তুলসী : দা রিয়াল প্রোটাগোনিস্ট | অরিজিৎ মল্লিক | প্রবন্ধ ৫
সত্যজিত রায় যাকে ভারতের ‘মরিস শিভ্যালিয়র’ মনে করেছেন আর যার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ওঁর কদর এই পোড়া দেশে কেউ করেনা। তবে আমেরিকায় জন্মালে উনি নিশ্চিত অস্কার পেতেন।“ বা দাদাসাহেব ফালকের কথায় 'The Untouchable Comedian of all Time'। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক স্যার হেনরি যাকে বলেছিলেন 'The Real Protagonist' মনে পড়ছে ভদ্রলোককে? একমাথা টাক আর ধুতি পরিহিত সেই পরশ পাথরকে অনায়াসে সিনেমার গডফাদার মেনে নিয়ে মহানায়ক উত্তমকুমারও অকপটে বলেছিলেন, “তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি তো কোনও দিনই পারবো না। ওঁর মত ‘জীবন্ত’ হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবেনা।" কথা হচ্ছে যাকে নিয়ে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় সেই ‘ক্ষণজন্মা’ অভিনেতা আর কেউ নন আমাদের সকলের প্রিয় ‘তুলসী চক্রবর্তী’ । যিনি ছিলেন অভিনয়ের আস্ত একটি স্কুল, জীবনের প্রতিদিনের ওঠাপড়া আর নিত্যদিনের সাধারন জীবনকেই যিনি অভিনয়ের আড়ালে সেলুলয়েডে বা রঙ্গমঞ্চে অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নিজের অনবদ্য স্টাইলে আর তাইতো সৌমিত্রবাবুও অনায়াসে বলেছিলেন, "কেউ যদি দেখাতে পারেন অমুক ছবিতে তুলসী চক্রবর্তী খারাপ অভিনয় করেছেন, তা হলে আমি লক্ষ টাকার বাজি হেরে যাব। উঁচু দরের সহজাত অভিনয় ক্ষমতার মালিক ছিলেন তিনি।" বা আরও বলেছিলেন "বাংলা সিনেমার যেকোনো ইতিহাসই লেখা হোক বা তৈরি হোক সেখানে আমার ধারনা তুলসী চক্রবর্তীর নাম খুব বড় করে লেখা থাকবে, এঁকে শুধু কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ছাপ মেরে দিলে খুব অন্যায় হবে।" না, লেখা হয়নি কোন ইতিহাস আর তাইতো বিখ্যাত সব মানুষদের উঁচুদরের মন্তব্যের পরেও মানুষটি রয়ে গিয়েছেন অনাদরেই।
প্রখ্যাত সাংবাদিক রবি বসুর প্রশংসার পরিপ্রেক্ষিতে যিনি হেলায় বলেন, “আরে আমি আবার অভিনেতা হলাম কবে! নিজের যা বিদ্যেবুদ্ধি তাতে অন্য কিছু করে তো অন্ন জুটবে না, তাই পেটের দায়ে থিয়েটার- বায়স্কোপে পেছন নাচাই।“ আর তাইতো রবিবাবু ওনার ‘সাতরঙ্গে’ তুলসী বাবুর বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, হাতি যেমন নিজের শরীরটাকে দেখতে পায় না, নিজের ক্ষমতার পরিমাপ করতে পারেনা, আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীরও ছিল ঠিক সেই অবস্থা। তাঁর নিজের মধ্যে যে কি পরিমান অভিনয়ের ক্ষমতা ছিল, তা তিনি কিছুতেই বুঝতে চাইতেন না।
