প্রেমিকারা | দিব্যেন্দু ঘোষ | গল্প ৬
অনেকদিন থেকেই লিখব ভাবছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না। নিজের প্রেম নিয়ে লেখা যায় নাকি? যায় নাকি একান্ত প্রেমিকাদের কথা অক্ষরে বুনতে? তাই হয়ে উঠছিল না। যতবারই লিখতে যাই, মাথার মধ্যে থেকে মহামান্য শয়তান কলকাঠি নাড়তে থাকে। বাধা দেয়। অপমান করে। বিশ্বপ্রেমিক তকমা দিয়ে আমার আত্মাকে দুর্বল করে দেয়। তবুও সাহস জোগাই নিজেকে। সংখ্যাটা গুনি। কিন্তু গোনায় ভুল হয়ে যায় হামেশাই। কাকে দিয়ে শুরু করা যায়, সেটাই ভুলে যাই।
জন্মের সময় নানাবিধ জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে যাওয়া ছোট্ট শিশুটা ক্রমে ক্রমে বালক হয়ে ওঠে। কিন্তু তার মা অদ্ভুত কাণ্ড করে। তাকে প্রায়ই গামছা অথবা শাড়িতে জড়িয়ে ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক লাগিয়ে, কপালে টিপ পরিয়ে আসন্ন কন্যা সন্তানের আবির্ভাবের মহড়া দিয়ে নিত। সেও বউ সেজে চুপ করে খাটের ওপর বসে থাকতে বিশেষ অপছন্দ করত না, কারণ স্বল্প পরিচিত প্রতিবেশীদের ভড়কে দিয়ে যে আনন্দ তার মা পেত, পুত্র নিজেও তার কিছুটা হলেও ভাগ পেত। এভাবেই সুখে দুঃখে তাদের দিন কাটছিল। এমন সময় পুত্রের বাবা দিব্যদৃষ্টিতে তার পুত্রকে বিরাট জজ ব্যারিস্টার ভেবে ফেলল এবং পুত্রের অফুরন্ত খেলার সময়কে বিনা দ্বিধায় বিনা কাঁচিতে কেটে ছোট করে দিল। বিনা মেঘে ভূমিকম্পের মতো এমন কাজে পুত্র বেশ ব্যথা পেল, তবে মা-বাবা যথেষ্ট আহ্লাদিত হল। বাবা তার সন্তানকে লিটল এঞ্জেল নামক জেলখানায় অর্থের বিনিময়ে পোস্ট করে এল।
আন্দুলের গলি তস্য গলির বাড়ি ছেড়ে ওরা তখন সবেমাত্র বাসুদেবপুর রেল লাইন সংলগ্ন বাড়িতে নতুন সংসার পেতে বসেছে। বাড়ি থেকে স্কুল হাঁটাপথ। তবুও বাবা গাড়ি কিনল, সেই গাড়িতেই পুত্র স্কুলে গদগদ হয়ে যাওয়া আরম্ভ করল। ধীরে ধীরে পুত্র সহপাঠীদের মাঝে মর্কট সম্রাটের মর্যাদা লাভ করল এবং পরীক্ষায় আশাতীত নম্বর পাওয়ার ফলে ম্যাডামদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল। এমনি করেই তার পরিচিতি ঘটল তৃষিতা, নার্গিস ও তিন্নির সঙ্গে। তাদের মধ্যে তৃষিতা দুরন্ত সুন্দরী গোলগাল এবং মাথায় গোবরের আধিক্য। তার বাবা তাকে গাদা গাদা বুদ্ধির ইনজেকশন ক্যাপসুলে ভরে খাওয়ালেও তার মাথার হেড অফিসে কিছু ধরাতে সমর্থ হয়নি বলেই তার কাছের মানুষেরা বলে থাকে। এই কারণে নার্গিস ও তিন্নির সঙ্গে বালকটির বেশি খাতির জমে ওঠে। অন্যদিকে তৃষিতার মা-বাবার সঙ্গে বালকের পরিবারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকল। প্রায়ই স্কুল ছুটির পর বালকটিকে নার্গিস ও তিন্নিকে বিদায় দিয়ে মায়ের হাত ধরে তৃষিতার বাড়ির উদ্দেশে যেতে দেখা যেতে লাগল। এভাবেই চলতে চলতে একদিন দুটি পরিবার মিলে গাদিয়াড়ায় পিকনিক করতে গেল। সেখানে গিয়ে বালকটি খেয়াল করল, তৃষিতা নামের সেই গোলগাল বোকাসোকা বালিকাটিকে আজ মনোরম লাগছে। কিন্তু বালিকাটি তাকে সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় আধ ঘণ্টার কাকুতি মিনতির পর, তিনটে চকোলেট, দুটো ফুল আর একটা ঘাসফড়িংয়ের বিনিময়ে সেই বালিকা অভিমানে মেঘাচ্ছন্ন চোখে বালকের দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুমি প্রতিদিন শুধু নার্গিসের সঙ্গে বসো, আমার সঙ্গে বসো না।
বালকের অন্তরে কী যেন বয়ে গেল ফল্গুধারার মতো, সে বিনা চিন্তায় বিনা দ্বিধায় বলে ফেলল,
-ঠিক আছে, এখন থেকে প্রতিদিন তোমার সঙ্গেই বসব।
