জলপাইগুড়ি : চা শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গোড়ার কথা | অনুভব দে | প্রবন্ধ ১০
১৯০৫ তৎকালীন 'বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্টি হয়, 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশ, অংশ হয়ে পড়ে সেদিনের জলপাইগুড়ি জেলা, ১৯১১ সালের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে জানা যাচ্ছে, জেলার সীমা ১৮৬৫ এর যুদ্ধে, জয় করা ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স এবং রংপুর জেলা থেকে ১৮৬৯-৭০ সালে ভাগ হওয়া জলপাইগুড়ি বোদা রাজগঞ্জ পাটগ্রাম থানা। রাজশাহী বিভাগের এবং নিজ জেলার সদর জলপাইগুড়ি। প্রাকৃতিক দিক দিয়ে জেলা কে দুই ভাগ করা যায় এবং আজকের ভুয়ার্স সম্পর্কে এক বিস্তির্ণ ধারণা পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট ও উত্তরে ভুটান রাজ্যের উপস্থিতি সামরিক কারণে এই অঞ্চল শাসকের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চা তামাক বনজ সম্পদ জেলার গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হয়ে ওঠে।
উনবিংশ শতকের শেষদিকে দার্জিলিঙে যখন চা বাগানের সংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং হাজার ১৮৬২ সালের দার্জিলিং জেলার তরাই চামটা টি গার্ডেন (প্রতিষ্ঠাতা জেমস হোয়াইট) এর স্থাপনের পর, পরবর্তী ১০বছরে দার্জিলিংয়ের তরাই ও পাহাড় মিলিয়ে যখন চা বাগানের সংখ্যা তিনগুণ হয়ে যায় তখন স্বভাবতই শিল্পপতিদের নজর পড়ে তরাই এর পূর্ব দিকের জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স অঞ্চলে। আমাদের জেলার প্রথম চা বাগান স্থাপন হয় ১৮৭৪ সালে গাজলডোবা, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রিচার্ড হাউটন, তাকেই ডুয়ার্সের চা শিল্পের পাইওনিয়ার আখ্যা দিয়েছে গেজেটিয়ার, ডক্টর ব্রুহাম ছিলেন এই বাগানের মালিক। এর ঠিক দুবছর বাদেই ডুয়ার্সের চা বাগানের সংখ্যা হয় ১৩, আর ১৯০৭ সালের তথ্য এই ডুয়ার্সে চা বাগানের সংখ্যা ১৮০, উৎপাদন ৪৫১৯৬৮৯৪ পাউন্ড বা ২০৫০১টন। সুতরাং বলাই যায় ডুয়ার্সের এবং আবহাওয়াকে শিল্পপতিরা সহজেই অনুকূল বলে মেনে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে ১৫২ টি চা বাগান ছিল। ১৯৬২ সালে জেলায় সাড়ে ছয় কোটি কেজির বেশি চা উদপাদন হয়।
১৯১৫ সালের জলপাইগুড়ির জ্যোতিষ চন্দ্র সান্যাল, জলপাইগুড়ির সমস্ত ভারতীয় পরিচালিত চা কোম্পানি। গুলোর কাছে চা শিল্পের স্বার্থে একটি সংঘ গড়ার প্রস্তাব রাখেন। সেই সময়ে চা শিল্পপতিদের সংগঠন ছিল ইন্ডিয়া টি আসোশিয়েশন যার সকল সদস্য ছিলেন অভারতীয়রা, বঙ্গভঙ্গ রদের পরবর্তী সময়ে জ্যোতিশ চন্দ্র সান্যালের সেই প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয় খুব অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স আসোশিয়েশন। বর্তমানে আরো বেশকিছু এরকম সংগঠন গড়ে উঠেছে। এই চা-বাগান গুলিতে মূলত প্রথমদিকে পাহাড়ের জনজাতি গুলি থেকে শ্রমিক নিয়োগ করা হতো, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায়, ডুয়ার্সের বাগানগুলো শ্রমিকেরা মূলত ছোটনাগপুর এবং সাঁওতাল পরগনার অঞ্চল থেকে আসেন, ব্রিটিশরা 'সরদার' এর মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করত এবং এই সরদাররা প্রতিদিনের তাদের মাধ্যমে নিয়োগ করা শ্রমিকের সংখ্যা অনুযায়ী দৈনিক কমিশন পেত। এবং সেই সময় এই শ্রমিকদের ওপর কোন শ্রম আইন কোন সরকারি সুপারভিশন ছিলনা। এবং এবং বাসস্থান থেকে যাত্রী নিয়ে আসার সময় তাদের প্রতি কোন আচরণের ওপর সরকারের কোনো আইনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ১৯১১ সালের গেজেটিয়ার এই জিনিসগুলো সুন্দর করে লেখা গাছে, চাইলেই ইন্টারনেটে বা কোন গ্রন্থাগারে গিয়ে পড়ে নেওয়া যায়।
