জন্ম শতবর্ষে নন্দিনী : তৃপ্তি মিত্র | হিমাদ্রি শেখর দাস | প্রবন্ধ ৯
তৃপ্তি মিত্র বাংলা নাট্য জগতে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত রক্তকরবীর নন্দিনীর জন্যই যদিও কালজয়ী ‘নবান্ন নাটকের মাধ্যমে তার অভিনয় পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ‘অপরাজিতা’, ‘রাজা’, ‘রক্তকরবী’, ‘চার অধ্যায়’, ‘পুতুলখেলা’ ইত্যাদি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে গতবছরই রক্তকরবীর শতবর্ষ গেল সেই অর্থে বলা যায় নন্দিনী চরিত্রটিরও একশ বছর গেলো গতবছর আর নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করা তৃপ্তি মিত্রের এই বছর শতবর্ষ। অথচ কী আশ্চর্য, এই মানুষটাই কি না তাঁর কৈশোরে ডাক্তার, প্রফেসর নয়তো সমাজসেবী হবে ভেবে তৈরি হচ্ছিল!এমনকী তাঁর মঞ্চে ওঠা নেহাতই পাকেচক্রে। টাঙ্গন নদীর পারে ঠাকুরগাঁ ডিভিশনের মেয়ে। বাবা আশুতোষ ভাদুড়ি। পেশায় উকিল। মা শৈলবালা স্বদেশীতে উৎসাহী। তাঁদেরই নয় মেয়ে, এক ছেলের একজন তৃপ্তি। মাসতুতো ভাই বিজনের ভট্টাচার্যের লেখা নাটকে আচমকা এক অভিনেত্রী উধাও হয়ে যাওয়াতে শেষ মুহূর্তে ধরেবেঁধে নামানো হয় কিশোরী তৃপ্তিকে। এর পর ওই মাসতুতো ভাইয়ের জোরাজুরিতেই ওঁর থিয়েটারে আসা।
কিন্তু থিয়েটারে আগ্রহ শুরু কবে থেকে, উত্তরে তৃপ্তি মিত্র একটা দৃশ্যের কথা বার বার বলতেন। ১৯৪৩, মন্বন্তর। নিজের চোখে দেখেছিলেন নিকাশির পাইপ দিয়ে ফ্যান গড়াচ্ছে। আর গ্রামের লোকজন শহরে এসে চেটেপুটে সেই ফ্যান খাচ্ছে। তখনই ‘নবান্ন’, ‘প্রগতিশীল শিল্পী সংঘ’ আর তাঁর সেই বিজনদা। ‘নবান্ন’ দেখে খাজা আহম্মদ আব্বাস ওঁকে ‘ধরতি কে লাল’-এ নিয়েছেন, এর পর ডাক পেয়েছেন মহেশ কাউলের ‘গোপীনাথ’-এও। কিন্তু থিয়েটার তত দিনে ওঁকে কব্জা করে ফেলেছে। তারই মধ্যে তখন বোম্বে গিয়ে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে আলাপ, বিয়ে। ‘বহুরূপী’র জন্ম। মঞ্চ আরো পাকড়ে ধরল। ১৯৪৮ -এ গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে সরে এসে তৃপ্তি-শম্ভূ মিত্ররা বহুরূপী নাট্য সংস্থা গড়ে তোলেন। তারপর তো ইতিহাস! বহুরূপীর নবান্ন (১৯৪৮), পথিক (১৯৪৯), ছেঁড়া তার, উলুখাগড়া ‘চার অধ্যায়’ (১৯৫১),‘দশ চক্র’ (১৯৫২),‘রক্ত করবী’(১৯৫৪),‘ডাকঘর’ (১৯৫৭),‘পুতুল খেলা’(১৯৫৮), ‘কাঞ্চরঙ্গ’ (১৯৬১), ‘বিসর্জন’ (১৯৬১), ‘রাজা’ (১৯৬৪), ‘ওয়াদিপাউস’ (১৯৬৪), ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৭), ‘বর্বর বাঁশি’ (১৯৬৯), পাগলা ঘোড়া (১৯৭১), ‘চোপ আদালত চলছে’ (১৯৭১), ‘অপরাজিতা’ ‘যদি আর একবার’, ‘সরিসৃপ’, পেশাদারী মঞ্চে ‘সেতু’ প্রভৃতি নাটকে অসামান্য অভিনয়।
থিয়েটার করতে করতেই সংসার করেছেন। সংসার করতে করতে থিয়েটার। খুন্তি নাড়ার সময়ও হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে সংলাপ মুখস্ত করেছেন। ‘বাকি ইতিহাস’-এ তিনটে মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন তৃপ্তিদি। স্বভাবতই প্রত্যেকের হাঁটাচলা, কথাবলা সব আলাদা। নাসিরুদ্দিন শাহ রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ‘বহুরূপী’-র রিহার্সালে যাওয়ার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও এই ‘আলাদা’টা রপ্ত করতেন তিনি। তৃপ্তিদিকে দেখলে কেবলই মনে হত, ওঁর মধ্যে যেমন একটা কুমোর বাস করে, তেমনই এক তাল কাদাও। তাই কোনও কিছুই বোধহয় গড়ে নিতে অসুবিধে হত না। এমন থিয়েটার নিবেদিত-প্রাণ মানুষটা যখন বাণিজ্যিক থিয়েটারে গেলেন, রে রে করে তেড়ে উঠলেন অনেকে। ভাবখানা এই তিনি আপস করেছেন। তিনি ব্রতচ্যুত। কিন্তু অনেকেই জানেন, না, ওটুকু না করলে তখন তাঁদের সংসার চলত না।
