তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

মৃত্যু মঞ্জিল | পিনাকী রঞ্জন পাল | গল্প ৮

চারপাশে নিঃস্তব্ধতা। শুধু পাখির ডাকে জঙ্গল মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে। তিস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে অর্নব চক্রবর্তী গভীরভাবে শ্বাস নিল। তার চোখদুটি সরু হয়ে এল— সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়ি, মৃত্যু মঞ্জিল।

দশ বছর আগের কথা। তার বাবা, স্থপতি সৌমিত্র চক্রবর্তী, এই জমিদারবাড়ির পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই সময়েই হঠাৎ এক অদ্ভুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অর্নব তখন মাত্র ষোলো। বাবার মুখে শুনেছে, সেখানে এমন কিছু ঘটেছিল, যা আজও স্পষ্ট করে বলতে পারেন না তিনি। শুধু জানেন, বাড়িটির একটি নির্দিষ্ট কক্ষে ‘কেউ’ ছিল। কেউ, যে মুক্তি চেয়েছিল। একজন সাদা পোশাকের নারী, যার কান্না তিস্তার শব্দে মিশে যেত।

সেই ঘটনার পর আর কখনও সেখানে কেউ কাজ করতে যায়নি। জমিদারবাড়িটা পড়ে রইল পরিত্যক্ত, কুয়াশার চাদরে ঢাকা, ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে। এলাকার লোকজন বলতো— "বাড়িটা নাকি এখন আর শুধু অভিশপ্ত নয়, সেটা জীবন্ত! শ্বাস নেয়, কান্না করে!"

বাবা কখনও তাকে এই বাড়ির সম্পূর্ণ গল্প বলেননি, শুধু একদিন বলেছিলেন, "মৃত্যু মঞ্জিল… একদিন যদি আমার না বলা গল্পটা কেউ জানতে চায়, তবে সে তুই হবি।"

এবার সেই সময় এসেছে।

অর্নব এখন নিজেও একজন তরুণ ঐতিহাসিক ও গবেষক। ভূত-প্রেত নয়, বরং অতীতের সত্যি ইতিহাস তার লক্ষ্য। বহুদিন ধরেই সে এই জমিদারবাড়ি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিল। আর কিছু গোপন নথি থেকে পেয়েছিল এক ভিন্ন নাম— ‘অগ্নিবীর’।

কিন্তু কে এই অগ্নিবীর? কেন তার নাম এক শতাব্দী পুরনো একটা পরিত্যক্ত বাড়ির নথিপত্রে থাকবে? অর্নব সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজ এখানে এসেছে। সঙ্গে রয়েছে তার পুরনো বন্ধু— ঐন্দ্রিলা (একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার প্রত্নতত্ত্ববিদ), ভাস্কর (অপারেটর ও ক্যামেরাম্যান, ডকুমেন্টারি বানায়), আর তন্ময় (স্থানীয় লোকজনের মধ্যে কৌতুহল ছড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ করার দক্ষতায় পারদর্শী)।

তারা সবাই শিলিগুড়ি থেকে এক পুরোনো জিপে রওনা হয়েছিল সকালে। রাস্তা ছিল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, আর শেষ ৩ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল।

বাড়ির সামনে পৌঁছতেই ঐন্দ্রিলা ফিসফিস করে বলল, "এই জায়গাটা... অদ্ভুত ঠান্ডা না অর্নব?"

অর্নব মাথা ঝাঁকাল,"হ্যাঁ এবং আশ্চর্যের কথা—এই এলাকায় ঘন জঙ্গল, কিন্তু এখানে একটাও পাখি ডাকছে না। এটা স্বাভাবিক নয়।"

ভাস্কর জিপের পেছন থেকে ক্যামেরা বের করে বলল, "এটা একদম হরর ডকু ফিল্মের মতো লাগছে। কিন্তু মনে রাখো, আলো আর অ্যাঙ্গেলই সত্যিকে ভয়ঙ্কর করে তোলে।"

তন্ময় বাড়ির ভাঙা লোহার গেটটা ঠেলতে গিয়ে থমকে গেল। বলল, "এইটা খুলবে তো? মরিচায় একেবারে শক্ত হয়ে গেছে!"

