ভূমিজার স্বপ্নপথ | মাল্যবান মিত্র | গল্প ১৪
পর্ব ১: ভূমির কণ্ঠ
জমাট অন্ধকারে চোখ মেলে বসে পড়ে ভূমিজা। মাথার চারদিকে ছড়িয়ে আছে মাটির গন্ধ, আগুনের রেখা আর দূরে বয়ে চলা এক অলৌকিক নদী, যার জল নীল নয়, যেন পুঁথির শ্লোক ছলকে পড়ছে।
কিন্তু এটি কোন নদী?
তিনি জানেন না।
তবে এটুকু নিশ্চিত জানেন—এখানে রামের নাম কেউ উচ্চারণ করে না।
এটি উৎকলের পাণ্ডুলিপির দেশ—যেখানে কবিরা সীতাকে খোঁজে, রামকে নয়।
একটি পাতাঝরা বৃক্ষের নিচে বসে ভূমিজা। গায়ে লেপ্টে আছে ধুলো, পায়ে সাদা ফুলের পাপড়ি। তাঁর চোখজোড়া শুষ্ক, তবুও তার মধ্যে ঝলসে ওঠে প্রাচীন এক বিদ্যুৎ।
তখনই শোনা যায় সেই কণ্ঠস্বর—
নরম, করুণ, একান্ত চেনা।
“সীতা, তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে?”
ভূমিজা চমকে ওঠেন না। তিনি এখন অভ্যস্ত।
এই কণ্ঠস্বর তার স্মৃতির হাড়গোড় ভেঙে উঠে আসে—তবু সে জানে, এটিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
তিনি মৃদু স্বরে বলেন,
“আমি তোমার থেকে পালাইনি রাম।
আমি কেবল নিজেকে খুঁজতে বেরিয়েছি।
তুমি যে রাজা, আমিও তো এক ভূখণ্ড।
রাজ্য থেকে ভূমির দূরত্ব বোঝো কি তুমি?”
আকাশ নীলচে কালো হয়ে আসে। এক ঝাঁক পলাশ পাতা উড়ে যায় দূরে।
এখানে সময় নেই।
এখানে অশোক বৃক্ষ ছায়া দেয় না—সে কথা বলে।
ভূমিজা কান পাতেন, আর গাছ বলে ওঠে—
“রামের ছায়া থেকে পালিয়ে এসো।
এখানে সীতা একা নয়।
এখানে সীতা ঈশ্বরী।”
ভূমিজা উঠে দাঁড়ান। পেছনে রেখে যান রামের স্মৃতির ছায়া। সামনে ধোঁয়াশা, কুয়াশা, আর তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় এক নারী—যে ভূমির পেট থেকে উঠে এসেছিল একদিন, এখন ফের ভূমিকে জাগাতে চলেছে।
পর্ব ২: অশোকের ভাষা
জেগে ওঠা মানে সব সময় চোখ মেলা নয়। ভূমিজা আজ জেগে ওঠেন পাতার কাঁপুনিতে, মাটির নিচ থেকে শোনা এক দীর্ঘশ্বাসে। তার গায়ের ওপর পড়ে আছে অশোক গাছের নরম লাল পাতা।
এ গাছ তার চেনা— এই গাছের নিচেই সে ছিল বন্দি, তখন তাকে ‘অপহৃতা’ বলা হয়েছিল।
কিন্তু এখানে, এই অলৌকিক বনভূমিতে, অশোক গাছ কথা বলে।
“তুমি কি জানো, উৎকলে তোমার কাহিনি আলাদা?