তুলসী চক্রবর্তী, জন্ম ৩ রা মার্চ ১৮৯৯ কৃষ্ণনগরের গোয়ারি গ্রামে, পিতা রেল কর্মচারী আশুতোষ চক্রবর্তীর অকাল প্রয়ানের পর থেকেই দারিদ্রতাকে সঙ্গী করে কিশোর তুলসীবাবু এসে পরেন জ্যাঠা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে কোলকাতায়। ক্লাস ৩ এর বেশি পড়াশোনা করতে না পারা তুলসীবাবুর ভাষায়, “জ্যাঠামশাই আমার অভিভাবক বটে,কিন্তু তিনি তো সবসময় তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা পার্টি’ আর ‘কেলাব’ নিয়েই ব্যাস্ত। তাই আমার অবস্থা গিয়ে দাঁড়ালো বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেদের মত।“ মজা করে ‘কেলাব’ বলা জিনিসটা ছিল তখনকার ‘আম্যেচার ক্লাব’ যেখানে গান-বাজনা-যাত্রা-থিয়েটার ইত্যাদি হত। পরবর্তীতে যখন প্রসাদবাবুর নিজস্ব দল ভেঙ্গে যায় উনি তখন স্টার থিয়েটারে হারমোনিয়াম বাজানোর চাকরি নেন আর সেখান থেকেই তুলসী বাবুর জীবনের গতি বদলাতে থাকে, জ্যাঠাকে খাবার দিতে আসা যুবক ‘তুলসী’ ততদিনে মঞ্চের উয়িংসের পাশে দাঁড়িয়ে চাক্ষুষ করেছেন তাবড় তাবড় অভিনেতাকে আর সেসব দেখে তাঁর নিজের ভাষায়,” বুকের ভিতরটা আকুলি-বিকুলি করতো অভিনেতা হবার জন্য। “
ইতিমধ্যে প্রায় ডজন খানেক চাকরি করা হয়ে গেছে তুলসীর, মদের চাটের দোকানে প্লেট ধোওয়ার কাজ করার সময় জ্যাঠামশাই চুলের মুঠি ধরে হির হির করে টেনে বাড়ি আনলেন, পালিয়ে গেলেন ‘বোসেস সার্কাস’ নামক একটা সার্কাস কোম্পানির সাথে জাহাজে করে বর্মায়,জোকার সাজতেন কিন্তু ছয় মাস থেকে তাঁর উপলব্ধি, “গা থেকে জন্তু জানোয়ারের গন্ধ বেরোচ্ছে”, তাই ফিরে এলেন কিন্তু ততদিনে হিন্দি আর উর্দু ভাষায় তাঁর যথেষ্ট দখল হয়ে গেছে। এরপর কাজ নিলেন একটা ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ, কালিমাখা হাতে থিয়েটারের বিভিন্ন পোস্টার, হ্যান্ডবিল দেখার সময়ই তাঁর নিজের অভিনেতা হতে চাওয়ার ইচ্ছেটা আরও দৃঢ় হয়। তাঁর কথায়,” কুঁজোরও চিত হয়ে শুতে ইচ্ছে হয়।তা আমারও মনে হল অভিনেতা হতে পারলে আমারও ওইরকম পোস্টারে নাম ছাপা হবে। সেইজন্যই তো জ্যাঠা মশাইয়ের কাছে এসে বায়না ধরলাম থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য,উনিও বললেন, সেই ভালো আমার চোখের সামনে থাকতে পারবি। উনিই অপরেশ বাবুর কাছে কাকুতি মিনতি করে আমাকে থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিলেন।“ ভালো কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, কবিগান গাইয়ে আর পাখোয়াজবাদক তুলসী চক্রবর্তীর প্রথম গুরু জ্যাঠা প্রসাদ চক্রবর্তী, ওঁর ভাষায়, “ আমার যা কিছু শিক্ষা সব আমার জ্যাঠা মশাইয়ের কাছে,উনি ছিলেন অর্জুনের মত সব্যসাচী”। তাহলে দ্বিতীয় গুরু হলেন স্টার থিয়েটারের কর্ণধার অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু ভাগ্যের সিকে ছিঁড়লো না, ১৯২০ সালে প্রথম আত্বপ্রকাশ ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে আর সিনেমায় তারও ১২ বছর পরে ১৯৩২ এ নিউ থিয়েটারসের ‘পুনর্জন্ম’ ছবিতে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪২০ টি বিভিন্ন ভাষার ছবিতে কাজ করেছেন তার মধ্যে ৩১৬ টি বাংলা ছবি ও ২৩ টি হিন্দি ছবি কিন্তু এর বেশির ভাগই ছোট ছোট রোলের। বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতে এমন সব চরিত্রে তাঁকে কাজ নিতে হয়েছে যেগুলো নিতান্তই চোখে পরার মত নয় কিন্তু অভিনয়ের