উগুলদানি | শিপ্রা পাল | গল্প ১৩
উগুলদানিটি দে লিলি, হাপানীর রোগী লিলির বাবা এই বলে অতি আড়ষ্টতায় উঠোনের একটি ভাঙাচোরা চেয়ারে রোদ পোহানোর জন্যে বসলেন। মাটির ঘর, দোচালা খড়ের ছাউনি-দেয়া লিলিদের এই বাড়ির আশপাশ প্রায় পঁয়ত্রিশ-ঘর নাপিত পরিবারের বসবাস। ঘরের ভেতর উগুলদানিতে হাত ধুয়ে গরম ভাত তুলতে তুলতে মীরাদেবী দেখেন, দৈন্যতার মাঝেও কী অসাধারণভাবে এরা খাসির মাংস-মুগুের ডাল-সবজি -পিঠের আয়োজন করেছে। মীরার খুশির চেয়ে কষ্ট হলো বেশি, এরা কতো অনায়াসেই সব উজার করে ভালোবাসতে জানে।
একসময় পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির আশেপাশের নানান জায়গায় এদের অবস্থান থাকলেও বর্তমানে দেশভাগের পর পূর্ববাংলার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড়গাঁও গ্রামে তিন পুরুষ আগে রুজি-রোজগারের আশায় চলে আসেন কিন্তু কালের গতিতে এখন তারা পৈত্রিক পেশার পাশাপাশি নানা কাজে নিযুক্ত হয়েছে।
লিলির কাকাতো বোন মিলি ভীষণ চটপটে, জীর্ণ-নড়বড়ে বেঞ্চে প্রথমে চারজন যুবক-যুবতী খেতে বসেছে— কী তাদের আনন্দ, কী তাদের উচ্ছ্বাস। এভাবে পালাক্রমে আরো জনাকতক শিশু কিশোরের খাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হলো যেন কোনো উৎসব, এরা একে অপরকে কী সুন্দরভাবে লতার মতো জড়িয়ে রয়েছে।
উঠোনের এককোণে গোয়াল ঘর, তার সামনা সামনি ধানের গোলা লিলিদের, লিলির বাবা জানালো- আদি নেওয়া জমি বাজারে দাম বাড়লে তবেই ধান বিক্রি করবে। এদিকে লিলির ছোট ভাই দুলালের সেলুন থাকলেও সেভাবে আর আগের মতো চলে না, কারণ আজকাল তো বড় বড় সব পার্লার হয়েছে, দুলালের তাই স্বপ্ন শহরে গিয়ে পার্লারে কাজ করবে।
চব্বিশ-পঁচিশ বছর লিলির আট-ন'বছরের ছেলে কৃষ্ণ আধা খেয়ে পাতে জল ঢেলে দিলো, তা দেখে মীরা প্রথমে একটু অবাকই হয় কিন্তু ভাতের থালাটি উঠিয়ে নিয়ে একটি বন্ধ ঘরের দরজা খুলে হাঁসদের খেতে দিলে মীরা তাতে আশ্বস্ত হলো। ভীষণ দুরন্ত কৃষ্ণকে শহরে নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হওয়া লিলি আজ ক্ষান্ত, কৃষ্ণ তার মায়ের যেখানে লিলি বাসাবাড়িতে কাজ করে সেখানে ও থাকতে চায় না কারণ ওর ফাঁপর ঠেকে। উড়ন্ত ডানা-মেলা পাখির কলরবকে কেও বেঁধে রাখতে পারে না, তবে ওর প্রিয় সঙ্গিনীটি দেখতে ভারী মিষ্টি, কৃষ্ণ আর তার সখীর— দিনের মধ্যে কতবার যে মন কষাকষি হয় তার ইয়ত্তা নেই। বাল্য বয়সের রাগ-অনুরাগের সাক্ষী হয়ে মীরাও যেন কোথাও হারিয়ে যায়। নির্ভেজাল সত্যকে আঁকড়ে ধরে কৃষ্ণ তাই তো গ্রামে আজ স্বাধীন, ইচ্ছে মতো ছুটোছুটি— ইচ্ছে মতো চলা।
পড়শীরা মীরাদেবীকে কিছুতেই ছাড়লো না, ঢুবে যায় গ্রামবাংলার আপ্যয়নে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে। একটি মা কালীর থানে এসে থমকে যায় মীরা, বারোলিয়া ধাম। মায়ের মূর্তির থানে ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় বারো-চৌদ্দটি মাটি দিয়ে তৈরি গোলাকাকৃতি ঢিপি, যা এগুলো বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক রূপ, এমনকি মুসলিমদের নামেও এখানে দরগা করে। চায়না ধান ওঠার পর এখানে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উৎসবে একত্রিত হয়, লোকসংস্কৃতির এই যোগ অবিচ্ছেদ্য। থানের পরেই বিঘা বিঘা কেবল ফসলী জমি এবং আরো কিছুটা দূরে গেলে মরা গাঙ।