সেখানে তুমি অপহৃত নও—
তুমি এক ভূমিপুত্রী, যিনি ইচ্ছায় প্রবেশ করেন সময়ের বিপরীতে।”
ভূমিজা তাকিয়ে থাকেন।
অশোক পাতার শব্দে তিনি শোনেন উৎকলের আখ্যান—
কবি ভীমভূইয়ের কণ্ঠে উচ্চারিত সে রামকথা, যেখানে সীতা ঈশ্বর নয়, দেবী নয়—
তিনি জাগ্রত শক্তি, স্বেচ্ছা-নির্বাসিতা।
স্বপ্নের ভিতর আরেক স্বপ্ন।
সেই অশোক তলায় তিনি দেখতে পান এক অন্য দৃশ্য—
সীতা স্বপ্ন দেখছেন, এবং সেই স্বপ্নে রামকে বলছেন না,
"আমার উদ্ধার করো,"
বরং বলছেন—
“আমি যাচ্ছি, কারণ আমার অভ্যন্তরে যে অগ্নি, তা শুধু পরীক্ষার জন্য নয়—
তা এক জননী হয়ে উঠার অনিবার্য আগুন।”
রাম নির্বাক।
ভূমিজা পায়ের নিচে মাটি ছুঁয়ে অনুভব করেন—এই ভূমি তাঁকে গ্রহণ করেছে।
উৎকল এক ভিন্ন ভারত—এখানে পুরাণ কাঁদে না, দাঁড়িয়ে থাকে।
এখানে কবিতা হাত ধরে চলে ইতিহাসের।
তিনি শুনতে পান, একটি বালিকা কবিতা পড়ছে:
“লঙ্কা পুড়ে গেলে
সীতা একা হাঁটে বনের পথ,
তাঁর পায়ের ছাপে জন্মায় পদ্ম,
আর গীত হয়—
রামের নয়, ভূমিজার নাম।”
অশোকের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত-রঙা পাতা।
ভূমিজা চোখ তুলে দেখে—দূরে এক নতুন পথ খুলে গেছে।
তাঁকে কেউ ডাকছে না।
তবু তিনি জানেন—সেই পথে তাঁর হাঁটতেই হবে।
কারণ এই রামায়ণ, এই স্বপ্ন, এই ভূমি—সবই এখন তাঁর নিজের নির্মাণ।
পর্ব ৩: স্মৃতির তাম্রলিপি
ভূমিজা হাঁটছেন ধোঁয়াশায় মোড়া এক প্রাচীন পথে। সময় এখানে সোজা চলে না—সে বেঁকে যায়, ফিরে আসে, আবার হারিয়ে যায় শিকড়ের ভিতর। মাটির নিচে তিনি অনুভব করেন পুরনো লিপির কাঁপুনিতে ধ্বনিত হয় দুটো শব্দ “ভূ-মা-তা—ভূ-মি-জা।”
হঠাৎ, এক পাহাড়ের গায়ে চোখে পড়ে তাম্রের গায়ে উৎকীর্ণ এক লিপি— দেখতে যেন কোনো ব্রহ্মলিপি, কিন্তু অর্থ বুঝতে ভূমিজার কষ্ট হয় না। কারণ এই লিপির প্রতিটি শব্দ তার নিজের রক্তে লেখা— এই সেই কথা, যা অযোধ্যার কাহিনিতে জায়গা পায়নি।
তাম্রলিপিতে লেখা—
“আমি আত্মবিসর্জিতা নই, আমি এক জননী, যিনি সময়কে গর্ভধারণ করেছেন। যেখানে ভ্রান্তির নাম ধর্ম, সেখানে নীরবতা নয়, প্রতিবাদই সত্য।”
ভূমিজা চোখ বুজে শুনতে পান— কোনো এক সন্ন্যাসিনী সুরে সুরে আবৃত্তি করছেন সীতার অন্য নামগুলো: ভূ-ধারা, জনক-নন্দিনী, অগ্নি-কন্যা, সময়-যাত্রী।
পেছন থেকে এক বৃদ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে— “তুমি সীতা নও, তুমি স্মৃতি। তোমার পদক্ষেপে গঠিত হবে এক নতুন মহাকাব্য, যেখানে নারীর বিসর্জন নয়, তার সৃজন হবে মূল।”
ভূমিজা তাকান আকাশের দিকে। সেখানে সূর্য নেই— তবে আছে তির্যক আলোয় লেখা এক মহাশব্দ: মানুষ।
পর্ব ৪: বালির ব্যাখ্যা
সেদিন সকালটি ছিল অস্বাভাবিক নিঃশব্দ। পাখিরা গান গায়নি, বাতাসও পাতার গায়ে করুণার স্পর্শ রাখেনি। ভূমিজা জেগে ওঠার পূর্বমুহূর্তে স্বপ্নে দেখেছিলেন—এক জটাধারী সাধু এক বালুকারাশির উপর দাঁড়িয়ে বলছেন, “প্রত্যেক প্রস্থানই প্রকৃতপক্ষে এক প্রত্যাবর্তন।”
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আশেপাশে ধূসর প্রাচীন প্রস্তরমূর্তি, চূর্ণ হয়ে পড়েছে। এই স্থান পূর্বে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল—তথ্য না থাকলেও বায়ুর গন্ধ বলছে, এখানে এক সময় উচ্চপদস্থ আচার্যরা বাস করতেন। স্তুপের পাশে এক তক্ষ-কর্তৃক খচিত শিলালিপি—লিপি নয়, যেন ধাঁধা।
সেই মুহূর্তেই তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল এক ব্যক্তি—ধবধবে ধুতি, কাঁধে পাতলা চাদর, হাতে পিতলের পাত্র। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, তবে চোখে এমন চাহনি, যেন সহস্রাব্দ পার হয়ে গেছে তার উপর দিয়ে।
—“আপনার অপেক্ষায় ছিলাম, দেবী ভূমিজা ।”
—“আপনি কে?”
