সোনালী রুটি | দেবদত্তা বিশ্বাস | গল্প ১১
শহর আর শহুরে জীবন। আকাশ ছোঁয়া ইমারতের ফাঁকে আটকে পড়া সূর্যের আলো আঁধারি খেলায় দিনের বেলাটাও ঘোলাটে লাগে কখনও। আবার যখন রাতের বেলা নিয়নের চপল খেলা নেশা ধরায় শহরের শিরায় শিরায় তখন অজস্র কোলাহলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু নিশ্চুপ গল্প একলা অভিমানী।
প্রতিটা গোছানো পরিপাটি শহরের ধার ঘেঁষে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে কিছু অগোছালো শ্রীহীন খোলস ছাড়ানো একটা বস্তি, শহরের বনসাই যেন। সেখানে খাঁজে খাঁজে প্রতি বাঁকে থাকে শহরের কিছু গোপন জবানবন্দী। চকচকে শহুরে জীবন এখানে বেআব্রু করে নিজেকে। বেরিয়ে আসে শহরের কঙ্কালটা।
কলাবাড়ি বস্তি পাঁচমুড়া শহরের ঠিক মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা নীলাপানি নদীটার দুপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। টিন ঘেরা ছোট ছোট ঘুপচি ঘর যেখানে শেষ বলে মনে হয় দেখা যায় ঠিক তারই পিছে দুফিটের রাস্তা ঠেলে আরো একটা অপক্ত ঘর উঁকি দিচ্ছে একটা আস্ত পরিবার সমেত। সরু নালার জমা জলের দুর্গন্ধ সরাসরি গিয়ে নীলাপানিতে মেশে। এই বস্তির পাঁচ নম্বর গলির ছয় নম্বর বাড়িটাতে খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে হামিদুলকে। পাওয়া যেতে পারে বলার কারণ একটা আট ফিট বাই আট ফিটের ঘুপচি ঘরে খাটিয়া পাতার পরে যতটুকু জায়গা থাকে তাতে একটা গ্যাস স্টোভ , রান্নার আসবাব দু'চারটে ঝোলানো জামা কাপড় আর আব্বার ওষুধের কৌটাতেই ভর্তি। পা রাখবার জায়গা খুব কম। হামিদুল সকাল থেকে সন্ধ্যাটা এদিক ওদিক ঘুরেই কাটায় বেশি। কখনো গিয়ে বসে নীলাপানির ধারে। ওরই মতো আরো দু চারটে ছেলে মেয়ে যখন ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো বেঁধে মাছ ধরা প্র্যাকটিস করে নদীর জলে ও তখন নিজের মুখের ছায়া খোঁজে সেখানে। আব্বা বলে অনেক আগে নাকী নদীর নিচ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যেত। তবে আজ শহর আর বস্তির জঞ্জাল মিলেমিশে একাকার স্রোতের প্রতি খাঁজে।
'ও হামিদুল রে! কই গেলি বেটা?' হামিদুল বুঝতে পারে এই সময়টাই আব্বাকে ধরে একটা মাঝ কাটা চেয়ারের উপর বসাতে হবে তাকে। প্রায় পঙ্গু আব্বা হেঁটে পায়খানাঘর অব্দি যেতে পারে না। 'যা হামিদুল যা তোর ডাক আইসে গ্যাছে।' পাশ থেকে বলে আমিনার দাদি। হামিদুল ফিরে আসার সময় শুনতে পায় তার মায়ের প্রতি এই বস্তির সামাজিক বিষোদ্গার। 'অসুস্থ বর ছাইড়া কেমন কালিঝুলি মাইখে ঘুইরে বেড়ায় দেখো বউটা। এইটুকু বাচ্চা ছেলেটা ইস্কুল যায়না বনে বাদাড়ে ঘোরে। আহারে!' সত্যিই হামিদুল স্কুল যায় না। ছোট ক্লাসের বইয়ে আঁকা পরিবারের ছবিতে জড়িয়ে থাকা নানা সম্পর্ক আর পাশের পাতায় ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনারের সুন্দর খাবারের ছবি ওর জীবনে বড় বেমানান ঠেকেছিল। মিল পায়নি কিচ্ছু। স্কুলের প্রতি অনীহা তখন থেকেই।
ঘরে থাকা বলতে হামিদুলের ওই রাত টুকুই। আব্বার গোঙানিটা মাঝরাতের দিকে বাড়ে। আম্মু ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে মুখ গোল করে কাটা কোলড্রিংসের পুরানো বোতলটা এগিয়ে দেয় প্রস্রাবের জন্য। কখনো আবার পাশ ফিরে বলে 'মিনসে মরেও না'। হামিদুলের আম্মু জোগালির কাজ করে হেড মিস্ত্রির সাথে। হেড মিস্ত্রিটা কে হামিদুল জানেনা। তবে সেই সাত সকালে বেরিয়ে শহরের আনাচে-কানাচে তৈরি ইমারতের বালু পাথর সিমেন্টে জড়িয়ে থাকে ওর আম্মু। সকালবেলা যেদিন চাপাডাঙ্গার