কাঁচা কাঁচা বরই খেতে গিয়ে মীরা হাত গুটিয়ে নেয়, মনে পড়ে যায় আর ক’দিন পরেই তো সরস্বতী পুজো, এতোদিন যখন খায়নি তখন আর নাইবা খেলো। পুকুর পারের পাতাহীন লেবু গাছটিতে অনেক লেবু ঝুলে রয়েছে, তারই থেকে একটি লেবু টুপ করে পড়তেই কৃষ্ণের সখী তা নিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে যায়, কৃষ্ণ তখন তারস্বরে চিৎকার করছে— লেবু নিয়া পলাই গ্যাল্ পলাই গ্যাল্।
চোখে-মুখে অসম্ভব খুশির ঢেউ খেলে যাওয়া লিলির প্রতিবন্ধী জ্যাঠতুতো ভাইটি শিশুর মতো নিষ্পাপ ভঙ্গিতে হেসে হাত-পা নেড়ে মীরার কাছে ইশারায় আবেদন জানায় ছবি তোলার, ছবি তোলা হয়ে গেলে অচল ছেলেটি কোনারকম দু’হাত জোড় করে কৃতজ্ঞতা জানায় মীরাকে। ছোট্ট ছোট্ট চাহিদায় ভালোবাসার বড় বড় উপহারে মাথা নত হয়ে আসে বারংবার।
কেবল কিছুকালের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একদিন ঝুপ করে মারা যায় লিলির স্বামী, তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ দশ-বারো বছর। শ্বশুরবাড়ি থেকে ছোট্ট কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে যখন বাপের বাড়িতে আশ্রয়ে এলো, অভাবের সংসারে তখন তারা তবুও লিলিকে বুকে টেনে নেয়। ক্ষেতি-খামারে প্রথম দিকে লিলি কাজ করলেও কিন্তু তা বেশিদিন করতে পারে না, হঠাৎ করে একদিন অজ্ঞান হয়ে যায় জমির ওপরেই। প্রথমে ঝাড়ফুক করতে গিয়ে মেয়েটি যখন দিনে-দিনে আরো দুর্বল হতে থাকে তখন কোনো উপায় না দেখে সদরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে, ডাক্তার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান ওর থ্যালাসেমিয়া হয়েছে। বিস্তারিত সব জানার পর লিলির বাপ-মায়ের কপালে হাত পড়ে, মাসে-মাসে রক্ত দেবার ক্ষমতা তাদের কোথায়?
লিলি ফুল না হলেও ফুটফুটে একটি মেয়ে, এবার ও আশ্রয় পেলো শহরের একটি বাড়িতে— কাজের মেয়ে হয়ে এবং তার রক্ত নেওয়ার দায়িত্বটি তারা নিলেন। যে আত্মীয়তার বাড়িতে মীরাদেবী একটি বিশেষ কারণে এসেছেন, তাদেরই বাসায় লিলি থাকে। বিশাল ঘরবাড়ি অথচ পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিনজন, কিন্তু কাজেরলোক ড্রাইভারসহ ছ’জন। গভীর রাতে একদিন মীরার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়, মীরা শুয়েছে তিনতলায় তবে শব্দটা মনে হচ্ছে নীচ থেকে আসছে। চারদিকে শীতের কুয়াশার নিস্তব্ধতায় মীরা পা টিপে টিপে ঘরের মাঝের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসে দোতলায়, একদম কোণের ঘর হতেই শব্দটি হচ্ছে ভেবে ওদিকে এগিয়ে যেতেই দু’টি নর-নারীর শয্যাস্বরে মীরা বুঝে যায় লিলি আর কেয়ারটেকার ছেলেটি। মন মানলে শরীর মানে না আবার শরীর মানলে মন মানে না― ঠিক যেন খড়ের গাদায় আগুন, দাউদাউ জ্বলছে—ফুটছে—গোপন ধোঁয়ায় ছারখার হচ্ছে।
মীরা আর লিলি ফিরছে শহরে, দলবেঁধে ওরা বিদায় জানাতে চলে এলো অনেকটি পথ, কৃষ্ণ ও তার সখীটিও। কুয়াশাচ্ছন্ন দিনটির বেলাশেষে হু হু বাতাসে তখন ভারী শীত-কাপড়েও বাঁধ মানছে না, ফসলে তখন বকের ডানা ঝাপটানি— শালিকের ঠোঁটে শেষ দানাটির মাঝে রাতের আহ্বান—দিনমজুরের উদোম শরীরে ঘরে ফেরা গান— রাখালের মৈষালী সুর আর সরষের হলুদে চাষীর রামধনু। উগুলদানি থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল, এঁটো—অপরিচ্ছন্ন― লিলি নিশ্চল, সন্ধের দিকে তাকিয়ে থাকা অস্বচ্ছ দৃষ্টি।
Comments
Post a Comment