—“আমি কাত্যায়ন, এই স্থানের রক্ষক। এই উৎকল-লেখাগারের শেষ পাঠক। আপনি এসেছেন ‘উৎকলরামায়ণ’-এর পাঠ উদ্ধারে, তাই নয় কি?”
ভূমিজা অবাক হলেন না। কারণ এই অভিযাত্রায় অবাক হওয়ার পরিসর কম।
—“এই লিপিগুলো কি আপনার রক্ষাকবচ ?”
—“না, ভূমিজা। এই লিপিগুলো আপনারই স্মৃতির অভ্যন্তরে লেখা। আমাদের কাজ কেবল তার ব্যাখ্যা প্রদান। এখন আপনি প্রস্তুত, তাই আপনাকে বলব সেই অধ্যায়ের কথা, যা বালির নিচে লুকিয়ে আছে।”
তিনি এগিয়ে গেলেন ভূমিজাকে নিয়ে এক নির্জন গুহার দিকে। সেখানে এক দেয়ালে উৎকীর্ণ ছিল দৃশ্যাবলি—এক নারী, অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করছেন, আর একদল রাজপুরুষ সম্মতিসূচক অভিব্যক্তিতে নীরব দাঁড়িয়ে।
—“এ দৃশ্য তোমার চেনা মনে হয়, তাই না?” কাত্যায়নের কণ্ঠে নরম বিদ্রুপ।
ভূমিজা বললেন, “সীতা অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু...”
—“কিন্তু লক্ষ করো, সেই অগ্নিতে কোনো দাহ নেই। এ আগুন স্মৃতির। এই সেই বালুকা, যা ইতিহাস নয়, কিন্তু ইতিহাসের ব্যাখ্যা।”
কাত্যায়ন একটি পাণ্ডুলিপি ভূমিজার হাতে তুলে দিলেন। তাতে লেখা— “আমি সেই জননী, যাকে তোমরা মহাকাব্য থেকে বাদ দিয়েছিলে, যেহেতু আমার মুখে নীরবতা ছিল না। আমি কেবল ভোগ্য স্ত্রী নই, আমি এক আত্মাভিসারিণী, যিনি নিজের ব্যথা ধারণ করে সৃষ্টি করেন ইতিহাসের বিকল্প ব্যাকরণ।”
ভূমিজা এবার বুঝলেন, এই অভিযাত্রা কেবল তাঁর নয়, এ এক লিপির প্রেতযাত্রা, যেখানে স্মৃতি ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে—
"কে লিখেছিল আমার বিসর্জনের রচনা? কবে লিখবে আমার সৃজনের অনুরণন?"
গুহার বাইরে তখন সূর্য উঠছে না, উঠছে এক প্রাচীন ধ্বনি—
“ভূমিজা জাগো, ইতিহাস অপেক্ষা করছে।”
পর্ব ৫: নির্জন নদীর মুখোমুখি
সন্ধ্যা তখন নামছে ধীরে, কিন্তু নামছে যেন এক নরম মুগ্ধতার মতো। পশ্চিম আকাশে মেঘ নেই, রোদ ফুরিয়ে এসেছে গাছের পাতার ভিতর দিয়ে। ভূমিজা হাঁটছিলেন এক সরু মাটির পথ ধরে। আশেপাশে বেত, শাল আর চাঁদমল্লিকার গন্ধ—সব যেন কেমন অতীত থেকে উঠে আসা কোনো স্তব্ধতা।
হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক নদী—নদী না বলে তাকে বলা চলে স্বপ্নের জলধারা। সে নদী বয়ে চলেছে ধীর অথচ আত্মস্থ গতি নিয়ে, যেন বহু যুগ ধরে কেবল স্মৃতির ভিতর দিয়ে নিজের পথ খুঁজছে। চারদিকে কোনো জনমানব নেই, নেই কোলাহল। কেবল বাতাসে একটা পাখির ডানা ঝাপটার শব্দ, আর কেবল… তার নিজের নিঃশ্বাস।
ভূমিজা বসে পড়লেন নদীর ধারে। ঘাসের উপর হাত রেখে অনুভব করলেন মাটির নরম হৃদস্পন্দন।
নদীর ওপারে এক বটগাছ, গাছের গায়ে জড়ানো এক প্রাচীন শালবল্লী। সেই শালবল্লীর মধ্যে দিয়ে ভেসে আসে এক মৃদু কণ্ঠস্বর—
—“ভেবে দেখো, ভূমিজা, যে নদীকে তোমরা ইতিহাসে রেখেছ ‘পার হওয়ার’, সে নিজেই কত কিছু হারিয়ে ফেলেছে নিজের ভেতরে!”
