পুরুলিয়ার ছৌ নাচ | নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত | প্রবন্ধ ২
ছৌ নাচ একপ্রকার ভারতীয় আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য। ছৌ নাচের আদি উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা।উৎপত্তি ও বিকাশের স্থল অনুযায়ী ছৌ নাচের তিনটি উপবর্গ রয়েছে যেমন, পুরুলিয়া ছৌ, সরাইকেল্লা ছৌ ও ময়ূরভঞ্জ ছৌ। সরাইকেল্লা ছৌ -এর উৎপত্তি অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সরাইকেল্লা খরসোয়া জেলার সদর সরাইকেল্লায়। পুরুলিয়া ছৌ-এর উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা এবং ময়ূরভঞ্জ ছৌ-এর উৎপত্তিস্থল ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ জেলায়। এই তিনটি উপবর্গের মধ্যে প্রধান পার্থক্যটি দেখা যায় মুখোশের ব্যবহারে। সরাইকেল্লা ও পুরুলিয়া ছৌ-তে মুখোশ ব্যবহৃত হলেও, ময়ূরভঞ্জ ছৌ-তে হয় না।পুরুলিয়ার ভূমিজ ও কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ-ই ছৌ নাচের ধারক-বাহক। এছাড়াও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ নৃত্যটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যুক্ত। এই নৃত্যের রস হল বীররস। ১৯৫৬ সালের পয়লা নভেম্বর পূর্বতন মানভূম জেলা ভেঙে এর কিছুটা অংশ পুরুলিয়া নামে পশ্চিমবাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এর পরই একটু একটু করে পুরুলিয়ার ছৌ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ছৌ শিল্পীরা সারা বছর ধরে অনুশীলন করে থাকেন। পুরুলিয়া জেলায় শিবের গাজন উপলক্ষে ছৌ নাচের আসর সবস্থানে বসে। তাছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে ছৌ নাচ হয়ে থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে ছৌ নাচ প্রদর্শন হয়৷ ছৌ নাচ বিষয়গতভাবে মহাকাব্যিক। এই নাচে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন উপাখ্যান অভিনয় করে দেখানো হয়। কখনও কখনও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনিও অভিনীত হয়। প্রতিটি দৃশ্যের শুরুতে ঝুমুর গানের মাধ্যমে পালার বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দেয়া হয়। গান শেষ হলে বাদ্যকারেরা বাজনা বাজাতে বাজাতে নাচের পরিবেশ সৃষ্টি করেন। প্রথমে গণেশের বেশধারী নর্তক নাচ শুরু করেন। তারপর অন্যান্য দেবতা, অসুর, পশু ও পাখির বেশধারী নর্তকেরা নাচের আসরে প্রবেশ করেন।ছৌ নাচে মুখে মুখোশ থাকার ফলে দর্শকদের কাছে জিনিস টা খুব আকর্ষণীয় হয়।
১৯৩০-৩২ সালে ছৌ নাচ বিদেশের মাটিতে প্রথম পা রেখেছিল৷ সেটি অবশ্যই পুরুলিয়ার ছৌ নয়৷ সেটি সরাইকেলার ছৌ নৃত্য। ১৯৭২ সালে পুরুলিয়ার ছৌ শিল্পী রা বিদেশ সফর করেন৷ প্রথম পর্যায়ে ইংল্যান্ড, প্যারিস, হল্যান্ড, স্পেন, অস্ট্রলিয়া দেশে সাফল্যের সাথে ছৌ নাচ প্রদর্শিত করেন শিল্পীরা। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারত সরকার ছৌ শিল্পী হিসাবে গম্ভীর সিং মুড়াকে চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার প্রাপক হিসেবে গম্ভীর সিং মুড়ার নাম ঘোষণা করা হয়। চড়িদা গ্রামে তার একটি বৃহৎ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে আজও। ১৯৮৩ -তে বরাবাজারের আদাবনা গ্রামের নেপাল মাহাতো পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হোন। ২০২৪ -এ পুরুলিয়ার চড়িদার ছৌ মুখোশ শিল্পী নেপাল সূত্রধর মরণোত্তর পদ্মশ্রী পাচ্ছেন।
পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডি থানার চড়িদা গ্রামের চল্লিশটি সূত্রধর পরিবার এবং জয়পুর থানার ডুমুরডি গ্রামের পাঁচটি পরিবার ছৌ নাচের মুখোশ তৈরী করেন। এছাড়া পুরুলিয়া মফস্বল থানার গেঙ্গাড়া, ডিমডিহা ও কালীদাসডিহি গ্রামে, পুঞ্চা থানার জামবাদ গ্রামে এবং কেন্দা থানার কোনাপাড়া গ্রামেও এই মুখোশ তৈরী হয়ে থাকে।পুরুলিয়া বিখ্যাত কয়েকজন ছৌ শিল্পীরা হলেন– গম্ভীর সিংহ মুড়া, নেপাল মাহাত,হাড়িরাম সহিস, রাসু সহিস, হেম মাহাতো, শম্ভূনাথ কর্মকার, ভুবন কুমার, দেবীলাল কর্মকার, প্রভূতি। তাছাড়া প্রতিটি ব্লকে ব্লকে বহু সনামধন্য ছৌ শিল্পীরা আছেন। ছৌ মুখোশ শিল্পীও অনেকে আছেন এই জেলায়। যেমন- ধর্মেন্দ্র সূত্রধর, পরিমল দত্ত, ফাল্গুনী সূত্রধর প্রভূতি৷ ছৌ নাচ অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য, অনুশীলনধর্মী, শারীরিক কসরতের নৃত্য। মানভূম তথা পুরুলিয়ার জেলার অবহেলিত দারিদ্রপীড়িত শিল্পীরা অর্থ উপার্জন ও শিল্প কে ভালোবাসার টানে সারাবছর ছোট ছোট দল ভাগ করে ছৌ নৃত্য করে।
ছৌ নাচে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ঢোল, ধামসা, জুড়ি নাগড়া, বাঁশি প্রভূতি ব্যবহৃত হয়। খোলা আকাশের নিচে মাটির উপরেই নাচের আসর বসে। চারিদিকে গোলাকার স্থান ছেড়ে দর্শকরা বসে পড়েন।ছৌ নাচে ঝুমুর গান ব্যবহৃত হয়। তবে বর্তমানে ছৌ নাচে দর্শকদের আরও আকর্ষণীয় করার জন্য কোথাও কোথাও চটুল হিন্দি, বাংলা গানের সুর বাজানো হচ্ছে। ছৌ নাচে ভাষ্যকারের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। মূলত রাত্রি বেলায় ছৌ নাচ দেখতে ভালো লাগে তবে আজকাল দিনের আলোতেও ছৌ নাচ হচ্ছে। বর্তমানে ছৌ নাচের পালায় কন্যাশ্রী, নির্মল বাংলা, একশো দিনে কাজ, পন প্রথা এই সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ছৌ নাচের পোষাক খুব আকর্ষণীয়৷ ছোট থেকে বড়ো সবার মন ছুঁয়ে যায়৷ পুরুলিয়া জেলাতে ছৌ নাচ কে এগিয়ে নিয়ে যেতে, রুচিকর ছৌ নাচ দর্শকদের উপহার দিতে ও ছৌ শিল্পীদের মর্যাদা এবং সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে ছৌ ইউনিয়ন কমিটি তৈরি করা হয়েছে। সরকারি ভাবে মাসিক ভাতা পাচ্ছেন ছৌ শিল্পীরা। প্রত্যেকটি দল নাচ করার সুযোগ পাচ্ছে৷ পুরুলিয়ার নিজস্ব ঐতিহ্য ছৌ নাচ। এই রণনৃত্য মূলতঃ পুরুষপ্রধান। সেই পরিস্থিতিতে অদম্য উদ্দীপনার সাথে মৌসুমি চৌধুরী,সুনিতা মাহাতো ও আরও মহিলারা শুধু নিজের জায়গায় করে নেন নি, অনুপ্রাণিত করেছেন, করছেন জেলার মেয়েদের। ছৌ নাচে পুরুলিয়ার মেয়েরাও বিদেশ সফর করেছে। মেয়েরাই পারে। করে দেখিয়েছে পুরুলিয়া জেলার দুর্গারা।
লোকনৃত্য হিসেবে ছৌ নাচ এখন শুধু ভারত নয়, বিদেশেও একটি পরিচিত নাম ।তবে সময়ের সাথে সাথে ছৌ নাচে পরিবর্তন এসেছে। যে নাচ একসময় খোলা মাঠে হ্যাজাকের আলোয় অনুষ্ঠিত হত, তা আজ প্রদর্শিত হয় সুসজ্জিত নাট্যমঞ্চে।ছৌ নাচের প্রতি পুরুলিয়ার মানুষের আবেগ,ভালবাসা, নাচের প্রতি টান বিন্দুমাত্র কমেনি। শিল্পীরা কোনভাবে কিন্তু ছৌ থেকে দূরে সরে যায়নি বা পিছু হননি। নানা রকম অভাব-অনটন টানাপোড়ন সত্বেও পুরুলিয়াবাসি সর্বদা তাদের ঐতিহ্য এবং অহংকার ছৌকে নিজেদের মধ্যে ধরে রেখেছেন। স্থানীয় ভাষায় তাদের মুখে যে কথাটি প্রায়শই শোনা যায় সেটি হল, “হামরা মরে গেলেও ছৌ নাচ ছাড়বো নাই।" রাজ্য সরকারের লোকপ্রসার প্রকল্পের হাত ধরে ছৌ শিল্পীদের দিন বদলেছে। শুধু বিদেশে বা রাজ্যের বাইরে নয় পুরুলিয়াতেও তারা অনুষ্ঠান পাচ্ছেন। সরকারি ভাতা মিলেছে। ফলে আয় বাড়ছে। তাই আবার নতুন করে বর্তমান প্রজন্মও ছৌ নাচের দিকে ঝুঁকছে।
তথ্যসূত্র : পুরুলিয়া প্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতি গ্রন্থ, গুগল, নিজের চোখে দেখা।
Comments
Post a Comment