় বিক্রি করতে পারতাম! 

কালীপূজা উপলক্ষ্যে জলপাইগুড়িতে পাহাড় বানানোর যে রেওয়াজ, সেটা অনেকদিনের। কিন্তু এই পাহাড় হঠাৎ কালীপূজাতেই কেন বানানো হত, এর বুৎপত্তি কী, তার ইতিহাস সঠিক ভাবে জানা যায় না। আমরা যেমন বানিয়েছি, আমাদের বাবারাও শুনেছি তেমন বানাতেন। শিলিগুড়িতে ঝুলন যাত্রা'র সময় পাহাড় বানানোর রীতি আছে। যা জলপাইগুড়ি'র কালীপূজার পাহাড় দেখেই বানানো শুরু হয়। সেই পাহাড়ে ছোট্ট দোলনায় রাধা কৃষ্ণের মূর্তি দোল খায়। কিন্তু জলপাইগুড়ি'র পাহাড় একেবারেই আলাদা। একে কেন্দ্র করে দোকান পসরাও বসতো। বাজারে এঁটেল মাটির তাল বিক্রি হত, ঠ্যালাগাড়ি করে গ্রাম থেকে লোকেরা এসে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করত মাটি। বাজার ভরে যেত পাহাড় সাজানোর জন্য নানাবিধ অত্যাবশ্যকীয় খেলনার দোকানে। আমরা বেশিরভাগই নিজেদের সংগ্রহের খেলনা দিয়ে সাজাতাম পাহাড়। তাতে ফোয়ারার ব্যবস্থাও করত কেউ কেউ। আর সেই ফোয়ারায় যদি কেউ পিংপং বল নাচিয়ে দিতে পারত, তবে তো আর কথাই নেই।  

লোকজন ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে যেসব বাড়িতে পাহাড় বানানো হত সেটাও দেখে আসত ভীড় করে। পাহাড় বানানোর আনন্দ ছিল নির্মল। আর সেটা সাজানোর আনন্দ ছিল একজন শিল্পীর। পুরোনো কাপড় এঁটেল মাটি মিশ্রিত জলে চুবিয়ে কয়েকটা বাতা মাটিতে গেঁথে তার উপর দিয়ে দেওয়া হত। নির্মিত হল পাহাড়ের চুড়া। তার মাথাতে চুন দিয়ে দিলেই তুষারশিখর। আর পাথর, ইঁট, মাটি, বালি দিয়ে পাহাড়ের হেয়ার পিন বাঁক রাস্তা, গুহা, নেমে আসা ঝরণা, ব্রিজ, রাস্তায় পাটকাঠির ল্যাম্পপোস্ট – অনেকে আবার টুনিবাল্ব লাগিয়ে 'অরিজিনাল' স্ট্রিটলাইট, মানে বাস্তব সম্মত যত চেষ্টা হয়, তার কিছুই বাকি রাখতাম না। যাদের খেলনা ট্রেন থাকত, তারা গুহা দিয়ে ট্রেন পাস করাতো, নদীতে নৌকা ভাসত, গাছগাছালিতে ভরা উপত্যকা থাকত, তাতে বিভিন্ন খেলনা পশুদের চড়ে বেড়াতে দেখা যেত। কার্গিল যুদ্ধের পর সৈন্য সামন্তের পুতুল এসেছিল বাজারে। তাই দিয়ে সাজানো যুদ্ধক্ষেত্র, নদীর ধারে পাহাড়ের উপর সমতল বানিয়ে হেলিপ্যাড তৈরি –একেবারেই যেন ইদানিং কালের জিটিএ ফাইভ কম্পিউটার গেমের সেই শহরটির মতো। আমাদের নিজেদের কল্পনায় নির্মাণ করা একটুকরো প্রকৃতি। 