সে কন্যা তো যারপরনাই আনন্দে আটখানা হয়ে জঙ্গলের শুকনো ডালপালা ও ঝরা পাতা মাড়িয়ে নূপুরে নিক্কন তুলে দৌড়তে লাগল। বালকও তার পিছু নিল এবং কিছুক্ষণ পর তারা ক্লান্ত হয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। বালকটি আজও জানে না, কেন তার সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সবকিছু ভুলে তৃষিতার হাতটা ধরতে এত বেশি শখ হয়েছিল। সব দ্বিধা দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে বালিকার সুকোমল হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিল বালক। আহা, সেই স্পর্শ সে আজও ভুলতে পারে না। হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে বালিকা বালকের মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবী আলোকিত করে একখানি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
-নার্গিস আর তিন্নির সঙ্গে আর কথা বলবে না, ঠিক আছে? সেই জন্য কিন্তু হাত ধরতে দিয়েছি।
বালকের তখন চোখের সামনে হাজার প্রজাপতির ওড়াউড়ি, সে কোনও রকমে ‘আচ্ছা’ বলে বালিকার হাত আরও জোরে চেপে ধরল।
নাহ্, ওদের প্রেমপর্ব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরের দিন ক্লাসে নার্গিসের আনা চাওমিনের লোভ সামলাতে না পেরে প্রথমে নার্গিসের সঙ্গে কথা বলে ফেলে, পরে তার সঙ্গে বসে গল্পগুজবে মেতে ওঠে বালক। ফলে তৃষিতার সঙ্গে কলহ নিত্যদিনের ব্যাপারে পরিণত হয়। একটা সময় ওদের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়।
নাহ, তৃষিতা তার প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার আগেই বাবার বদলির কারণে বালকটিকে বর্ধমান চলে যেতে হয়। তৃষিতা, নার্গিস, তিন্নি, তুলি সহ আরও বেশ কিছু বান্ধবীকে চোখের জলে ভাসিয়ে সে ডিং ডিং করে নাচতে নাচতে বর্ধমানের সিটি হোটেলের পাশে বোসপাড়ার দোতলা বাড়িটিতে গিয়ে ওঠে। সৌম্যসুন্দর স্কুলে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি হয়। প্রতিদিন সকালে উঠে চোখ ডলতে ডলতে স্কুলে যাওয়া অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক কাজ বলে মনে হতে লাগল। তাকে উদ্ধার করল মিমি আর রিমি নামে দুই যমজ বোন। ওরা সেই বালকের পাশের বাড়িতে থাকত। ওই স্কুলে ওরাও ভর্তি হল। ওরা একসঙ্গে মুরগির খাঁচার মতো স্কুলগাড়িতে চেপে স্কুলে যেত। মিমি শান্তশিষ্ট হওয়ায় ওর মা লম্বা চুলে তেল দিয়ে বিনুনি বেঁধে দিত, সে তুলনায় রিমি একটু দুষ্টু হওয়ায় ওর মাথার চুল ছোট করে ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল। তাতে রিমির কোনও ক্ষতি হয়নি। কারণ, সে সময়ে অসময়ে মিমির বিনুনি টেনে আমোদ পেত। কেউ তার বিনুনিতে হাত দিলেই মিমি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাড়া করত। বালকটিও রিমির সঙ্গে মিলে মিমিকে খেপাতে শুরু করে। একদিন বিকেলে সে আর রিমি মিমিকে বেজায় খেপাচ্ছে। ও বেদম খেপে দুজনকে তাড়া করল। কিন্তু কাউকেই হাতের নাগালে না পেয়ে একটা আধলা ইট তুলে ছু়ড়ে মারল। বালকটির নিতম্বে সে ইট আছড়ে পড়ল। সে চোখে অন্ধকার দেখল আর ধপাস করে পড়ে গেল। দুরন্ত বেগে কাঁদতে শুরু করে। মিমি ছুটে এল। তার কোমল হৃদয় তরল হয়ে উঠল। সে বালকের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। কিন্তু সে তাকে ছুঁতে দিল না। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে জল দেখল। নিজের কান্নার কথা ভুলে গেল। সে কান্নামিশ্রিত গলায় বলল,
-খুব লেগেছে, না?
