তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

আড্ডা নিয়ে যত কথা | শুভময় সরকার | পর্ব ২ | ফিচার ২

বসন্তের সেই মাতাল সমীরণে : 'সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা…' লাইনগুলো আমাদের মুখে মুখে ফিরেছে অনেক পরে কিন্তু তার অনেকটা আগেই তিস্তাপাড়ের এক শহরে আমাদেরও এক দিন ছিল আর সে'সব দিনজুড়ে ছিল বিস্তর গল্প। শহর জলপাইগুড়িকে আমরা আদর করে ডাকতাম 'জলশহর', সে ডাক আজও রয়ে গেছে। সে জলশহর তো নিজেই এক গল্প আর সেইসব গল্পের পশ্চাৎভূমিতে রয়েছে সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে জলপাইগুড়ির ছিল এক নিবিড় যোগাযোগ, কৈশোরের দিনগুলো থেকেই। আমার জন্মের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল যদিও আমি সেই প্রিয় শহরে এসেছিলাম যৌবনের দোড়গোড়ায় আর দেরিতে হলেও অনুভব করেছিলাম এই 'জলশহর'-এর আপাত বিবর্ণ চেহারার আড়ালে অন্য এক নেশা রয়েছে, সেই নেশাতেই জাস্ট ভালোবেসে ফেলা যায় শহরটাকে। 

অন্যশহর থেকে জলপাইগুড়িতে এসে এ শহরের আড্ডাপ্রবণতার আঁচ অচিরেই পেলাম। শহরের মানুষগুলো অদ্ভুত রকমের মজলিশি মেজাজের। নতুন জায়গায় আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল বন্ধুর সংখ্যা, চিনতে শুরু করলাম শহরের বিখ্যাত এবং কুখ্যাত 'ঠেক'গুলো। এমনই এক ঠেকের নাম 'কে.সি.দাসের আড্ডা'।  কে. সি দাসের মিষ্টির দোকানের নামেই এই ঠেক চলে। তবে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা জরুরি, এই কে.সি দাস কলকাতার বিখ্যাত কে.সি দাস নয়, তবে এও এক বিশাল মিষ্টির প্রতিষ্ঠান। চমৎকার মিষ্টি। দোকানের বাইরের দিকে একটা অংশে লোহার সাটার নামানো অজানা কারণে। সম্ভবত বিল্ডিং পরিকল্পনায় অন্য ভাবনা ছিল। তো সেই বন্ধ সাটারের সামনেই অনেকটা জায়গাজুড়ে ছিল আমাদের ঠেক। রোনাল্ড রেগন হইতে কপিলদেব; সত্যজিৎ রায় থেকে মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক হয়ে সেদিনের বঙ্গজীবনের নয়া অবতার মিঠুন চকোত্তি, ইস্টবেঙ্গল -মোহনবাগান, শারজার ক্রিকেট কী নেই সেই আলোচনায়। কে.সি দাসের ঠেকেই আমরা প্রায় বিশ্বনিয়ন্ত্রক এবং অনিবার্যভাবেই বিশ্লেষক। 

তো তেমনই এক আড্ডাবেলার এক সন্ধেতে কে.সি দাশের মূল ঠেক থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম আমি আর আমার হস্টেলমেট জয় মানে জয়দীপ দাস। হস্টেল ছেড়ে ফাইনাল ইয়ারে আমি আর জয় আলাদা দু'কামরার একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছিলাম শহরেরই অন্য এক অঞ্চল মোহন্ত পাড়ায়। সেদিন ছিল দোলের সন্ধে। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম তার সামনে এক চমৎকার উঠোন আর সে রাতে উঠোনজুড়ে জ্যোৎস্না-প্লাবন। রাত বাড়ে। চারপাশ আরও নিঃঝুম, আমরা তখন ঝাপাচ্ছি ( ঝাঁপাচ্ছি না)। এই 'ঝাপানো' শব্দটির এক ভিন্ন অভিঘাত আছে হস্টেলজীবনের সঙ্গে,অনুষঙ্গে। গঞ্জিকা আমাদের পরিভাষায় 'ঝাপসি' আর গঞ্জিকাসেবন 'ঝাপানো'...! তো সেই দোল পূর্ণিমার রাতে আমি, জয়, নষ্ট চাঁদ আর 'ঝাপসি'র এক অদ্ভুত আড্ডা জমেছিল। চাঁদের নীচ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল হালকা মেঘের নির্বিষ টুকরোগুলো, আমরা গল্পে, কথায়, নেশায় ফিরে যাচ্ছিলাম অতীতে কিংবা ভবিষ্যতে, শুধুমাত্র ছিলাম না বর্তমানে। 'রাত কত হইলো ' তার উত্তর মেলে না, রাত বাড়ে, আমরা আরও চন্দ্রাহত হই, ফিরে আসে জয়ের তিনসুকিয়া, লিডো আর আমার হিলসাইডের শৈশব-কৈশোরমাখা দিন। রাত বাড়ে, আমরা উঠি, ঘরে ঢুকি না, হাঁটতে থাকি মার্চেন্ট রোডের দিকে আরও এক নষ্ট রাত কাটাব বলে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে তখন তুমুল শোরগোল। জন মেসফিল্ডের সেই 'সী ফিভার' কবিতার নাবিক যেভাবে সমুদ্রের টানে বেরিয়ে পড়তো ঘোরের মধ্যে, আমরাও এক ঘোরের মধ্যে হাঁটতে থাকি, আর আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে পূর্ণিমার চাঁদ…! তারপর আর মনে নেই, শুধু পরদিন ঘুম ভেঙে দেখেছিলাম আমরা নিজেদের বিছানায় শুয়ে আছি, কীভাবে ফিরেছিলাম জানি না…! আমার আড্ডাবেলার সে এক অদ্ভুত নেশাতুর সময়, নেশাতুর রাত যার শুরু ছিল,শেষ ছিল না। পথের শেষ কোথায় জানা ছিলনা। সেই অনন্ত পথ চলায় হয়তো আজও আছি। 


Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.