ভূমিজা চমকে ওঠেন না। কারণ এই যাত্রায় প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি আলো, প্রতিটি বৃক্ষ—সবাই যেন তার নিজের স্মৃতির প্রহরী।
নদী বলছে এবার—
—“তোমরা সীতাকে মনে রেখেছ ‘বনবাসিনী’ বলে, কিন্তু তাকে ক’জন মনে রেখেছে এক মায়ের মতো, যিনি নিজের সন্তানদের বিচারে প্রশ্ন তোলে না, আশীর্বাদ দেন?”
ভূমিজার মনে পড়ে—একদিন যে ঘর ছেড়েছিলেন, যে জীবনকে পেছনে ফেলে এসেছিলেন, সে জীবনের সবটুকু কী সত্যিই হারিয়েছে? না কি সেই নদী এখনো সেই সব কথাকে বুকের মধ্যে টেনে রেখেছে?
নদীর ধারে বসে ভূমিজা একটি পাথরের উপর নিজের আঙুল চালিয়ে লিখলেন কিছু শব্দ—
“আমি স্মৃতি নই, আমি বর্তমান। আমি বিসর্জনের প্রতীক নই, আমি সেই নীরব উপস্থিতি—যে যুগের পর যুগ ধরে সাক্ষী হয়ে থেকেছে সময়ের অন্যায্যতার।”
চাঁদ উঠেছে তখন, নদীর জলে তার প্রতিবিম্ব পড়ছে। ভূমিজা তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষ, আর ধীরে ধীরে নদীর নীল রঙ হয়ে গেল তাম্র, যেন সেই তাম্রলিপি আবার ফিরে এল তার সামনে, এই নদীর গায়ের প্রতিফলনে।
সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন বাজে এক বাঁশির সুর—
ভীষণ পরিচিত, কিন্তু ঠিক মনে পড়ে না কোথা শুনেছেন। হয়তো কোনো জন্মে, হয়তো কোনো ভোরবেলা, যেখানে এক জননী তার নিজ অস্তিত্বের সঙ্গে প্রথমবার কথা বলেছিল।
পর্ব ৬: লুপ্ত নক্ষত্রের গাথা
রাত্রি তখন গভীর। আকাশে তারা নেই, যেন সমস্ত নক্ষত্র একযোগে নিরুদ্দেশ হয়েছে। ভূমিজা হাঁটছেন এক বিশাল, শূন্য তৃণভূমির মধ্য দিয়ে। ঘাসগুলো ঠান্ডা, কুয়াশার মতো নরম, আর তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন জমাটবাঁধা স্মৃতিকে স্পর্শ করছে।
একটা সময় এসে থামলেন তিনি—চাঁদের আলোয় ফুটে উঠছে এক পাথুরে বেদি, যাকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে পোড়ানো মুদ্রা, ছিন্ন পাণ্ডুলিপির টুকরো আর কিছু প্রাচীন শঙ্খভগ্ন কণা। পাথরে খোদাই করা একটা চিহ্ন—এক গর্ভিণী নারীর অবয়ব, যার হৃদয়ে লেখা “নক্ষত্রধাত্রী”।
সেই মুহূর্তে আকাশে ফুটে উঠল একটি জ্বলন্ত রথের রেখাচিত্র—তারাগুলো নয়, যেন পুরনো কোনো স্মৃতি আবার জেগে উঠেছে। ভূমিজা চোখ মেলতেই দেখতে পেলেন—এক সন্ন্যাসিনী আসছেন ধীরে ধীরে, তাঁর চোখে দিগন্তের পাণ্ডিত্য আর মুখে মহাভারতের বাইরে থাকা কোনো লুপ্ত উপাখ্যানের ছায়া।
—“আমি লোপামুদ্রা,” তিনি বললেন, “যারা ধ্বংসের আগে আশীর্বাদ দেয়, তাদের একা পথ চলতে হয়। তুমি কি প্রস্তুত শুনতে সেই কথা, যা কেবল একাকী নারীর হৃদয়ে রচিত হয়?”