-হুমম।
শুনে মিমি তাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিল। বালকটিও ভ্যাবলার মতো ফের কান্না জুড়ে দিল। এই দৃশ্য দেখে রিমি উল্টোদিকে দৌড় দিল। সেদিন থেকে বালকের আর মিমির মধ্যে সখ্য গড়ে উঠল। সে মেয়েটির মধ্যে এক চিরন্তন মমতাময়ী নারীকে খুঁজে পেল। খাই খাই করা চশমা-পরা বালকটিকে খাইয়ে সে বড়ই প্রীত হত। তার ঘরে বিস্কুট চানাচুর সন্দেশ নিয়ে আসত। বালক ছবি আঁকত। একটা মেয়ের ছবি আর প্রকৃতির ছবি। উজ্জ্ব্ল তার চোখ দুটো। হাতকাটা ফ্রক পরে সে ঘুরে বেড়ায়। সেই ছবি মিমিকে উপহার দিল সে। একটু একটু করে রিমির চক্ষুশূল হয়ে উঠছে। একদিন এমনই একটা ছবি নিয়ে রিমি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দিল। ফলে মিমি-রিমির যুদ্ধ বেধে গেল। দুজনেই বালকটিকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, সে কাকে বেশি ভালবাসে। সে তো নিঃসঙ্কোচে বলে দিল,
-মিমিকেই বেশি ভালবাসি।
রিমি হতভম্ব হয়ে গেল, মিমি লজ্জা পেয়ে ছুটে বাড়ি পালিয়ে গেল। এই ঘটনার পর অনেক দিন রিমি বালকের সঙ্গে কথা বলেনি। এর কিছুদিন পর মিমি ওর মামাবাড়িতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা যায়। খবর পেয়ে বালকটি খুব কেঁদেছিল।
এর মধ্যেই বাবার ফের বদলি। তারা জলপাইগুড়ি চলে এল। ময়নাগুড়ি হাইস্কুলে ভর্তি হল। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি আলিপুরদুয়ার যেত। কাঁকনের সঙ্গে দেখা হত। সে বালকটির দূর সম্পর্কের কাকার মেয়ে। ওরা গ্রামে ছোটাছুটি করত। মাঠে গিয়ে আলপথ ধরে হাঁটত। পুকুরে ঝপাং করে ঝাঁপাত। একটু একটু করে কাঁকনের সঙ্গে সখ্য বাড়তে থাকল। একদিন রাতে সবাই মিলে টিভি দেখছে। ঘরে হালকা নীল আলো। কাঁকন বালকের পাশেই বসেছিল। হঠাৎ তার হাতের ওপর কোমল আরেকখানি হাতের স্পর্শে শিহরিত ও বিব্রত হল, কাঁকনও দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। কিচুক্ষণ পর ফের সেই একই কাণ্ড। বালকটি শিহরিত হল, কিন্তু এবার হাত সরাল না। ভাল লাগছিল। এই অবস্থায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই।
পরদিন সকালে উঠে দেখল কাঁকন তার বাড়ি চলে গেছে। বালকটির কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করছিল, মনে হচ্ছিল ওদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার কথা যেন সকলে জেনে গেছে, সবাই কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। পরদিন কাঁকন এল। মা ওদের দুজনকে ডাকল। বালক দেখল মায়ের হাতে একটুকরো কাগজ ও একটা গোলাপ। কাগজে লেখা, আমি তোমাকে ভালবাসি। কাঁকনের মুখ নিচু। বালক তো লজ্জায় পড়ে গেল। সকলে হাসাহাসি শুরু করে দিল। পরদিন খুব ভোরে উঠে জলপাইগুড়ি চলে এল। বালকটির প্রেমের ফুল অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল। কাঁকনকে ভালবাসা জানাবার কোনও অবকাশই সে পায়নি। প্রায় এক মাস পর যখন গ্রামের বাড়িতে গেল, তখন জানল, কাঁকন তার প্রাইভেট টিউটরের প্রেমে পড়ে গেছে। যখনই দেখা হত, সে তাকে এড়িয়ে যেত। বালকের ছোটকাকার বিয়ের দিন শেষবার ওকে দেখেছিল। নিভৃতে এক নির্জন কোণে তাকে একলা পেয়ে হাতখানা ধরে ক্ষমা চায়। সেও ওকে বলতে পারেনি যে ততদিনে প্রজ্ঞার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে খেয়ে ডুবছে আর ভাসছে।