মোড়ের মাথায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও জোগালির কাজ মেলে না সেদিন বিকেলবেলা আম্মু সেজেগুজে বের হয়। শুনেছে বাইক নিয়ে সন্ধ্যার দিকে মোড়ের মাথায় হেড মিস্ত্রি আসে। হয়তো কোনো ফ্ল্যাট বাড়ির অন্দর শয্যার নিয়নের আলোয় ইঁটের উপর ইঁট গাঁথে মা সেদিন। আঁচল বেঁধে নিয়ে আসে ছড়িয়ে দেওয়া নুড়ি পাথর। হামিদুলের সুসজ্জিত মাকে পরীর মত লাগে। সেইসব দিন আব্বার শরীর খারাপ বাড়ে। রাতের দিকে ঘন ঘন প্রস্রাব পায় আর দ্বিগুন গোঙানি বাড়ে। হামিদুল হাফ চোখ খুলে হাফ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে শুধু।
বারো বছরের হামিদুল বয়সে কিশোর হলেও অভিজ্ঞতায় প্রৌঢ়। যদিও কিছু বছর আগে এমনটা ছিল না। আমিনার দাদি বলে ‘একটা সময় ভালবাইসে শাদী করছিল তোর আব্বু আর আম্মু। বস্তির ছোট্ট ঘরটা ছিল চাঁদের আলোয় ভরা।’ হামিদুলের জন্ম বেড়ে ওঠা ছোট ঘরটায় হলেও মনে হতো এখানেই যেন অনন্ত আনন্দের পরিসর। পরিস্থিতি বদলায় আব্বুর এক্সিডেন্টের পর। পঙ্গু আব্বুর বিছানা হয়ে ওঠে সর্বক্ষণের সঙ্গী। আজকাল ঘরে ঢুকলেই হামিদুলের মনে হয় দুপাশের দেওয়াল চাপতে চাপতে ওর গলাটাই চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে দেবে। মাঝে মাঝে গভীর ঘুমে ঘরটা ওর গলা চেপে ধরে। হামিদুল চিৎকার করতে চায় কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। ধীরে ধীরে সকাল হয়ে আসে । আম্মু বিছানা ছেড়ে উঠে কাজে ব্যস্ত হয়। হামিদুল ছেলেবেলার ঈদের দিনগুলো ভাবে। এমনই ভোরবেলা উঠে প্রার্থনার জন্য প্রস্তুতি নিত ওর আম্মু। সারাদিন রান্নাঘর থেকে আসতো ভালো সুবাস। নতুন জামায় ভাসতো সেদিন আতরের গন্ধ।
আজ আবার একটা ঈদ। খুশির রোশনাই ওদের পাড়া জুড়ে। শহরের বড় মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের শব্দ। শহর আজ উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। মনে আনন্দ থাকলেও হামিদুল প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায় না। শুধু মনে মনে একটা ইয়া বড় চালের রুটি কল্পনা করে তার পাতে। আজকাল আম্মুকে একটু সাজতে দেখলেই আব্বা মরা কান্না জুড়ে দেয়। আম্মু আজও ব্যস্ত। ব্যস্ততা অন্যান্য দিনের তুলনায় আরো বেশি । আম্মুকে ভালো জামা কাপড় বের করতে দেখে প্রমাদ গোনে হামিদুল। কানে হাত চাপা দেয়। আজ আর শুনবে না সে আব্বার বীভৎস চিৎকার। কী করবে সে? কী করবে? খুব খুব ক্ষিদা পেয়েছে তার। হাঁড়ি থেকে কটা ভাত নিয়ে জল ঢেলে নুন মেখে এক পাশে গিয়ে বসে হামিদুল। গোগ্রাসে গিলে চলে সবটা। আম্মু পরিপাটি সুসজ্জিত। নতুন শাড়ির একটা একটা আঁচলের প্লিট আজ কেমন ভয় ভয় ধরায় হামিদুলের বুকে। তার বুক ফেটে কান্না পায়। কিন্তু আম্মু ঘর ছেড়ে যায় না। পা বাড়ায় না শহরের দিকে। ব্যাগ থেকে আব্বার জন্য বের করে নতুন জামা আর লুঙ্গি। একটা প্যাকেট এগিয়ে হামিদুলকে দিয়ে বলে 'এই নে নতুন জামা'। হামিদুল অবাক হয়ে দেখে। ওদের ঘরের অন্ধকারটা সোনালী আভায় ভরে যাচ্ছে সেসময়। আম্মু নতুন জামাটা পরিয়ে দিচ্ছে আব্বাকে। আব্বার মুখে হাসি ফুটেছে বহুদিন পর। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে বাইরে ঈদের চাঁদ দেখতে ভিড় জমিয়েছে সব। হামিদুল দেখে ওর পান্তা ভাতের জলে তখন একটা চাঁদের ছায়া। নিয়নের আলো মাখা শহরের মাথা ছাড়িয়ে অনেক অনেক উপরে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া চাঁদ দেখা যায়। এ যেন ইয়া বড় একটা চালের সোনালী রুটি।
Comments
Post a Comment