এই চা বাগানের চা পাতা আমদানি-রপ্তানি এবং শ্রমিকদের আগমনের স্বার্থে তৎকালীন সরকার রেলপথ নির্মাব শুরু করে, এই অঞ্চলে প্রথম রেলপথ আসে ১৮৭৮ সালে, নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলপথ এর লাইন চিনামাটি জলপাইগুড়ি ছুয়ে বর্তমান শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে শেষ হত, বলাবাহুল্য ব্রিটশরা এই লাইন করেছিলেন দার্জিলিং এর জন্য, সেই সময় গ্রীষ্মের গরমে গুলোতে গভর্মেন্ট অফ বেঙ্গল এর প্রশাসন দাজিলিং পাহাড় থেকে পরিচালিত হতো, গেজেটিয়ার থেকে জানা যাচ্ছে সেই সময়ে জলপাইগুড়ি জেলায় মাত্র তিনটি রেলস্টেশন ছিল মন্ডল ঘাট জলপাইগুড়ি বেলাকোবা। এই মেন লাইন দিয়েই, ডুয়ার্স ও জলপাইগুড়ি সংযুক্ত হয় প্রথম কলকাতার সঙ্গে, এবং যোগাযোগের উন্নতিতে এলাকার অর্থনৈতিক বদল ঘটে, এরপর ব্রিটিশরা এই স্বার্থেই ১৮৯১ সালে তৈরী করেন বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে, সদর দোমহনী। এই বছরের এপ্রিল মাসে এই মিটার গেজ রেল নির্মাণের বরাত পায় লন্ডন ও কলকাতায় দফতর থাকা অক্টাভিয়াস স্টিল কম্পানি। তাদের কাজ জলপাইগুড়ি শহরের তিস্তা নদীর অপর প্রান্তে বার্ণিশ ঘাট থেকে ডামডিম পর্যন্ত মেন লাইন আর লাটাগুড়ি থেকে ভাগ হয়ে রামশাই পর্যন্ত লাইন নির্মান করা, পরবর্তীতে জলঢাকা নদী পেরিয়ে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করে তারা। ১৮৯৩এর ১৫ই জানুয়ারী মালবাজার পর্যন্ত এই রেলপথ শুরু হয়, রামশাই শাখা ওই বছরেই ১১জুন যাত্রা শুরু করে, এবং ১৯০০ সালের ২০ নভেম্বর বার্ণিশ ঘাট থেকে লালমনিরহাট সংযুক্ত হয় ডুয়ার্স থেকে কলকাতা গামী বিকল্প রুটের রুপায়ন হয়। ১৯০১ সালে মালবাজার থেকে রেললাইন চালসা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়, ১৯১৮ সলে এই লাইন আবার মেটেলি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়, মেটেলি সম্প্রসারণের আজকে আর কোনো অস্তিত্ব নেই। পশ্চিম দিকে ডামডিম থেকে লাইন ১৯০১ সালের পয়লা মে ওদলাবাড়ি, পরের বছর বাগরাকোট হয়ে ১৯০৩ সালের ১৪ই জুন সেবক পৌহয়।
এই রেলপথের পরিষেবা শুরুর পর ডুয়ার্সের একটা পরিবর্তন ঘটে হাজার ১৯০৭ সালে এই রেল ৬লাখের অধিক যাত্রী ও দেড় লক্ষ টনের মাল পরিবহন করে। যদিও সেই বছর চা (১৬ হাজার টন) এবং পাট ১৭ হাজার টন রপ্তানি হয়েছিল। এর থেকে বোঝা যায় যে পাট চাষ কতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা প্রথমের রাজশাহী থেকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ এর কথা ভাবলেও এই পথে বিভিন্ন নদীগুলির চওড়া অধিক হওয়ায় চালসা থেকে পূর্বে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেই সময় আলিপুরদুয়ারে একটি লাইন নির্মাণ করে কোচবিহার স্টেট রেলওয়ে, গিতালদহ থেকে রাজভাত খাওয়া জয়ন্তী পর্যন্ত। রাজাভাতখাওয়া থেকে এই লাইন ১৯১২ সালে কালচিনি পর্যন্ত ১৯১৪ সালে দলসিং পারা পর্যন্ত এবং ১৯১৮ সালের পয়লা এপ্রিল মাদারিহাট পর্যন্ত সম্প্রসারন হওয়ায়, বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে লাইন এব সাথে সংযুক্ত হয়। হাজার ১৯১১ সালে কি সেবক থেকেই শিলিগুড়ি পর্যন্ত লাইন পাতা হয়। এর ফলে পূর্ব থেকে পশ্চিম ডুয়ার্স পুরোটাই একটি রেল পথ দ্বারা সংযুক্ত হয়।