ছোটবেলায় কাউকে আরশোলা বা টিকটিকি কামড়ে দেবে বলে ভয় দেখালে সেই ভয় মানুষ সারা জীবনেও ভুলতে পারে না। বড় হওয়ার পর সে বুঝতে পারে ওই আরশোলা বা টিকিটিকি বাঘ ভাল্লুক নয়, তবুও সেই ভয়টা মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে না। সেও প্রজ্ঞা নামের কোনও মেয়ে দেখলে এখনও পর্যন্ত তার ছায়া মাড়াতে সাহস করে না, কাছে যাওয়া তো দূরের কথা। জলপাইগুড়িতে ওদের বাড়ির নীচেই ছিল একটা গাড়ির গ্যারেজ। ভাঙাচোরা প্রচুর গাড়ি ছিল সেখানে। সাপের ভয় তুচ্ছ করে ওরা, মানে সেই বালক, সীমা, প্রজ্ঞা, ইমন, দোলা, রঞ্জন, সোমা সেই ভাঙা গাড়িগুলোতে বসে ভুম ভুম শব্দ করে নিজেদেরকে ভবিষ্যতের দুরন্ত ট্রাক ড্রাইভার আর হেল্পার ভেবে খেলা করত। প্রজ্ঞা ছিল বেশ খানিকটা খেপাটে টাইপের। যখন যা ওর মনে হত, তখন সেটাই করত। কারও বাধা শুনত না। কারও না কারও সঙ্গে ঝগড়া লেগেই থাকত। হঠাৎ একদিন তার মাথায় ক্যারা উঠল। ওরা নাকি সংসার সংসার খেলবে, আর সে বালকের বউ হবে। সে তো ওকে এমনিতেই খুব ভয় পেত। কোনওদিন ওর অবাধ্য হয়নি। কিন্তু বউ হিসেবে ওর চাইতে তার সোমাকেই বেশি পছন্দ ছিল। তবে সেই কথা বলার মতো সৎসাহস হয়নি। কাজেই ও একান্ত বাধ্য বর হয়ে ওর মাটিতে গণ্ডিকাটা ঘরে চুপটি করে বসে থাকত, সে দোকান বাজার করে আনত, রান্না করে তাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। এমনিভাবে চলতে চলতে কিছুদিন পর অন্য মেয়েদেরও ইচ্ছা হল বালকটির মতো চরম বাধ্য, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে না-জানা টাইপের স্বামী পাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রজ্ঞা তাকে ছাড়বে না। বালকটিরও মনে মনে ইচ্ছে নতুন একটা বউয়ের। কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস নেই। অন্যদিকে তার স্ত্রী তার ওপর কুদৃষ্টি নিক্ষেপকারিণীদের ঢিসুম ঢিসুম দিয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে চলেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে হেরে গিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে মা মা বলে চিৎকার করে বাড়িতে পালাত। ওদের সংসারের কথা গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। প্রজ্ঞা প্রমাদ গুনল, তার বরকে আটকে রাখতে পারবে তো! ফুলপ্রুফ নীল নকশা বানিয়ে ফেলল। একদিন প্রজ্ঞা ছুটির দিনে ওকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল। সে তো হাজির। প্রজ্ঞা তার সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার করতে থাকল। একটু সন্দেহ যে হল না, তা নয়। সে চিরটাকাল ভালবাসার কাঙাল, ভালবাসা তার দুর্বলতা। তার হাত ধরে গ্যারেজের দিকে গেল সে। ওখানটায় সচরাচর কেউ যেত না। সেখানে প্রজ্ঞা একটা জরাজীর্ণ ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে তাকে বসতে বলল এবং তার জন্য কাজ করে টাকা উপার্জন করে আনতে বলল। বালকের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। তবুও পুরুষ তো, জান দেব, কিন্তু মান দেব না। তবে ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে, ট্রাক থেকে নেমে আসতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কিছুতেই বেরোতে পারছে না। কান্নাকাটি ও চিৎকার জুড়ে দিল। কিন্তু প্রজ্ঞার মধ্যে কোনও ভাবান্তর নেই। সে একটু দূরে বসে মাটিতে আঁকিবুকি কেটে আপন মনে খেলছে। বালকটি ওকে বলল কাউকে ডেকে আনতে, উদ্ধার করতে। কিন্তু ও যা বলল, তাতে বালকটির কান্না থেমে গেল, রক্ত হিম হয়ে গেল।
-আমি তোমাকে ইচ্ছে করেই এখানে এনেছি। সাপের কামড়ে তোমার মৃত্যু অপেক্ষা করছে। তোমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না। তার প্রিয়তম স্বামী অন্য কাউকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করবে তা যেন ওকে দেখতে না হয়, তাই সে এই চরম উপায় ভেবে বের করেছে!