শম্ভু মিত্র কোনও দিন চাকরি করেননি। একেবারে শেষ দিকে রবীন্দ্রভারতীর সময়টুকু বাদ দিলে, থিয়েটারই ছিল তার প্রথম ও শেষ কথা। বইয়ের রয়্যালটি ইত্যাদিতে কতই বা আসত। সংসারটা চলত তৃপ্তিদি দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই। তাঁকে বাণিজ্যিক থিয়েটারে রাসবিহারী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছিল অনেকটা বাধ্যতা থেকেই। অথচ তার পরেও ওই সমালোচনা ওঁকে শুনতে হয়েছে। একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, -“উনি (শম্ভুদা) রোজ এক টুকরো মাংস খান, লোকে কি জানে, সেই টাকাটা কোত্থেকে আসে?” আমার উত্তরটা হল, সেটা ওই ‘সেতু’র মতো থিয়েটার করেছেন বলেই। স্তানিস্লাভস্কি একটা কথা বলে গেছেন, অভিনয় করতে গিয়ে নিজের স্বভাব, আচরণ, আদবকায়দা চরিত্রটার ওপর চাপিয়ে দিতে নেই।
তৃপ্তি মিত্র বোধহয় এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। ‘উলুখাগড়া’য় শম্ভুদার মা হতেন, মঞ্চে তাঁর সেই অভিনয় দেখে না জানলে এক মুহূর্ত বোঝার উপায় ছিল না, জীবনের ক্ষেত্রে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী। অথচ অমন অভিনয় দেখেও ওঁদের সম্পর্ক ঘিরে কী কুরুচিকর মন্তব্যই না হয়েছে!
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের কথায়― তৃপ্তিদির বেলায় বেড়াজালটাই ধুয়ে যেত। সব সময় মনে হত কেমন যেন হৃদয়বতী! মঞ্চে তো বটেই, তার বাইরেও তাই। ওঁর চোখে আমি জল দেখেছি। রাগ, দুঃখ, ভালবাসা, কৌতূহল, আবেগ সব পেয়েছি। বিপরীতে শম্ভু মিত্র সব সময় ‘ইন্টেলেক্ট’-এর ওপর জোর দেওয়া একজন মানুষ। কঠোর। সেই কঠোরতা আবার একেক সময় সবার কাছে ভীতিপ্রদ হয়ে দাঁড়াত। তখন মধ্যপ্রদেশ সরকারের ‘কালিদাস সম্মান’-এর জুরি বোর্ডে ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। সে বছর প্রাপকের নাম ঠিক করার আগে উনার মনে হয়েছিল, তৃপ্তি মিত্রের চেয়ে যোগ্যতর আর কেউ নেই, তাছাড়া সেই সম্মানের অর্থমূল্যও
সংসারের নিত্যদিনের খরচের পর কঠিন রোগ সামলাতে কিছুটা কাজে দেবে। শরীরের কারণেই পুরস্কার নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরনোর সমস্যার ফলে পর্বত মহম্মদের কাছে গেছিলো। ভোপাল থেকে আগত
মধ্যপ্রদেশ সরকারের শিক্ষা-সংস্কৃতি সচিব অশোক বাজপেয়ীকে নিয়ে গোলপার্কের বাড়িতে গেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত
একবার একটা ঘটনা নিয়ে অহেতুক জলঘোলা করা হয়েছিলো। ‘পুতুলখেলা’র মহলায় একটি আবৃত্তির দৃশ্যে শম্ভু মিত্রের অভিনয় দেখে তৃপ্তি মিত্রের মনে হয়েছিল, উনি এমন কিছু ভঙ্গি করছেন, যাতে তার অভিনয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাতে উনি অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে যান। একটা চাবি নিয়ে আঙুলে করে ঘোরাচ্ছিলেন শম্ভু মিত্র যা নিয়ে আপত্তি। থিয়েটারে ‘সিরেনডেপিটি’ বলে একটা কথা খুব কাজ করে। একজন চরিত্রাভিনেতা প্রতি মুহূর্তে তাঁর চরিত্রটাকে নতুন নতুন করে আবিষ্কার করতে করতে ভঙ্গিও অনেক সময় পাল্টে পাল্টে যায়। বহিরঙ্গটা এক থাকে। তা নিয়ে জলঘোলা হয়েছিল। ওঁদের সম্পর্ক ঘিরে এ ঘটনা বারবার ঘটেছে। তাতে ওঁদের অবনতির সাথে