আমাদের জেলায় বড় বড় নদী থাকায় ব্রিটিশ প্রশাসন কিছু কিছু জায়গায় জলপথ পরিবহনে ব্যবস্থা শুরু করে। মূলত তিস্তা এবং জলঢাকা নদীতে এই ব্যবস্থা ছিল যার অধিকের পরিচালনা করতেন ডিসট্রিক্ট বোর্ড। এই সময়ের কটি গুরুত্বপূর্ণ ফেরি পথ ছিল বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলপথ পরিচালিত জলপাইগুড়ির করলা ঘাট (সম্ভবত আজকের কিংসাহেবের ঘাট) থেকে অপর পাড়ে বার্নিশ ঘাট এই সময় দোমহনীর সাথে রেলপথ সংযুক্ত থাকায় ডুয়ার্সের মানুষের জেলাসদর জলপাইগুড়ি যাত্রা পথের সময় অনেক কমে যায়। আসাম মেন লাইনের লালমনিহাট ও দোমহনী সংযুক্ত থাকায় জায়গাদুটি এই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হয়ে ওঠে।
গেজেটিয়ার থেকে এই সময় তিস্তার গতিপথে উত্তর দিকে পাহাড়পুর, রঙধামালি কৈকয়াপুর ইত্যাদি জায়গায় ফেরির উপস্থিতি জানা যায়। এই সময় বিভিন্ন সড়ক পথের মাঝে পড়া নদীতেও ফেরি পারাপার হত মুলত জলাকা নদীতে। ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের বাড়িতে টাকা পাঠানোর সেই সময় একমাত্র ভরসা ছিল ডাকঘর। ১৯১০ সালে জেলায় মোট ৫৬টি পোস্ট অফিস ছিল জানা যাচ্ছে। এগুলিতে ১৯০৭-০৮ সালে প্রায় ২০ লক্ষের কাছাকাছি মানি অর্ডার করা হয়। এই খান থেকে আমরা সেই সময় চা শিল্পে কার্যরত শ্রমিকদের সংখ্যার একটা অনুমান করতে পারি।
সেই সময় দ্রুত খবর পাঠানোর উপায় ছিল টেলিগ্রাফ, সেই সময় জেলার ১৮টি টেলিগ্রাফ অফিস ছিল, জলপাইগুড়ি, ডামডিম, সাইলিহাট, পিলানশাট, গয়েরকাটা, ফালাকাটা, মেটেলি, নাগরাকাটা, লুকসান, বানারহাট, বীরপাড়া, আলিপুরদুয়ার, বক্সা, কালচিনি, পানাবস্তি এবং দলসিংপাড়া, সমস্ত রেলস্টেশনে ও এই পরিষেবা মজুদ ছিল। এর থেকে আমরা সেই সময়ের বড় জনপদগুলোর একটা অনুমান করতে পারি। স্বাধীনতা ও দেশভাগের ফলে জেলার সাথে বহির্বদ ও অশিষ্ট ভারতবর্ষের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এবং পরবর্তীতে আসাম রেল লিঙ্ক প্রকল্পের মাধ্যমে জেলার রেলপথের সাথে অবশিষ্ট দেশের সংযুক্তি ঘটানো। হয়। এবং সেটি এতটাই একটি বিস্তীর্ণ অধ্যায় যে তার জন্য হয়তো একটি সম্পূর্ণ আলোচনা প্রয়োজন। ১৯১১ থেকে আজ ১১০ বছরের বেশি সময় পরে আমরা যখন ডুয়ার্সের রাজপথে দিয়ে, বা রেল লাইন দিয়ে দূরে দিগন্তে পাহাড় কে রেখে, সুদৃশ্য চা বাগান, জঙ্গল, জনপদ ঘেরা ডুয়ার্স এর অপার্থিব সৌন্দর্য কে দেখি, ক্যামেরাবন্দি করি কখনো দুই একটা জিনিস তার সম্পর্কে লিখে দি মুগ্ধ হয়ে, তখন ডুয়ার্সের গড়ে ওঠার এই রকম অনেক ইতিহাস আমরা হয়তো এড়িয়ে যাই। আসলে একটা অঞ্চলের গড়ে ওঠা তে সাক্ষী থাকে অনেক মানুষের শ্রম, অনেক ইতিহাস, যা সময়ের প্রতিটি ইটের তলায় চাপা পড়ে হয়তো যায়, জেলার তরুণ প্রজন্ম হিসেবে আমদের কর্তব্য এই আমাদের জেলার গড়ে ওঠার এবং বিশ্বে পরিচিতি পাওয়ার যে কারণ আছে তার গড়ে ওঠার কাহিনী তুলে ধরার। ডুয়ার্সের ব্যকেই আছে অনেক ইতিহাস। এই বিশ্বায়নের যুগে, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তা আমাদের হারাতে দেওয়া যাবেনা।
তথ্যসূত্র: Eastern Bengal and Assam District Gazeteers Jalpaiguri 1911, John F Gruning Jalpaiguri District Gazetteer 1981, Government of West Bengal, Indian Railway Fans Club, শ্রী দীপক রায় চৌধুরী এবং শ্রী অরবিন্দ সেতুলাননের গবেষণা।
Comments
Post a Comment