কী সাঙ্ঘাতিক! দীর্ঘ অপেক্ষা করেও যখন কিছু হল না, তখন ও বালককে একা ফেলে বাড়িতে চলে গেল। এদিকে তাকে খুঁজে না পেয়ে সবাই চিন্তা করছে। প্রজ্ঞাকে জিজ্ঞেস করলেও সে বলে দেয়, জানে না। ভীষণ ভয় করছে বালকটির। খিদেও পেয়েছে। এই অবস্থায় অন্ধকার নেমে এলে সত্যিই রক্ষা নেই। জোরে জোরে ভগবানকে ডাকছে। পরে অবশ্য বিকেলের দিকে গ্যারেজে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে তাকে উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনার পর প্রজ্ঞাকেও আর ওদের সঙ্গে খেলতে দেওয়া হয়নি। ওর হাতে বালকটি পিতৃপ্রদত্ত প্রাণ আর একটু হলে খোয়াচ্ছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ওর সময় লাগে অনেক। মূলত ওই সময় থেকেই মেয়েদের একটু ভয় পেতে শুরু করে। বুঝতে পারে ওরা হাসিমুখে মানুষ খুন করতে পারে। যদিও পরে ওদের ধারালো নখ ও সুতীক্ষ্ণ তরবারির মতো ধারালো জিভ, যা হৃদয়ের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত চোখের নিমেষে ফালা ফালা করে দিতে পারে, তার সন্ধান পেয়েছিল।
ছেলেটা বালক থেকে তরুণ হচ্ছে। ফের বাবার বদলি। এবার কলকাতা। ওদের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে রাখা ছিল। সে সব তুলে নিজেরা স্থিত হল। কিন্তু কন্যা প্রজাতির ওপর প্রবল ভয় তাকে ওদের ত্রিসীমানায় যেতে বাধা দিত। কিন্তু ঠোঁটের ওপর সদ্য জন্ম নিয়েছে গুম্ফরাশি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে বক্ষপিঞ্জরের অন্তস্থলে একাকীত্বের হু হু বাতাসের শব্দ শুনতে পেত আর মনে মনে একটি সুকোমল লাবণ্যমাখা মুখের সুখচিন্তায় নিজেকে বিলীন করত সেই তরুণ। কিন্তু এলাকার হার্টথ্রব লিপি আর শিল্পীর বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে কখনই মুখ ফুটে বলতে পারেনি, তোমাদের দুই বোনকেই আমার খুব পছন্দ। যদিও তার দুজনের পাঠানো নানা উপহার আর চোখের ভাষার অর্থ সে বুঝেছিল। কিন্তু সেই আমন্ত্রণের উত্তর দিতে পারেনি কখনও। এমনি করেই প্রায় বছরখানেক কেটে গেল। আবার বাবার বদলি। এবার উত্তর দিনাজপুরে। সেই বালক তখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। লিপি, শিল্পীর কাল্পনিক বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দ্রুত দিনাজপুর রওনা হতে হল। মাস কেটে যায়। তার প্রেম আর হয় না। রায়গঞ্জ গার্লস স্কুলের সামনে নিয়মিত মহড়া দিয়েও প্রেম করার উপযুক্ত কোনও কন্যার মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হল। ঠিক এই সময় তাকে উদ্ধার করে রিনা নামে এক অচেনা রমণী। কী করে যেন ওদের বাড়ির নম্বর জোগাড় করেছিল। রাত বিরেতে ফোন করত। সেও ওর সঙ্গে কথা বলে বড়ই আমোদিত হত। কিন্তু বিধি বাম। অফিসের কাজে বাবা শহরের বাইরে গিয়েছিল। গাড়িটা আচমকা খারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে বারবার ফোন করেও নম্বর ব্যস্ত পেয়ে বাবার মাথায় আগুন জ্বলছিল। অন্য গাড়িতে বাড়ি ফিরে এক আছাড়ে টেলিফোন সেটটির দফারফা করে তরুণের ওপর ফতোয়া জারি করে দিল,