অর্নব ধীরে ধীরে গেট ছুঁয়ে বলল, "এই গেট দিয়ে একসময় রাজপুরুষরা ঢুকত। এখন গুজবের ছায়া ছাড়া কিছুই বাকি নেই। কিন্তু এবার আমরা জানব, গল্পের আড়ালে আসলে কী সত্যি আছে।"

বাড়ির ভেতরে ঢুকে তারা দেখে, সবকিছু আগের মতোই রয়েছে। মেঝেতে পুরোনো কাঠের টুকরো, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েছে। শ্যাওলা ধরা দেয়ালের গায়ে ছত্রাক জমেছে। সবকিছু কেমন যেন থেমে আছে সময়ের গহ্বরে।

তখনই ঐন্দ্রিলা একটা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,"এই জায়গাটায়… একটা কিছু আঁকা ছিল মনে হচ্ছে। দ্যাখো, এখানে আগুনের মতো দাগ কাটা!"

অর্নব এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের ওই অংশটা হাত দিয়ে স্পর্শ করল। সেখানে সত্যিই আগুনের শিখার মতো এক ধরণের আঁকিবুকি খোদাই করা ছিল। কিছুটা ঘষামাজা করলে তার নিচে বেরিয়ে এল কয়েকটা শব্দ— "অগ্নিবীরের ইচ্ছায়ই সব ঘটবে।"

তন্ময় হেসে ফেলল, "ইচ্ছায় মানে? সে কি দেবতা নাকি ভূত?"

ঐন্দ্রিলা গম্ভীর মুখে বলল, "‘বীর’ শব্দটা মানেই এটা কোন যোদ্ধার নাম। হয়ত সে জমিদারের দেহরক্ষী ছিল, বা হয়তো তার থেকেও বড় কিছু..."

হঠাৎই তাদের আলো নিভে গেল। এক মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার নেমে এলো চারদিকে। ভাস্কর চিৎকার করল, "টর্চ! টর্চ চালাও!"

টর্চ জ্বলে উঠতেই তারা দেখল—একটা ঘরের দরজা হঠাৎ খুলে গেছে। অথচ সেই ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল! তারা কেউ তাকে ছুঁয়েও দেখেনি।

অর্নব সেই দিকেই এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। ঐন্দ্রিলা তাকে থামাতে চাইলো, "এভাবে একা যাস না অর্নব!"

কিন্তু অর্নব শুধু বলল, "এই বাড়িতে আমি অনেক আগেই এসেছিলাম, কিন্তু তখন অনেক কিছু না দেখে চলে যেতে হয়েছিল। এবার আমি শেষ পর্যন্ত যাব।"

ঘরের ভেতরে ঢুকে অর্নব যা দেখল, তাতে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।

ঘরের মেঝেতে রাখা একটা পুরনো কাঠের পেটিকায় ধুলো জমে আছে। কিন্তু তার উপরে রাখা এক টুকরো কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠল সে। কারণ আয়নাতে সে একা নয়—তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক লাল চোখওয়ালা ছায়া! সে চট করে পেছনে ফিরল। কেউ নেই।কিন্তু আয়নায় এখনো সেই ছায়াটা... ধীরে ধীরে হাসছে।

(২)

রাতটা কেটেছিল ভয় আর বিস্ময়ের দোলাচলে। জিপে ফেরার কথা থাকলেও, ঐন্দ্রিলার পরামর্শে তারা পাশের একটি পুরনো বনবাংলোয় রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কারও ঘুম আসেনি। বারবার মনে পড়ছিল আয়নায় দেখা সেই ছায়ামূর্তির হাসি।

ভোরবেলায় অর্নব চুপচাপ একটি পুরোনো খাতা খুলে বসে। তার বাবার রেখে যাওয়া ডায়েরি। পাতার পর পাতা লেখা, তবে কিছু কিছু অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট করে রাখা।

একটি পাতায় চোখ আটকে গেল, “অগ্নিবীর একজন নয়। তিনি প্রতীক। প্রতিশোধ, আগুন আর আত্মবলের প্রতীক। তার ঘুম ভাঙে, যখন অন্যায় সীমা ছাড়ায়।”

অর্নব কাঁপা হাতে লিখল, “তবে কি মৃত্যু মঞ্জিলের রহস্য শুধুই অতৃপ্ত আত্মার নয়? এটা কোনো যুদ্ধের ছায়া? সময়ের ফাটলে আটকে থাকা এক প্রতিজ্ঞা?”

