যন্ত্রকবলিত যাপনে মূল্যবোধের অবক্ষয় | শৌমিক চক্রবর্তী | প্রবন্ধ ১
পূর্ব আকাশের সীমানায় যখন সূর্য ওঠে, তার রশ্মি ছড়িয়ে যায় যেমন পশ্চিমেরই তটে! তেমনি সমাজ নামক মহাকাশের মাঝে নীহারিকা হয়ে অবস্থান করছে মানুষ, যে নীহারিকা জন্ম দেয় হাজার হাজার নক্ষত্ররাশির, জন্ম নেয় আগামীর সমাজ সচলতার শিক্ষা, বিদ্যা, মূল্যবোধ, মানবতা, বিনয় নামক এককগুলো। প্রকৃতির বুকে শরতের ছোঁয়া মনের কোথাও শিহরণ তুললেও একটা আশঙ্কা ছেয়ে যায় মনের আকাশে।মহান দার্শনিক শিক্ষক ড: সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর উক্তিটি খুব মনে পড়ছে― "আমরা যেন যন্ত্রের ভিতরে স্ক্রু, পেরেকে পরিণত না হইয়া যন্ত্রকেই মানুষের দাসরূপে ব্যবহার করিতে পারি।" এই উক্তিটি বর্তমান যন্ত্রজীবনে আসক্ত আধুনিক বিজ্ঞানে বলীয়ান শিল্পাশ্রয়ী সভ্যতার সমৃদ্ধতর যাপনে কিন্তু এক বিশাল বার্তা।আমাদের এগিয়েচলা জীবনে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জীনের মতো মানুষসৃষ্ট যন্ত্র সমাজের, আমাদের ব্যক্তিগত সব কাজ অক্লেশে সাধন করলেও যন্ত্রকবলিত জীবনে শিক্ষাদান ও গ্রহণের মাঝে ঘটিয়ে দিলো আমূল পরিবর্তন। বৈদিক যুগের সামগানে মুখরিত তপোবন প্রাঙ্গণ আজ আর নেই,যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনিবার্য ভাবেই পরিবর্তন ঘটে গেলো একান্নবর্তী পরিবারের, আমাদের আচার ব্যবহারের, আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর, জাগতিক ও আধ্যাত্মিক বোধের। প্রগতিশীল আমরাই সংস্কারাচ্ছন্ন জীবনের গণ্ডী অতিক্রম করে আজ এক বৃহত্তর জগতের মুখোমুখি, কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে ভাবগত সংহতি― 'Emotional Integration'। যে ভাবাবেগে সবার ভেসে যাওয়া উচিত! সে স্রোত আজ উল্টোমুখী। বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলোর গতি ও শক্তি আমাদের সমৃদ্ধি দিলেও কেড়ে নিচ্ছে আবেগ, মমতা, দায়বদ্ধতা, সততা, সমানুভুতি নামক বিভিন্ন এককগুলোকে।শিক্ষা হোলো সভ্যতার বিভিন্ন যুগের সেতু, সাদা কাগজের কারাগারে কালো কালো অক্ষরগুলোর মিলিত মহাশব্দগুলো কোনো বন্দীত্ব নয়, আমাদের মানবহৃদয়ে মুক্তির কল্লোল তুলে সুখে দুঃখে দেবে স্বান্তনা, দেবে আনন্দ, তৈরী করবে সকলের মাঝে এক বন্ধন। শিক্ষালাভের মূল উদ্দেশ্য একজন সৃজনশীল পূর্ণ মানুষ হওয়া― যে হবে সমাজের উপযুক্ত নাগরিক, পুঁথিগত শিক্ষায় উন্নত হয়ে গণমুখী, সমাজ সচেতন মূল্যবোধে উত্তীর্ণ। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রোজনামচায় নিঃস্বার্থ ভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেবার মানসিকতা লক্ষিত হচ্ছেনা। মানছি, কর্পোরেট জগতের অঙ্গুলিহেলনে আমাদের যাপনের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ছিলই কিন্তু সেটা যন্ত্রের দানবীয়তাকে ব্যবহার করে নয়― মানবতার ফেনিল উচ্ছ্বাসে সমাজ কল্যানকারী জীবনের মোহনায় মিশে যাওয়ায়।প্রযুক্তি নির্ভর যাপনে অন্তরের অন্তঃস্থলে থাকা সচেতনতা দিয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী ক্রিয়াকলাপ এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দেশহিতে জনহিতে, পবিত্র কল্যাণকর সাধনায় আত্মদীপ ভবঃ গেয়ে উঠলে শিক্ষা ইতিবাচক হবে এবং উন্নত সুস্থ মূল্যবোধের পটভূমিতে এক নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।
Comments
Post a Comment