-এই মুহূর্ত থেকে তোমার টেলিফোনে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করা বন্ধ।
ভগ্ন হৃদয়ে কিছুকাল প্রেমবিহীন সময় কাটাল। একদিন বোনের পুতুল বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে ওর বান্ধবীরা এল। প্রচুর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। তরুণ নিজের ঘরে বসে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিল। মার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঘরের অন্যদিক থেকে আসা এক অসচেতন কন্যা তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ওকে ঠেলে সরাতে গিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সে জমে গেল। আহা, এ আমি কী দেখলাম! প্রভাতের পদ্মফুলের ন্যায় স্নিগ্ধ মুখখানি যেন হীরকের দ্যুতি ছড়াচ্ছে, চঞ্চলা হরিণী চোখের অতল গভীরতা আর লজ্জায় আরক্ত মুখমণ্ডল তরুণকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পৃথিবী থেকে শূন্যে নিক্ষেপ করল। সম্বিত ফিরল যখন সমবেত কন্ঠে হাসির শব্দ কানে এল। বোন আর ওর বান্ধবীকুল রিঙ্কুকে তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়তে দেখে বড়ই আমোদ পেয়েছে বুঝল। পরে সবাই চলে যেতে বোনকে জিজ্ঞেস করল মেয়েটির কথা। সে বলল, ওই শ্যামাঙ্গী সুদর্শনা তার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ছে আর বোনের প্রিয় বান্ধবীর বড় বোন। এর পর থেকে বোনকে মাঝে মাঝেই খোঁচাত রিঙ্কুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য। বোন যখন ওদের বাড়ি যায়, সে তখন বাইকে নামিয়ে দিয়ে আসে। একদিন ফিরে আসবে, দেখল রাস্তার পাশের জানলা দিয়ে রিঙ্কু তাকে দেখছে। ফিরে গিয়ে ওর দিকে হাত নাড়ল। ও হাসিমুখে হাত নাড়ে।
কিছুদিন পর টিউশন পড়ে বাড়িতে ফিরে কাউকে দেখতে পেল না। দেখল টেবিলের ওপর সাদা একটা কাগজ। মা লিখে রেখে গেছে, সে যেন দ্রুত দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে পৌঁছে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেল। সে জানত না যে, সেখানে তার জন্য কী চমক অপেক্ষা করছে। দিঘির একধার থেকে অন্য ধারে সন্তরনরত রাজহংসীর মতো ধবধবে সাদা ড্রেসে রিঙ্কুকে আবিষ্কার করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। কাছে গিয়ে দেখল মা, বোন সবাই পিকনিক করতে এসেছে। বোনের বান্ধবীরাও আছে। সেই কারণেই এত আয়োজন। সে যেতেই টিফিন এগিয়ে দিল রিঙ্কু। ওকে তার বাইকে চাপানোর এই সুযোগ। ওকে বলামাত্রই লজ্জায় আরক্ত হল রিঙ্কু, মুখে না বলল না, কিন্তু বাইকে বসতে সঙ্কোচ করতে থাকল। মা দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলল,
-যাও মা, ঘুরে এসো।
মা চলে যেতে রিঙ্কু বাইকে উঠে বসল। ওরা বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা বড় গাছের নীচে ছায়ায় দাঁড়াল। গল্প করতে থাকল। কিছুক্ষণ পর রিঙ্কুর হাতে একগোছা ঘাসফুল তুলে দিতেই সে বলল,
-প্রথমবারেই ঘাসফুল দিলে?