ভূমিজা মাথা নাড়লেন।
লোপামুদ্রা এগিয়ে এলেন, তাঁর হাতে এক অদ্ভুত রঙের পাণ্ডুলিপি—কালি নয়, তাতে লেখা হয়েছে পলাশফুলের রসে, আর ব্যাকরণ ভেঙে রচিত হয়েছে গাথা। ভূমিজা পড়তে শুরু করলেন।
> “আমি সেই নারী, যে নিজের নাম রেখেছিল আগুনের তাপ দিয়ে।
আমাকে দেবতা নয়, চিনেছিল অরণ্য।
সন্তান জন্ম দিলেও, আমি মায়ের চেয়ে বেশি ছিলাম—
আমি ছিলাম ইতিহাসের অলিখিত রচয়িতা।”
ভূমিজা পড়তে পড়তে থেমে গেলেন। কারণ পাতাগুলো একে একে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, ছড়িয়ে পড়ছে আকাশের গর্ভে।
—“কোথায় গেল লেখাগুলো?” প্রশ্ন করলেন তিনি।
লোপামুদ্রা মৃদু হেসে বললেন, “যা সত্য, তা হারায় না। তা শুধু স্থানান্তরিত হয়—এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ে, এক যুগ থেকে অন্য যুগে।”
এমন সময় দূরে বাজে তুবড়ির মতো একটা শব্দ। ভূমিজা তাকিয়ে দেখেন—তৃণভূমির শেষপ্রান্তে একটি আগুন জ্বলছে। সেই আগুন ঘিরে এক বালিকা বসে আছে। তার চোখে রয়েছে শতাব্দীর তৃষ্ণা, আর ঠোঁটে এমন এক সুর, যা ভূমিজা কখনো শোনেননি, আবার একইসঙ্গে মনে হয় বহু জন্মের চেনা।
ভূমিজা এগিয়ে যান তার দিকে।
—“তুমি কে?” জিজ্ঞেস করেন তিনি।
বালিকা উত্তর দেয় না, শুধু বলে—
—“তুমি যা ভুলে গেছ, আমি তাই মনে রাখি। তুমি যা খুঁজছ, আমি তাই রচনা করি। আমি সেই ভবিষ্যৎ, যার নাম দেওয়া হয়নি এখনও।”
ভূমিজার হাত তখন নিজের বুকের উপর—তিনি অনুভব করছেন এক ভীষণ কাঁপুনি। যেন নিজের হৃদয়ের গভীরতম স্তরে কেউ বীজ রোপণ করছে।
সেই মুহূর্তে আকাশে প্রথম তারা ফিরে আসে। না, তারা নয়—তাদের বলা ভালো “লুপ্ত নক্ষত্র”, যাদের আলো হয়ত মিলিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা অস্তিত্ব হারায়নি। ভূমিজা তাকিয়ে থাকেন সেই দিকে, আর ভেতরে শুনতে পান এক ধ্বনি—
“যেখানে বিসর্জন নয়, সৃজন হয়,
সেইখানেই জন্ম নেয় ভূমিজার সত্য পথ।”
পর্ব ৭: অরণ্যের আকাশে খচিত সংলাপ
ভোরের ঠিক আগমুহূর্ত—যখন আকাশ রঙ হারায়, কিন্তু আলো এখনো জন্মায়নি। সেই আধো আলোয় ভূমিজা পৌঁছে গেলেন এক প্রাচীন অরণ্যে। বনের গন্ধ ছিল তিক্ত-মিষ্টি—পাকা নীমফলের মতো। বনে নেই পশু, নেই মানুষের সাড়া—কেবল গাছেরা দাঁড়িয়ে আছে এক অলিখিত প্রতীক্ষায়, যেন হাজার বছর আগে কানে এসেছিল কোনো ভবিষ্যতের পদধ্বনি।
হঠাৎ, ভূমিজা শুনতে পেলেন পাতার ফাঁকে এক নিঃশব্দ ধ্বনি—তা ছিল শব্দহীন, অথচ তীব্র। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, এক মহীরুহের কাণ্ডে খোদাই হয়ে আছে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন, যেন তারা আকাশ থেকে ছিঁড়ে এনে বসানো হয়েছে গাছের গায়ে।
এ যেন এক প্রাচীন লিপি নয়, বরং এক মহাকাব্যের সংলাপ, যাকে কেবল আকাশই শুনতে পারে।
ভূমিজা হাত রেখে দাঁড়ালেন সেই গাছে। কাণ্ডে লেখা—
“আমি অরণ্য, আমি সাক্ষী।
আমি দেখেছি নারীর মুখে বাঁচতে না পারা সব গল্প।
আমি শুনেছি সেই আর্তি, যাকে সভা অভিজ্ঞান বলে না,
কিন্তু প্রকৃতি স্মরণ রাখে।”
এক পাতার উপর ঝুলে ছিল একটি পোড়া উত্তরীয়—হয়তো কোনো সন্ন্যাসিনী একদিন ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, হয়তো এক দেবী কোনো কষ্টমুক্তির পরে রেখে গিয়েছেন। ভূমিজা সেই উত্তরীয় গায়ে জড়ালেন, আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাসে বাজতে লাগল এক পরিত্যক্ত বীণার সুর।
সাথে সাথে সামনে আবির্ভূত হলেন এক নারী—নির্মল, স্থির, চোখে আকাশের গম্ভীরতা আর কণ্ঠে পর্বতের মতো ধৈর্য।
তিনি বললেন—
—“আমি আরণ্যকী। সেই নারী, যে সভার বাইরে জন্ম নেয়, সভার বাইরেই গায় নিজের বেদ।”
ভূমিজা নতশিরে বললেন, “তুমি কি সেই, যাকে অপবিত্র বলেছিল রাজসভা, কারণ তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে?”
