সুচেতনা | প্রসেনজিৎ ঘোষ | অণুগল্প ৬
ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তীর্থঙ্কর অমিতবাবুকে বললেন দুবেলা নিয়মিত এই ওষুধগুলো খাবেন। আমি বাবু বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। বেতন ৩৭০০০ টাকা । সেখান থেকেই তার একমাত্র মেয়ে সুচেতনা পড়াশোনার খরচ আমিতবাবু। সুচেতনার ইচ্ছে বড় হয় সে পুলিশ অফিসার হবে। তাকে দেখে কাপবে গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। অমিতবাবুর চাকরি থাকাকালী একটি কিডনি নষ্ট হয়ে যায় এবং চাকরি চলতে চলতে একটি কিডনি নষ্টের পথে দিকে। সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ বার তীর্থঙ্কর কে অমিতবাবুর বাড়িতে আসতে হয়। হঠাৎ একদিন তীর্থঙ্কর কে ডেকে অমিতবাবু বলে― "বলছি, তীর্থ তুমি নিজেও বুঝতে পারছ আমি আর খুব বেশিদিন এ জগতে থাকবো না। তুমি ছাড়া আমার মেয়েটার আর কেউ নেই। তীর্থঙ্করের হাত ধরে বলে আমার মেয়েটার স্বপ্নপূরণ এর দায়িত্ব তুমি নিও।"
ঘটনাচক্রে এর ঠিক সপ্তাহখানেক বাদে অমিতবাবুর স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা দেবীর ভোর রাতে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়। স্ত্রী বিয়োগে অমিতবাবু ও মাতৃহারা সুচেতনা দিশেহারা হয়ে পড়ে। সুচেতনার পাশে এসে দাঁড়ায় তীর্থঙ্কর। ভরসা, সাহস, মনোবল সবটাই সে জোগায়। দিনটি ছিল ৭ জুলাই দুপুর ১২ঃ১৫ নাগাদ অমিত বাবু ছেড়ে চলে যায়। স্ত্রী বিয়োগের একমাসের মাথায় অমিতবাবুর মৃত্যু হয়। এরপর তীর্থঙ্কর সমাজকে উপেক্ষা করে সুচেতনাকে নিয়ে আসে নিজের বাড়িতে। সুচেতনা তীর্থঙ্করকে দাদার দৃষ্টিতে দেখতো ফলে তার কোন কথাই সে অগ্রাহ্য করতে পারত না। অমিত বাবুর মৃত্যুর একবছর ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এই এক বছরে তীর্থঙ্করের মা কমলিনী দেবীর সাথে সুচেতনার বেশ মিল হয়ে উঠেছে সে যেন মাতৃবিয়োগের পর মাকে খুঁজে পেয়েছে। প্রতিদিনের পড়া শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে সুচেতনার ঘরে এসে তীর্থঙ্কর সুচেতনার সাথে কথা বলে সে ও সুচেতনা দুজনে একসাথে খাবার ঘরে আসবে। দিনটা ছিল রবিবার। সেদিন কিছুতেই সুচেতনার পড়ায় মন বসছিল না। সে ঘরের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছিল। এ দেখে তীর্থঙ্কর ঘরে ঢুকেই বলে― "বলছিলাম কি সুচেতনা তোমার কি কিছু হয়েছে? শরীর ঠিক আছে? না মানে অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি তুমি ঘরের মধ্যে একা একাই ঘুরপাক খাচ্ছ। কিছু হলে আমায় তুমি বলতে পারো। তীর্থঙ্করের উপস্থিতি দেখে হঠাৎ করেই চমকে ওঠে সুচেতনা।
― ও তুমি! না শরীর ঠিক আছে।
― বলছিলাম সকালে কি বলবে বলছিলে তুমি।তখন ব্যস্ততায় শোনা হয়ে ওঠেনি। বলে ফেলো এখন তবে।
― বলছিলাম কী!বলছিলাম কী! বলছিলাম কী!
― কী তখন থেকে বলছিলাম কী !বলছিলাম কী! বলে যাচ্ছিস। কিছু লাগবে? বিরিয়ানি খাবে? নাকি ঘুরতে যাওয়ার মতলব মাঝরাতে? বলো
―না
―তাহলে?
সুচেতনার কোন আবদারই ফেলতে পারেনা তীর্থঙ্কর। তীর্থঙ্কর ভাবে সে ছাড়া এ পৃথিবীতে সচেতনার আত্মীয় বলে তো কেউ নেই। এবার সুচেতনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে।
― তীর্থ দা তোমাকে অনেকদিন ধরেই একটা কথা বলবো, সেটা বলা হয়ে উঠছে না। ভেবেছিলাম আজ সকালে বলবোই ঘটনাচক্রে তোমার ব্যস্ততার কারণে বলা হয়ে ওঠেনি।
― বলে ফেলো কি বলবে।
― বলছি আমার সহপাঠী টুম্পাকে তো তুমি চেনোই।
― আরে হ্যাঁ। সত্যি বলতে মেয়েটা কিন্তু খুব মেধাবী। গানটাও বেশ ভালো গায়।
― বলছিলাম আমার টুম্পাকে খুব পছন্দ।
― হ্যাঁ তো কি হয়েছে বান্ধবীর বান্ধবীকে পছন্দ হতেই পারে এটাই তো স্বাভাবিক।
― এ পছন্দ সে পছন্দ নয় তীর্থ দা। আমি টুম্পাকে ভালোবাসি, সারাজীবন ওর সাথেই আমি কাটাতে চাই।
― কাকে?
― টুম্পাকে
টুম্পা আর সুচেতনা ছোটবেলা থেকেই এক স্কুলে পড়তো। এক কলেজ , এক বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সুচেতনার মতো টুম্পা দাপটে নয় সে লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। খুব ভালো গান গায় টুম্পা। আবৃত্তিটাও বেশ ভালো করে। স্কুলজীবনে সুচেতনার অনুরোধে জীবনানন্দের 'সুচেতনা' কবিতাটি আবৃত্তি করেছিল টুম্পা সে থেকেই তাদের সম্পর্কের সূত্রপাত। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। তীর্থঙ্কর মন দিয়ে সুচেতনার সবকটি কথা শোনে। তারপর নিজের ঘরে চলে যায়। ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ে নিজের বিছানায়। তাদের সব দিনের মতো ক্লান্তি আজ তার চোখকে গ্রাস করতে পারেনি।
Comments
Post a Comment