ঐন্দ্রিলা এসে পাশে বসে বলল, "আমার মনে হচ্ছে, বাড়িটার নিচে কিছু একটা আছে। হয়তো গোপন সুরঙ্গ বা গুপ্ত প্রকোষ্ঠ। আমরা গতকাল যে ঘরে ছায়াটা দেখেছিলাম, সেখানে কেমন একটা অতিপ্রাকৃত কম্পন ছিল। সেটা ভূত নয়—উচ্চ তাপমাত্রার ফলেও এমন হতে পারে।"

তন্ময় হেসে বলল, "তোর মুখে ভূতের জ্ঞান শুনলে তো ভূতেরাই ভয় পাবে!"

ভাস্কর ক্যামেরা ঠিক করতে করতে গম্ভীর গলায় বলল,, "মজা করিস না তন্ময়। আমার ক্যামেরায় যেটা রেকর্ড হয়েছে, সেটা এডিটিং নয়। আয়নার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে কেউ ছিল।"

অর্নব সিদ্ধান্ত নিল— আজ আবার তারা ফিরবে মৃত্যু মঞ্জিলে। তবে এবার প্রস্তুতি নিয়ে।

দুপুর ১২টা | মৃত্যুমঞ্জিল চত্বর

দুপুরের সূর্য একটুখানি আলো ফেললেও, বাড়িটার ছায়া যেন গিলে নিচ্ছে চারপাশ। দরজায় দাঁড়িয়ে অর্নব বলল,

"আজ আমাদের লক্ষ্য তিনটি: প্রথমত, নিচতলা পুরো ঘুরে দেখা। দ্বিতীয়ত, আয়নার ঘর ভালোভাবে পরীক্ষা। তৃতীয়ত, ঐন্দ্রিলার সন্দেহমতো কোনো গোপন প্রকোষ্ঠ বা সুরঙ্গের সন্ধান।"

তারা একটি একটি ঘর খুঁজে দেখতে লাগল। অনেক ঘরেই পুরনো আসবাবপত্র ছড়িয়ে আছে—পোকায় খাওয়া চেয়ার, ছেঁড়া পর্দা, আর জায়গায় জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ, যা দেখে মনে হয় যেন আগুন ছুঁয়েছিল।

হঠাৎই তন্ময় একটি ঘরের কোণে একটি কাঠের আলমারির নিচে ফাঁকা জায়গা দেখে চিৎকার করে উঠল, "এই দ্যাখ! এখানে কি একটা স্লাব আছে! নড়ছে!"

তারা সবাই এসে কাঠের স্ল্যাবটা তুলতেই অবাক হয়ে গেল—তার নিচে পাথরের একটা সিঁড়ি নামছে অন্ধকারে। বাতাসটা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। নিচ থেকে যেন মৃদু গন্ধ আসছে—পুরনো কাঠ, ঘাম, আর কিছু পচা ফুলের মতো গন্ধ।

অর্নব টর্চ নিয়ে বলল, "চলো, নিচে নামা যাক।"

ভাস্কর ভিডিও রেকর্ড করতে করতে নামতে শুরু করল। সিঁড়িগুলো ছিল স্যাঁতস্যাঁতে, দেওয়ালে শ্যাওলা, আর মাঝেমধ্যে কিছু অসম্পূর্ণ প্রাচীন লেখা খোদাই করা।

নিচে পৌঁছে তারা দেখে, এটা আসলে একটি গোপন প্রকোষ্ঠ। সেখানে তিনটি ধাতব খাঁচা, এক পাশে ভাঙা শিকল আর মাটিতে ছড়িয়ে থাকা কিছু পুরনো অস্ত্র—তলোয়ার, বল্লম, ঢাল।

ঐন্দ্রিলা একটি দেয়ালে আঙুল ছুঁয়ে বলল, "এই যে খোদাই—দ্যাখো, এখানে লেখা আছে: ‘অগ্নিবীরের আগমনেই শাপমুক্তি।’”

অর্নব আশ্চর্য হয়ে বলল, "তবে কি কেউ বন্দি ছিল এখানে? কোন অপরাধে? আর কে তাকে মুক্তি দিতে পারে?"