-আগামিকাল সকালের মধ্যে একশো একটা লাল গোলাপ দেব।
তা সে দিয়েওছিল। কয়েক মাস পর ওই বাড়ি ছেড়ে তাদের অনেকটা দূরে চলে যেতে হয়। রিঙ্কু-পর্বের সেখানেই অকাল পরিসমাপ্তি। ভালবাসা কী, তা রিঙ্কু ওকে তেমনভাবে বোঝাতে পারেনি, যা তরুণটি নন্দিতার প্রেমে পড়ে বুঝেছিল।
একদিন মা চলে এল হস্টেলে।
-রেডি হয়ে নে। শিলিগুড়ি যেতে হবে। তোর জেঠু খুব অসুস্থ।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরোল তরুণ। দেখে বাবার অফিসের বিশাল সাদা ল্যান্ড রোভারটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
-এটা কেন, মা?
-সঙ্গে আরও কয়েকজন যাবেন। ওদের বালুরঘাট স্টেশনে ড্রপ করে দিতে হবে। তাই বড় গাড়িটা আনতে হয়েছে।
বাধ্য হয়েই তার অত্যন্ত অপছন্দের গাড়িটাতেই উঠে বসতে হল। খানিক পরে একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। দেখল এক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা এবং দুটি মেয়ে বেরিয়ে এল। কন্যাদ্বয়ের বড়টিকে হাইস্কুল পড়ুয়া মনে হলেও ছোটটি কোনওভাবেই ক্লাস থ্রি বা ফোরের ওপরে পড়ে না। ওরা এসে বাক্স প্যাঁটরা গাড়িতে তুলতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ ডিরেক্ট মধ্যগগনে সূর্যদেবের অনুভূতিতে বেওকুব হয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল, ওদের বাড়ি থেকে এক অপরূপা তরুণী বেরিয়ে এল এবং দৃঢ় পায়ে সোজা গাড়িতে এসে বসল। তরুণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। ভাবল, ভগবান অনেক সময় নিয়ে যত্নে এই নারীকে গড়েছেন। কোত্থাও একটুও খুঁত নেই। কী বোকা বোকা কথা বলছে, সবটা দেখেছে নাকি! মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরল। গাড়িতে লোক একজন বেশি হয়ে গেছে। তবে কাউকেই ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না। কাজেই ঠিক হল, ড্রাইভার থেকে যাবে, গাড়ি তরুণই চালিয়ে নিয়ে যাবে। সেই মেয়েটিকে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসতে দেখে আনন্দে আপ্লুত হল সে। যদিও সে এই বেয়াড়া গাড়িটাকে চালাতে কখনই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তবে আজ এটাই তার সবচেয়ে প্রিয় গাড়িতে পরিণত হল। ড্রাইভিং সিটে বসে রিয়ারভিউ মিররে কন্যার পরিবারের অস্বস্তি উপলব্ধি করতে পারল। এই পুঁচকে ছোড়া গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে তো! অনেকেরই সন্দেহ হচ্ছে, বুঝতে পারল। মাথায় শয়তানি খেলে গেল, আজ ওদের একটু ভয় দেখাতে হবে। শীতের ওই শান্ত সকালে সে তীরবেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিল। বেয়াড়া ল্যান্ড রোভারটা সেদিন কী করে যেন তার হাতে পঙ্খীরাজ হয়ে উঠল। যতই আঁকাবাঁকা করে চালাতে যায়, গাড়ি সোজাই চলে। বারবার তার দৃষ্টি সাইডভিউ মিররে আটকে যাচ্ছে। ছোট্ট আয়নাটি জুড়ে গোলাপি একখানি মুখ বারবার তার মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। তরুণীর চোখ মুখ থেকেও ভয়ের চিহ্ন বিদায় নিয়ে প্রশান্তির ছায়া পড়ল। মাঝে মাঝেই সাইডভিউ মিররে ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ ওর চোখে স্পষ্ট শাসনের ছায়া দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেল তরুণ। শান্ত দিঘির মতো চোখ জোড়া যেন ডেকে বলল, ‘ওই ব্যাটা, সামনে দেখে গাড়ি চালা, তোর পিছনে দশ মাইলের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই’। ভয়ে গাড়ি চালানোর দিকে মন দিল সে। কিছুক্ষণ পরে আয়নায় তাকিয়ে সেই চোখে উপচে পড়া কৌতুক দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠল।