থিয়েটারেরও ক্ষতি হয়েছে। কাজের গুণবিচার থেকে ফোকাসটা সরে গিয়েছে। অথচ শেষজীবনে এই শম্ভু মিত্রই এনে রেখেছিলেন। দু’জনে দু’জনকে তখন চোখে হারাতেন। কোনও বাড়াবাড়ি নেই। ভিতরের ছটফটানি বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। শুধু দম বন্ধ করে এক প্রবীণ মানুষ তাঁর সব কষ্ট চেপে ধীরে ধীরে বহু কালের সঙ্গীকে নিভে যেতে দেখছেন। অসম্ভব আবেগী ছিলেন শেষ জীনবের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আবার যদি হারানো দিনে ফিরে যাই, তা হলে থিয়েটার আর করব না। আসলে আমি না বুঝে এখানে চলে এসেছিলাম।” — কী অসম্ভব জলঘোলা হল এই কথাটা নিয়েও! অথচ কে বলল, ওটা ছিল তাঁর সারা জীবনের একটা আপশোস? পরিতাপ? মুহূর্তের অভিমানতাড়িত কথাও তো হতে পারে। অথচ তাকে নিয়েও বাজার গরম করা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
আকাশবাণী কলকাতায় রেডিও নাটক ও প্রশাসনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি আকাশবাণীর সংগ্রহশালা থেকে কমপ্যাক্ট ডিক্সে ধ্বনিবদ্ধ রেডিও নাটক ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’য় শম্ভূ মিত্রর সঙ্গে তাঁর বাচিক অভিনয় এখনও শিহরণ জাগায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত তিনি আকাশবাণীর বিশেষ সম্মানীয় প্রযোজক ছিলেন। ১৯৮১সালে বিশ্বভারতী নাট্য বিভাগের ভিজিটিং ফেলো মনোনীত হয়েছিলেন। শম্ভূ মিত্র বহুরূপী থেকে সরে যাবার পরেও তৃপ্তি মিত্র ১৯৮২ পর্যন্ত বহুরূপীতে ছিলেন । ১৯৮৩ সালে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন নাট্যশিক্ষা কেন্দ্র ‘আরব্ধ’, সেখানে নবীন শিক্ষার্থীদের নাট্যাভিনয় শেখাতেন, শিল্পী গড়ার কাজ করতেন। ‘আরব্ধ’ তৃপ্তির নির্দেশনায় নবরূপে ‘রক্তকরবী’র নির্মাণ ও অভিনয় করেছিল ১৯৮৪-র জানুয়ারিতে।
গরদের শাড়ি পরে সেজে খুশি মুখে হুইল চেয়ারে বসে আছেন তৃপ্তিদি। মারণরোগে উনার ভেতরটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মৃণাল সেন তৃপ্তিদির হাতে কালিদাস সম্মান তুলে দিলেন। দুর্বল হাতটা দিয়ে ছুঁলেন শুধু। পাশেই দাঁড়িয়ে শাঁওলী। শম্ভু মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অন্যরা একটু তফাতে। মৃণালবাবু কন্যা শাঁওলীকে বললেন, “যাও, এ বার তোমার মাকে ভেতরের ঘরে পৌঁছে দাও। উনি ছুঁয়ে তো দেখেছেন, ব্যস তা হলেই হবে।” তাঁর সারা মুখে তখনও হাসি লেগে আছে। অল্প কয়েক দিন পরেই না ফেরার দেশে না চলে গিয়েছিলেন অপরাজিতা তৃপ্তি একজনের ভেতরে ভেতরে কতটা জীবনীশক্তি থাকলে ওই চরম সময়েও অতটা জ্বলজ্বলে থাকা যায়! জন্মশতবর্ষেও তিনি জ্বলজ্বল করছেন তৃপ্তিময়তায়।
তথ্যসূত্র :
১. তৃপ্তি মিত্র: অন্য বিনোদিনী: দেবতোষ ঘোষ
২.রচনাসংগ্রহ-১: শাঁওলী মিত্র
৩. অপরাজিতা- রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত
৪. এই পৃথিবী রঙ্গালয়- তৃপ্তি মিত্র
৫.বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস-চৌধুরী দর্শন
৬. গণনাট্য, নবনাট্য, সৎনাট্য ও শম্ভুমিত্র: শাঁওলী মিত্র।
৭. শম্ভু মিত্র শ্রীচরণেষু- দেবতোষ ঘোষ।
৮.আনন্দবাজার পত্রিকা
৯. পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা
১০.সংবাদ প্রতিদিন রোববার
১১. শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী: তৃপ্তি মিত্র: শৌনক দত্ত
১২. নাট্যমঞ্চের তিন দীপ্তিময়ী: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment