তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

ক্যুইন অফ ডুয়ার্স : ইতিহাস, অর্থ, অবস্থান ও বর্তমান প্রেক্ষাপট | মোফাজ্জল মণ্ডল | প্রবন্ধ ৮

'ক্যুইন অফ ডুয়ার্স' (Queen of the Dooars) শব্দযুগলটি সাধারণত ডুয়ার্স অঞ্চলের কয়েকটি অত্যন্ত অপরূপ প্রাকৃতিক ছোট-খাটো স্থান—বিশেষ করে আলিপুরদুয়ার জেলায় কালচিনি ব্লকের অতি পুরনো জয়ন্তী ও লেপচাখা—এর জন্য পর্যটন-ভাষায় ব্যবহার হয়ে থাকে। ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ আছে তবে চাহিদামত নেই। এই উপাধিটি কোনো একক সরকারি বা আইনত নাম নয় বরং ভ্রমণকারি, পর্যটন প্রচার এবং স্থানীয় গাইড/ব্লগাররা এলাকার সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের কারণেই এই মুগ্ধকর উপাধি নিয়েছে। নীচে ব্যাখ্যা করব: কোথায় এই নামটি প্রযোজ্য, কেন বলা হয়েছে, কবে থেকে প্রচলিত, নামকরণের উৎস কতটা ঐতিহাসিক ও/অথবা বাণিজ্যিক, বর্তমান অবস্থা ও অবহেলার কারণসমূহ―

ক. 'ডুয়ার্স': ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট
'ডুয়ার্স' (Dooars বা Duars) হলো হিমালয়ের পাদদেশীয় সমভূমি—ভারতের উত্তর-পূর্ব এবং ভুটানের দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যবর্তী প্রশস্ত সমভূমি। শব্দটির উৎপত্তি স্থানী ব্যবহৃত শব্দ ‘দুয়ার/দ্বার’ থেকে—অর্থাৎ পাহাড়ি অংশের সঙ্গে সমভূমির মধ্যে যে গেটগুলি বা পথগুলো আছে সেগুলিকেই ‘দুয়ার’ বলা হয়। বলা হয় মোট আনুমানিক প্রায় ১৮টি ‘দুয়ার’ বা পথ আছে। ডুয়ার্সের সামগ্রিক ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ভূমিকা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও স্থানীয় রাজতন্ত্র—সব মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

খ. 'ক্যুইন অফ ডুয়ার্স': কোথায় ও কেন বলা হয়?
অনলাইন, ভ্রমণ-গাইড, ট্যুর অপারেটর ও ব্লগে প্রধানত জয়ন্তী (Jayanti) ও লেপচাখা (Lepchakha)-কে প্রায়ই “Queen of the Dooars” বা “ক্যুইন অফ ডুয়ার্স” বলা দেখা যায়। তবে নামকরণটিও যথার্থ। সুন্দরী জয়ন্তী হচ্ছে বক্সা ওয়াইল্ডলাইফ অঞ্চলে জয়ন্তী নদীর তীরে অবস্থিত এক বনগ্রাম; লেপচাখা হলো বক্সার পাহাড়ের উপরে এক ছোট হিলটপ গ্রাম। উভয়েই দৃষ্টিনন্দন, প্রাকৃতিক সৌন্দয, অতি মনোনয়ন দৃশ্য,   পাহাড়ি  ভিউ, নদী–ছায়া, পাহাড়ের পরিপ্রেক্ষিত ও নীরবতা প্রদানে বিশেষ স্থানাধিকার করে। পর্যটন-ওয়েবসাইট, ব্লগ আর সরকারি উত্তরবঙ্গ পর্যটন পৃষ্ঠাগুলো এই উপাধি ব্যবহার করে। জয়ন্তীকে নিয়ে বলা যায়― “জয়ন্তীর নদী যেন প্রকৃতির রঙতুলি, যার আঁচড়ে আঁকা হয় ডুয়ার্সের চিরসবুজ কবিতা।”

গ. কেন এই উপাধি?
সৌন্দয, চিত্রাভঙ্গিমা ও ভিউ: জয়ন্তী/লেপচাখা থেকে ভুটানের পাহাড়-রিজ, মেঘ-রোমাঞ্চ ও নীলা-জলরেখার দৃশ্য অনন্য। পর্যটন লেখকরা এ ভাবেই “রাণী” বা “কুইন” বিশেষণ প্রয়োগ করে—অর্থাৎ সৌন্দর্যের শীর্ষস্থান হিসেবে। অফবিট ও অনবদ্যতা এগুলো মূল ডুয়ার্সের মতই ব্যপারী/ভিড়ের কেন্দ্র নয়—শান্ত, অনাবিষ্কৃত ও বন্যপ্রাণী-বেষ্টিত তাই সৌন্দর্য ও শান্তির কারণে উচ্চাঙ্গীভূত নাম মেনে নেওয়া হয়েছে।
তাই তো নি:সন্দেহে বলা যায়-
“ডুয়ার্সের বক্সা দুর্গ ও জয়ন্তী নদী—একদিকে ইতিহাসের গর্ব, অন্যদিকে প্রকৃতির চিরন্তন রূপকথা।”