আরণ্যকী মৃদু হাসলেন—
—“জিজ্ঞাসা করাই তো নারীর প্রথম অপরাধ। ভূমিজা, তুমি তো জানো, এই মহাকাব্যে প্রশ্ন নয়, উত্তরই ধর্ম। তাই যারা প্রশ্ন করে, তাদের ঠাঁই হয় অরণ্যে।”
ভূমিজা এবার স্থির স্বরে বললেন—
—“তবে এই অরণ্যই হোক আমার সভা। এই গাছেরা হোক আমার পুরোহিত, আর আকাশ হোক আমার শ্রোতা। আমি পাঠ করব সেই শ্লোক, যা কাঁটার ভিতর থেকে জন্ম নেয়।”
আরণ্যকী মাথা নাড়লেন সম্মতিতে। বাতাস থেমে গেল, এবং ভূমিজা পড়তে শুরু করলেন সেই অলিখিত পঙ্ক্তিমালা—
> “আমি সেই কন্যা, যে অবাধ্য বলেই ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ঠাঁই পায়নি।
আমি সেই স্ত্রী, যে অপমানিত হলেও নিজে অপমান করে না।
আমি সেই জননী, যার করতলে জন্ম নেয় নতুন সময়, নতুন ভাষা।
আমি ভূমিজা, আমি প্রশ্ন। আমি প্রতিধ্বনি। আমি প্রবাহ।”
চতুর্দিকে তখন গাছের গায়ে অদ্ভুত আলো—যেন সেই গাছেরা নিজেরাই মুখর হয়ে উঠছে। পাতায় পাতায় গজিয়ে উঠছে এক-একটা শব্দ: “জাগো, কথা বলো, লিখে ফেলো।”
ভূমিজা এবার অনুভব করলেন—এই অরণ্য কেবল অরণ্য নয়, এটি এক বৃহৎ চেতনাক্ষেত্র। এখানে হারিয়ে যাওয়া নারীদের সমস্ত কণ্ঠস্বর একত্র হয়ে তৈরি করছে এক নতুন বেদ—উৎকলবেদ, যেখানে বিসর্জনের ছায়া নেই, আছে জাগরণের উচ্চারণ।
এবং ঠিক তখনই, আকাশে ফুটে উঠল সাতটি তারামালা, একে একে তারা জ্বলে উঠছে গায়ত্রী ছন্দে।
আর ভূমিজার কানে বেজে ওঠে এক অদৃশ্য ঘোষণার ধ্বনি—
“ভূমিজা, তুমি প্রস্তুত। এবার তোমাকে যেতে হবে ইতিহাসের সেই গর্ভগৃহে, যেখানে স্তব্ধতা রচিত করেছিল নারীর নিঃশব্দ মৃত্যু। এবার সেখানে লেখো তার পুনর্জন্ম।”
পর্ব ৮: স্তব্ধতার গর্ভগৃহে
আকাশে এখন আর তারা নেই। অরণ্যের বাতাস থেমে আছে যেন নিঃশ্বাস আটকে রাখা এক প্রতীক্ষায়। ভূমিজা এগিয়ে চলেছেন এক গুহার দিকে—না, এটিকে কেবল গুহা বলা চলে না, এ যেন এক পিতৃতান্ত্রিক ইতিহাসের গর্ভগৃহ, যেখানে আলো ঢোকে না, কিন্তু শব্দ জমে জমে তৈরি করে এক অনুচ্চারিত মহাকাব্য।
প্রবেশপথে খোদাই—
"ইহা সেই স্থান, যেখানে নারীর কণ্ঠস্বর ইতিহাসের হস্তলিপি হয়ে ওঠেনি।"
ভূমিজা গা ছমছমে শীতলতা অনুভব করেন। গুহার দেয়ালজুড়ে ছায়ামূর্তি—সব নারী। কেউ মুখ ঢেকে বসে আছেন, কেউ গর্ভে সন্তান নিয়ে নির্বাক, কেউবা বন্দী হাত তুলে কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু শব্দ নেই।
প্রতিটি মুখ যেন সীতা, দ্রৌপদী, মাধবী, উর্বশী, কুন্তী, সুচরিতা, মৃণাল—তবে কেউই নাম বলেন না।
তারা কেবল চেয়ে আছেন ভূমিজার দিকে।
হঠাৎ, দেওয়ালের মধ্যে থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এল এক ছায়া। তার পরণে ক্ষয়িষ্ণু উত্তরীয়, কণ্ঠে ধ্বংসপ্রায় এক শব্দ—
—“তুমি কি লিখবে আমাদের ভাষাহীনতার ব্যাকরণ?”