নিজস্বতায় সেইসব চরিত্রকেও অসামান্যভাবে ফুটিয়ে নিজের স্বপ্রতিভ ছাপ রেখে গেছেন আর সেই কারনেই হয়ত সদাহাস্য, আমুদে প্রকৃত ভালোমানুষ তুলসীবাবু কেঁদে ফেলেন যখন সত্যজিত রায় তাঁর ‘পরশপাথর’ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে তাঁকে আমন্ত্রন জানালেন। সেদিন অর্থাৎ জীবনের প্রায় শেষ বয়েসে এসে তাঁর পোস্টারে নাম তোলার আশা যখন পূর্ণ হল তখন সারা কোলকাতায় বড় বড় হোড়ডীং এ বিরাট আকারে জ্বলজ্বল করছে তাঁর মুখ। মানুষটা তখন একটু অন্যরকম হয়ে গেছিলেন, রবিবাবুর ভাষায়, “যেন কেমন একটা ভয়-ভয় ভাব তাঁর মধ্যে এসে গিয়েছিল। সর্বদা একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন।" এই ভয়টা ছিল কাজ না পাবার ভয়, আর তাই সত্যজিত বাবু যখন ওনাকে বেশি পারিশ্রমিক দিতে উদ্যত হলেন তখন বিনম্রতার সাথে উনি সেটা প্রত্যাখ্যান করে যেই পারিশ্রমিক পেতে অভ্যস্ত সেটিই নিয়েছিলেন। পরশ পাথরের শুটিংয়ে একদিন সত্যজিত বলেছিলেন, “আপনি হলেন নায়ক, আপনার কি ট্রামে বাসে চড়া সাজে ! আজ থেকে আপনি আমার গাড়িতে করেই হাওড়া ফিরবেন।“ উত্তরে আমুদে তুলসী বলেছিলেন, “star need no car আর আমি তো নায়ক নয় হে, আমি হলাম রসায়ক আর তোমার এখানটা হল ‘রসায়নগার’ আর আমি হলাম তার ‘কেমিস্ট’।“ নিজেকে রান্নাঘরের ‘হলুদ’ মনে করা তুলসীবাবুর সরল বয়ান ছিল,”ঝোলে ঝালে অম্বলে সবজায়গাতেই লেগে যাই, সিনেমায় যেমনি বলে তেমনি করি, কখনো হাসাই কখনো কাঁদাই আবার কখনো নিজেই হাসি।“ বাস্তব জীবনে কিন্তু মানুষটা আমুদে হলেও ওই কান্নাটাকেই পাথেয় করেছিলেন আর তাইতো লেখক মনিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় (শঙ্কর) এর সাথে প্রায়শই বাসে দেখা হওয়া তুলসীবাবুর একদিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে শঙ্কর বলেছেন, "বাসে সকলে ওঁকে দেখে প্রচণ্ড হাসাহাসি করছেন আর তাতে তুলসীবাবু যারপরনাই বিরক্ত। বাস থেকে নেমে তুলসী বাবু বলেছিলেন, আমাদের লাইনে যারা কাঁদায় তারা টাকায় ভাসে আর যারা হাসায় তারা স্রেফ কাঁদে।"
আর তাইতো যেখানে আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে সিনেমা অটোগ্রাফির স্নাতকোত্তর বিভাগে তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত সিনেমার নির্বাচিত অংশ পড়ানো হয়, সেখানে ওঁর ১২৬ তম জন্মদিনে এসেও হাওড়ার কৈলাস বোস থার্ড বাই লেনের ৬ ফুট গলির ভিতর দোতলা বাড়িটা পরে থাকে স্রেফ একটা ‘পোড়ো বাড়ি’ হয়ে আর সামনের মাঠটা শুধু তাঁর নামে নামাঙ্কিত করেই দায়সারা হয়। যেই পরশপাথর ছুঁইয়ে টলিউড সোনা ফলাতে পারতো বা আমরা আরেকবার শিল্পীর বাইরেও সত্যিকারের একটি মানুষকে আরও চর্চা করে সমৃদ্ধ হতে পারতাম সেই সুযোগ কি আজ সত্যিই হারিয়ে গেছে?
তথ্যসুত্র : উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার অনলাইন, রবি বসুর সাতরঙ, অজানা নাগরিক ইউটিউব চ্যানেল, বাংলামুভিজ ডট ইনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ইন্টারভিউ।
Comments
Post a Comment