ঘ. নামকরণের উৎস:
সরকারি বা ঔপনিবেশিক নথিতে স্পষ্ট “কুইন অফ ডুয়ার্স” সূত্র মেলেনি। অর্থাৎ এই নিয়মিত খেতাবটি কোনো একক অফিসিয়াল ঘোষণায় বেরোনোর চিহ্ন দেখা যায় না (যেমন—কোনো ব্রিটিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডকুমেন্টে)। এ কারণে এটা বলা যুক্তিযুক্ত যে—উপাধিটি মূলত ভ্রমণকার, ট্যুর অপারেটর, ব্লগার ও পরে পর্যটন প্রচারকরা প্রচলিত করেছেন। অনলাইন এবং আদি–আধুনিক ট্রাভেল তথ্য অনুযায়ী  ২০০০ সালের পরে এই শব্দের প্রচলন বড় আকারে বেড়েছে। (অর্থাৎ নামকরণ—আধুনিক বাণিজ্যিক/পর্যটন কনটেক্সটেই)।

ঙ. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ব্রিটিশ–ডুয়ার্স সংযোগ: ব্রিটিশরা ১৯০০শ শতকের মধ্য–শেষভাগে ডুয়ার্স অঞ্চলে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে প্রবেশ করে—চা বাগান স্থাপন, বনজ সম্পদ আহরণের  জন্য রেলপথ নির্মাণ করেছিল। ডুয়ার্সে চা এবং বনজশিল্প দ্রুত গড়ে ওঠে, যার ফলে ভূখন্ডের জনসংখ্যা ও অর্থনীতি বদলে যায়। বক্সা–জয়ন্তীর ভূ-ইতিহাস: বক্সা ফোর্ট, বক্সা অঞ্চলের বন ও জয়ন্তী নদী—এসব জায়গা ব্রিটিশ যুগেই লোকসঞ্চার ও সাময়িক শিল্প-হাব ছিল (চুনাপাথর, কাঠ আদি)। পরে এগুলি পর্যটনীয় ও বন্যপ্রাণী-অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেল। রেল/ট্রামওয়ের ছিল।  বক্সা–জয়ন্তীর সেতুর ছিল। যা পরবর্তীতে বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়। 

চ. বর্তমান অবস্থা:
বক্সা টাইগার রিজার্ভ (Buxa Tiger Reserve): 
বর্তমানে বক্সা টেকসই সংরক্ষণ-অধীনে সেই জোনে জয়ন্তী ও লেপচাখা অন্তর্ভুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বক্সায় বেশ কিছু প্রাকৃতিক আবিষ্কার ও গবেষণাও হচ্ছে (উদাহরণস্বরূপ—জৈববৈচিত্র্য জরিপে নতুন বা বিরল প্রজাতি-রেকর্ড)। এই ধরনের বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি এলাকার পরিবেশগত গুরুত্বকে নিশ্চিত করে। 

পর্যটন: জয়ন্তী/লেপচাখা এখনো “অফবিট” পর্যটন স্পট—সীমিত সংখ্যক রিসোর্ট/লজ রয়েছে; ভ্রমণকারীর সংখ্যা বাড়লেও পরিকাঠামো সীমিত। স্থানিক নিরাপত্তা (ভুটান সীমান্ত-সংক্রান্ত বিধি), বনবিভাগের অনুমতি ও রাস্তা-অভিগম্যতা পর্যটন বৃদ্ধিতে বাধা হয়ে থাকে। তাই বলা যায়, 
"ডুয়ার্সের Tea হলো স্বাদের দূত, Tourism হলো সৌন্দর্যের সেতু, আর Timber হলো জীবনের শ্বাস।"

ছ. 'উন্নত' পর্যটন গন্তব্যে পরিণত অবহেলার কারণ:
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বনাম উন্নয়ন: 
বন-সংরক্ষণ বিধি, কোর জোন রক্ষার প্রয়াস ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা—এসব উন্নয়নের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। একের পর এক মামলা ও আদালতের রায়ে বিপর্যয় ঘটে ট্যুরিজম ব্যবসায়। ফলে অবকাঠামো-নির্মাণ সহজ হয় না। বন বিভাগের নীতিগত সীমাবদ্ধতা ও স্থানীয় লোকজীবনের অধিকার—সব মিলিয়ে সমন্বয়হীনতা বাড়ে। 

সীমান্ত-সংবেদনশীলতা ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা: জয়ন্তী-লেপচাখা ভুটানের সীমান্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ—সেজন্য সেনাবাহিনী/বর্ডার-টাস্কের নিয়ম-কঠোর বন-প্রবেশ, পথে অনুমতি ও গেটে নিয়ম আছে—এই সব প্রক্রিয়া পর্যটক-প্রবৃদ্ধিকে বাঁধা দেয়। 

পরিকাঠামো-শূন্যতা: যোগাযোগ ব্যবস্থা নড়বড়ে। প্রচারের বড্ড অভাব।  সরাসরি রাস্তাঘাট, পর্যাপ্ত লজিং-সুবিধা, নিয়মিত পরিবহন—এসব সীমিত ফলে বৃহৎ পর্যটন-উদ্যোগ বা মডার্ন হোটেল শৃঙ্খলা গড়ে ওঠেনি।  পর্যটন-ওয়েবসাইটগুলোই বারবার “অফবিট” (offbeat) বলে বিচিহ্নিত করে। 

অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও চা-শিল্প সংকট: ডুয়ার্স অঞ্চলের অর্থনীতি বহুটা চা-শিল্পের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু গত দু-তিন দশকে একাধিক চা-বাগান বন্ধ/অচল হওয়ায় লোকাল অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে—এটি পর্যটন ও দরজার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় লোকাল বিনিয়োগ ও সেবা-শক্তিকে দুর্বল করেছে। গবেষণা ও সংবাদে ডুয়ার্সের গার্ডেন শাটডাউন এবং তার সামাজিক প্রভাবের আলোকপাত আছে। 

নথিভিত্তিক ও ঐতিহাসিক প্রচারের অভাব: অন্য পর্যটন স্পটগুলোর তুলনায় ঐতিহাসিক দস্তাবেজ, ব্রিটিশ-যুগের রুট বা চিত্র অনুযায়ী বড় স্কেল-প্রচার কম। আধুনিক পর্যটন বিপণন ও কনটেন্ট নির্মাণ না হলে নাম শুধু পর্যটকদের ব্লগ/ট্যুর অপারেটরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। “কুইন অফ ডুয়ার্স” একটি রিজার্ভ আর্কাইভ-নির্ধারিত উপাধি নয় এটি বরং আধুনিক পর্যটন–ভাষায় গড়ে ওঠা এক সম্মানসূচক নাম, যা জয়ন্তী ও লেপচাখার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ স্থানকে বোঝায়। এই নামকরণ মূলত ভ্রমণকার, ব্লগার, ট্যুর অপারেটর ও স্থানীয় পর্যটন প্রচারের ফসল। ঐতিহাসিক বুনিয়াদি (ব্রিটিশ–ডুয়ার্স, চা শিল্প, রেল ও বনজ সম্পদ আহরণ) এই অঞ্চলের পরিকাঠামো ও জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে; আধুনিক সময়ে বন-সংরক্ষণ ও চা-বাগান সংকট মিলিতভাবে উপযোগী পর্যটক-বেস্ট পরিবেশ গঠনে বাধা দিয়েছে। 

জ. সুপারিশ:
সংরক্ষণ-সহ পর্যটন নকশা (Eco-Tourism Plan): স্থানীয় বন বিভাগ, জেলা পর্যটন ও কমিউনিটি-নেতাদের নিয়ে মিলিত পরিকল্পনা—অল্প মাত্রায়, নিয়ন্ত্রিত বন-ট্রেইল, কম-প্রভাব লজিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ: লিভিলিহুড বিকল্প (গাইডিং, হোমস্টে, হস্তশিল্প বিক্রয়) পরিকল্পিতভাবে উন্নীত করলে সামাজিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হবে। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও প্রচার: সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপাদান (বক্সা ফোর্ট, পুরোনো রেল-আর্কাইভ, স্থানীয় ইতিহাস) ডকুমেন্ট করে পর্যটন প্রচারে ব্যবহার করা দরকার। প্রশাসনকে ভূমিকা পালন করতে হবে।চা-শিল্প পুনরুজ্জীবন ও সমন্বয়: ডুয়ার্স অঞ্চলের টেকসই চা-অর্থনীতি গঠনে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সহায়তা, লেবার-রিফর্ম ও ডিজিটাল মার্কেটিং জরুরি। এতে স্থানীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হবে যাহা পর্যটন উন্নয়নে সাহায্য করবে। 

তথ্যসূত্র : Britannica— “Dooars”,
North Bengal Tourism, NorthBengalGuide/ Tripoto, ResearchGate/ academic surveys on Dooars, tea-economy & closed gardens, Times of India/ news on biodiversity, discoveries & recent ecology reports.

Comments

  1. The write-up is really beautiful! 👏
    You’ve explained very clearly what “Queen of the Dooars” actually means, where it refers to, and why people use this title. The way you described the beauty of Jayanti and Lepchakha, along with their history, nature, tea gardens, forests, and tourism issues, is excellent.

    What I liked most is that you didn’t just talk about the beauty of the place — you also mentioned the real challenges like road conditions, forest rules, and local livelihoods. The line “Tea is the messenger of taste, Tourism is the bridge of beauty, and Timber is the breath of life” is simply unforgettable — poetic and meaningful at the same time.

    In short, your article is both informative and heartfelt. Well done! 👍

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.