সে সময় টাউনে সবচেয়ে বড় পাহাড় বানানো হত যোগমায়া কালীবাড়ির পাশে দাশগুপ্তদের বাড়িতে। সেটা দেখতে ভীষণ ভীড় হত। বলা হয় তারাই প্রথম জলপাইগুড়িতে পাহাড় বানানোর সূত্রপাত ঘটায়। এছাড়া কালীপূজায় বিভিন্ন মন্ডপে ভীড় ধরে রাখার জন্য এই সেদিন অবধি ছিল 'শো'। এখনও 'শো' হয়, কিন্তু তার সেই রৌনক আর নেই। এইসব 'শো' গুলিতেও বড় বড় পাহাড় দেখা যেত। বিভিন্ন বাড়িতে আমরা পাহাড় নির্মাতারাও ঘুরে ঘুরে পাহাড় দেখে আসতাম, আর কোথাও অভিনবত্ব দেখলে ভাবতাম, সামনের বছর ওদের মতো করে বানাতে হবে। 

শৈশব বেশিদিন হল পেরিয়ে আসিনি আমি। এখনও পেছন ফিরে তাকালেই শৈশবকে দেখতে পাব মনে হয়, রাস্তার বাঁক আসেনি এখনও। কিন্তু টাউনে পাহাড় বানানোর 'পাহাড়ি' শিশুদের আর দেখি না। এখন যেহেতু পাহাড় বানানোর সেই বয়স আর নেই, তাই আসল পাহাড়ে ছুটে ছুটে যাই। তিস্তার ধার থেকে সকালে, এই হেমন্তেই পরিস্কার দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলেই  মনে ভেসে ওঠে পাহাড় বানানোর কথা। তার ধবল চুড়ার মতো চুড়া বানানোই তো একসময় লক্ষ্য ছিল আমাদের! তাহলে কি জলপাইগুড়িতে পাহাড় বানানোর একটা হাইপোথিটিক্যাল কারণ এটাই যে, যেহেতু এই সময়ই প্রথম  টাউন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, তাই তাকে নিজেদের মতো তৈরি করে আসন্ন শীতকালে দার্জিলিং পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার ভ্রমণ মুখর দিন গুলিকে স্বাগত জানানো? এমন ভাবনা তো ভাবা যেতেই পারে। 

কালীপূজা আসে, পাহাড় বানানো হয়। কালীপূজা যায়, পাহাড় ভেঙেও ফেলা হয়। তারপর তীব্র ভাবে জাঁকিয়ে তবে হেমন্তকাল। বিষণ্ণ হেমন্তকাল। দুপুর শেষ হলেই কেমন যেন জরাগ্রস্থ বৃদ্ধের মতো দশা হয় রোদের। মন কিছুতেই ভাল লাগে না। পরীক্ষার পড়ার চাপ বাড়ে, অপেক্ষা থাকে আবার আগামী বছরের। প্রতিটি মানুষ যে যার কর্মজীবনে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবার মধ্যেই উত্তেজনা ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। এই হেমন্তের অরণ্যে একজন পোস্টম্যানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে খুব।

এমন দিন গুলোয় মা আজকাল বলে, লাইব্রেরি যেতে। বিকেলের মৃত আলোয় আজাদ হিন্দ পাঠাগারে যাওয়ার সেই রাস্তাও বড় দুঃখিত হয়ে বসে থাকে। শহরের সব মানুষ যেন যুদ্ধ ক্লান্ত পরাজিত সৈনিক। মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে যে যার বাড়িতে, দূরে দূরে, একা একা। 

শিশুরা আজ আর পাহাড় বানায় না। অভিভাবকেরাও তাদের কাদামাটি জল ঘাটতে নিষেধ করে। বাড়ির সামনে এখন তেমন জায়গা জমিও নেই। শিশুদের মডেল বানানোর প্রথম ধাপই ছিল এই পাহাড় নির্মাণ। কত সুন্দর ভাবে আমরা কল্পনার রূপ দিতাম! পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে অনেক বেশি করে শিক্ষালাভ করত শিশুরা।

এখনও এই শহর থেকে পাহাড় দেখা যায়। আবহমান কাল ধরেই দেখা যাবে। কিন্তু পাহাড় বানানো আর হয় না। সেই কারিগরেরা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। 

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.