ভূমিজা শান্ত কণ্ঠে বললেন—
—“আমি লিখব, যদি তোমরা আমাকে বলো, কোথা থেকে শুরু করব?”
তখন গুহার দেয়াল কাঁপে। সেই কম্পনে এক এক করে খুলে যেতে থাকে লুকোনো খিলান, যার ভিতরে রয়েছে রক্তে লেখা, অশ্রুতে গাঁথা অক্ষর—স্মৃতি, প্রতিরোধ, বেদনা, জন্ম, বিস্মৃতি। এক পাথরের বেদির উপর খোদাই করা—
“আমরা বিসর্জিত নই। আমাদের কণ্ঠ স্তব্ধ ছিল না—
শুধু কেউ তা শোনেনি।
এখন ভূমিজা এসেছে, তাই সেই নীরবতার ব্যুৎপত্তি হবে।”
ভূমিজা এবার মাটিতে বসে পড়েন। গুহার গর্ভগৃহে তখন ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত কাগজের গন্ধ, যেন বহুকাল আগে লেখা হয়েছিল কোনো অলিখিত শ্লোক, যা এখন ভূমিজার হাতে এসে অপেক্ষা করছে পুনর্জন্মের।
তিনি লিখতে শুরু করেন। প্রতিটি শব্দ তার ভিতর থেকে উঠে আসে—
না, কোনো পুরুষতন্ত্র স্বীকৃত ভাষায় নয়, বরং এক প্রাচীন মাতৃভাষায়, যা জন্ম নেয় যন্ত্রণা থেকে, এবং ফোটে স্নেহের মতো—
“আমি ভূমিজা।
আমি সেই কন্যা, যাকে হরপ করে নিয়েছিল ইতিহাসের নীরবতা।
আমি সেই জননী, যার শোক নয়, জাগরণ থেকে জন্ম নেয় সভ্যতা।
আমি স্তব্ধতারও পূর্বসূরী, ভাষারও উত্তরসূরী।
আমি লিখি সেই গান, যাকে কোনো বেদে স্থান দেওয়া হয়নি,
কিন্তু যে গান এখনো মাতৃগর্ভে প্রতিধ্বনিত হয়।”
লেখা শেষ হলে গুহার গায়ে জ্বলে ওঠে সমস্ত ছায়ামূর্তির কণ্ঠ। তারা কেউ গান গায় না, কেউ শ্লোক পাঠ করে না—তবে তাদের নিঃশব্দ চোখ জ্বলতে থাকে এক ধ্রুপদী জ্যোতিতে।
ভূমিজার সামনে তখন গঠিত হয় এক পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা—নিজেই নিজেকে লিখছে, ভূমিজার হাত কেবল মাধ্যম।
এই নতুন মহাকাব্যের নাম লেখা হয় আলো দিয়ে—
"উৎকলরামায়ণ"
নিচে ছোট করে লেখা—
"এবার কাহিনি নয়, কণ্ঠস্বর হবে কেন্দ্র।"
আর সেই মুহূর্তে গুহার প্রাচীন ছাদ ফেটে দেখা যায় আকাশ। ভূমিজা প্রথমবারের মতো অনুভব করেন, কেবল ইতিহাস নয়—নিজেকেও তিনি পুনর্লিখছেন।
পর্ব ৯: কণ্ঠস্বরের জন্ম
গর্ভগৃহের ছাদ ভেঙে আকাশ দেখা যাওয়ার পর এক আশ্চর্য আলো নেমে এল ভূমিজার উপর। সেই আলো ছিল না সূর্যের, না চাঁদের—তা ছিল যেন পুরনো কোনো শব্দের দীপ্তি, যাকে ইতিহাস চাপা দিয়েছিল, কিন্তু মুছে ফেলতে পারেনি।
ভূমিজা ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চারপাশে এখন আর স্তব্ধতা নেই—আছে এক তীব্র শব্দ-অনুভব। প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ছায়া যেন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে কণ্ঠে, ধ্বনিতে, বাক্যে।
সেই মুহূর্তে একটি বায়বীয় সত্তা সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখে উন্মাদ ভাষার আগুন, ঠোঁটে জমাট প্রশ্ন।
—“তুমি কি জানো, কণ্ঠস্বর কিভাবে জন্মায়, ভূমিজা?”