সব কাজ মিটলে ওরা শিলিগুড়ি থেকে ফিরে এল। তরুণ যেন দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা ওই তরুণীকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। একদিন বোনকে মনের কথা খুলে বলল। কিন্ত প্রেমে আর পড়া হয় না। নন্দিতা তখন সদ্য সদ্য বালুরঘাট কলেজে ভর্তি হয়েছে। রোজ সকালে সে বান্ধবীর সঙ্গে হেঁটে কলেজ যায়। একদিন সকালে দূত মারফত তার হাতে তরুণের লেখা প্রেমপত্র পৌঁছে গেল। চিঠিতে একটাই লাইন লেখা, ‘ভালবাসি তোমাকে’। সে তো পরদিন থেকে কলেজ যাওয়ার সময় তাকে খুঁজত, কিন্তু সে ওর ত্রিসীমানায় যাওয়ার সাহস করত না। একদিন দূতকে রাস্তায় ধরে চিঠির মালিকের পরিচয় জেনে নেয় নন্দিতা। এর দুদিন পর স্কুল থেকে ফিরে তরুণের বোন তার হাতে একটা বই তুলে দেয়। জিজ্ঞেস করতে বলে,
-একজন দিয়েছে।
-কে সে? আমি তো উল্টে পাল্টেও বইয়ের মধ্যে কিছু খুঁজে পেলাম না।
মুহূর্তে প্রশান্তিতে মন ভরে গেল। অনেক সাধ্য সাধনা করে আরেকটা চিঠি লিখে বোনের হাতে দিয়ে বলল, যে ওকে বই দিয়েছিল তার হাতে দিতে। এইভাবে ওদের পত্রপ্রেম এক মাসের বেশি চলল। কিন্তু দেখা সাক্ষাতের কোনও উপায় খুঁজে পেল না। এমনি সময় বাবা ফের বাড়ি বদল করে এমন জায়গায় বাড়ি নিল, যেখানে নন্দিতার এক বান্ধবীর বাড়ি। বান্ধবীর বাড়ি আসত নন্দিতা। তার সঙ্গে রাস্তায় একদিন দেখা হয়ে গেল দুজনের। তরুণ তার বাড়িতে আসতে বলল। প্রথম দিনেই মাকে দেখে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে পায়ে ঝাঁপিয়ে প্রণাম করল। মাও তাকে বুকে টেনে নেয়। নন্দিতা তার প্রেমিকার চেয়ে বন্ধুই ছিল বেশি।
যতক্ষণ একসঙ্গে থাকত, ওরা একে অপরকে খেপানোতেই বেশি মনোযোগী থাকত। তবে শর্ত ছিল, প্রতিদিন ভালবাসায় পরিপূর্ণ একটা করে চিঠি ওর হাতে পৌঁছে দিতে হবে। প্রায় এক বছর এইভাবে চলল। ওর বাবারও বদলির চাকরি। একদিন তারা মালদায় চলে গেল। তরুণের প্রেমপর্বও স্থগিত হয়ে গেল। পরে সে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তিন বছর পরে আবার তাদের প্রেমের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। সেই সময় নন্দিতা মাঝে মাঝেই ওদের ইউনিভার্সিটিতে আসত এবং তরুণের হাত ধরে হেঁটে বেড়াত। সবাইকে ও জানিয়ে দিতে চাইত, ও ছাড়া তরুণের আর কোনও প্রেমিকা হতে পারে না। এই অবস্থায় দু’বাড়ির বড়রা প্রাথমিক কথা বলে ফেলেন। ঠিক হয়, তরুণের অনার্স শেষ হলে ওদের বিয়ে হবে। কিন্তু ওর বেরসিক বাবা ভাল সরকারি চাকুরে পাত্র পেয়ে ওর আশীর্বাদ করিয়ে দিলেন। প্রায় পাঁচ পাতার একটা চিঠি লিখে তরুণকে পাঠায় নন্দিতা। সব কথা লেখে। সে বুঝতে পারে ওর কিচ্ছু করার ছিল না। সব শুনে বাবা বলল,
-আমার অনির এমনভাবে বিয়ে দেব যে, দুনিয়া দেখবে।
তার পরেও তরুণের জীবনে একাধিক নারী আসে। রুম্পা, পিউ, সায়নী, সায়ন্তী, তানিয়া, অর্পিতা, স্বর্ণালী। কিন্তু কাউকেই বিয়ে করেনি সে। আসলে ওই তরুণ যে বিশ্বপ্রেমিক। বিয়ে, সংসারে বাঁধা পড়ার নয়।
Comments
Post a Comment