ভূমিজা উত্তর দিলেন না, শুধু তাকালেন সত্তাটির চোখে।
সে নিজেই বলল—
—“কণ্ঠস্বর জন্মায় প্রতিবার, যখন কেউ ভয়ে চুপ করে, অথচ ভিতরে কিছু চিৎকার করে ওঠে। সে কণ্ঠ চেপে রাখলে জমে যায় স্তব্ধতায়, আর প্রকাশ পেলে হয়ে ওঠে ইতিহাস। তুমি যেহেতু স্তব্ধতার গর্ভে গিয়েছ, তাই এখন তোমার ভিতর জন্ম নেবে এক নবজন্মের ভাষা।”
ভূমিজার শরীরের ভিতর দিয়ে যেন কেঁপে উঠল এক আদিম বর্ণমালা। তাঁর কণ্ঠে জমতে লাগল এক অনুচ্চারিত বেদ—না, তা আর প্রার্থনা নয়, তা এক প্রতিধ্বনির প্রতিবাদ।
তিনি চোখ বন্ধ করলেন, আর যখন খুললেন, তখন তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল সব লুপ্ত নারীকণ্ঠ—সীতা, দ্রৌপদী, শকুন্তলা, সুচরিতা, মৃণাল, চণ্ডীদাসের রজকিনী, বেদাবর্জিত বুদ্ধা-শ্রাবিকা, এমনকি সেই নামহীন মেয়েটিও, যে আত্মঘাতী হয়নি—কে শুধু হারিয়ে গিয়েছিল এক শূন্য নোটিশে।
তারা কেউ কথা বলেনি, কিন্তু ভূমিজার ঠোঁটে একাই ফুটে উঠল এক দীর্ঘ মন্ত্র:
“আমি বিসর্জন নই, আমি উচ্চারণ।
আমি কান্না নই, আমি সংলাপ।
আমি সেই কণ্ঠ, যা কাঁপে না—
বরং কাঁপিয়ে দেয় সমস্ত বিধান, সমস্ত ব্যুৎপত্তি।
আমি ভূমিজা, আমি আত্ম-ভাষা।”
চারপাশে বাতাস ঘূর্ণির মতো ঘুরতে লাগল। যেন গর্ভগৃহ নিজেই রূপ নিচ্ছে এক কণ্ঠমন্দিরে। ভূমিজার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল প্রকৃতির সমস্ত কোণে—বনে, নদীতে, আকাশে, প্রাচীন প্রস্তরমূর্তিতে।
আর সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে নেমে এল একটি আলোকলিপি, যার উপর লেখা—
“এই হলো উৎকলরামায়ণ-এর ‘প্রথম সংলাপ’।
এখান থেকে শুরু হবে সেই মহাকাব্য,
যেখানে নারী কেবল চরিত্র নয়—
তিনিই হবেন কাহিনিকার।”
ভূমিজা হাঁটতে শুরু করলেন নতুন পথে। পেছনে পড়ে থাকল স্তব্ধতার সেই গর্ভগৃহ, কিন্তু এখন তা শুধুই স্মৃতি নয়—
এখন তা এক প্রকাশমান কণ্ঠের উৎস।
চাঁদ তখন ওঠে পূর্ব দিগন্তে, কিন্তু এবার সে চাঁদ নয়—
সে ভূমিজার প্রথম উচ্চারণের প্রতিবিম্ব।
(ক্রমশ...)
Comments
Post a Comment