তন্ময় একটি খাঁচার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ সেখান থেকে একটা ধাতব শব্দ হল, যেন কেউ ভেতরে কষে ঘুষি মারছে!

সবাই চমকে গেল। কিন্তু খাঁচা ফাঁকা!

হঠাৎ বাতাস কেঁপে উঠল, আর ঘরের এক কোণ থেকে একটা গলা ভেসে এল, "আমার রক্তে আগুন। যে জাগাবে, সে পুড়ে যাবে..."


আলো নিভে গেল। টর্চ, ক্যামেরা সব বন্ধ। চারদিকে গা ছমছমে অন্ধকার। গলায় জমে থাকা ভয় চাপা দিয়ে অর্নব ফিসফিস করে বলল, "এই গলাটা… এটা কোনো মেশিন নয়। এটা মানুষ নয়। এটা... সময়ের অতল থেকে আসা কিছু!"

ভাস্কর হঠাৎ বলে উঠল, "আমার ক্যামেরায় কিছু একটা ধরা পড়েছে! লাল চোখ, আগুনের মতো… সামনে এগিয়ে আসছে!"

ঐন্দ্রিলা তড়িঘড়ি করে অর্নবের হাত ধরে বলল, "চলো! এখনই এখান থেকে বেরোতে হবে!"

তারা দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। ঘরের দরজা নিজেরাই বন্ধ হয়ে গেল পেছনে!

তন্ময় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "এইটা স্বাভাবিক নয়। এখানে কিছু একটা আছে, যেটা মানুষ নয়… আর সেটা জেগে উঠছে।"

অর্নব একবার পেছনে তাকিয়ে বলল, "অগ্নিবীর… তুমি কে? আর আমরা কী জাগিয়ে তুলছি?"

(৩)

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, কিন্তু সেদিন সূর্যের আলো যেন অদৃশ্য হয় আরও তাড়াতাড়ি। বাড়ির আশপাশে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, শীত কাঁপানো ঠান্ডা যেন হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ে। সকালে মৃত্যু মঞ্জিলের নিচে যাওয়া ও গলার সেই বিভীষিকাময় আওয়াজ এখনো মাথার ভেতর বাজছে।

তবু অর্নব, ঐন্দ্রিলা, তন্ময় আর ভাস্কর সেই অভিজ্ঞতার ভিডিও বিশ্লেষণ করতে বসে।

ভাস্কর টেপ চালায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, খাঁচার সামনে ধোঁয়ার মতো কিছুর ভেতর থেকে এক জোড়া লাল চোখ জ্বলজ্বল করছে। সঙ্গে এক অদ্ভুত আওয়াজ—ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় সেই ভয়ানক বাক্য, “আমার রক্তে আগুন। যে জাগাবে, সে পুড়ে যাবে…”

ঐন্দ্রিলা ক্যামেরা থামিয়ে বলল, “দ্যাখো, ঠিক এইখানে একটা হাত দেখা যাচ্ছে! অর্ধেক কঙ্কাল আর অর্ধেক পুড়ে যাওয়া চামড়া... এটা কোনো সাধারণ ভূত নয়।”

অর্নব আস্তে বলল, “হয়তো এটা সেই ‘অগ্নিবীর’… ডায়েরিতে লেখা ছিল, সে প্রতিশোধের প্রতীক। তবে প্রতিশোধ কাদের ওপর? আর কেনই বা আজকে সে জেগে উঠছে?”

ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল—টক… টক… টক। সন্ধ্যার সময় কেউ এভাবে দরজা নাড়ানো স্বাভাবিক নয়। সবাই থমকে গেল। তন্ময় সাহস করে দরজা খুলল। বাইরে কেউ নেই। কিন্তু মাটিতে পড়ে আছে একটি পুরনো কাগজ মোড়ানো লাল কাপড়ের পুঁটুলি। খুলতেই বেরিয়ে এলো—একটি মুদ্রিত ছাপা কাগজ, একটা পুরনো তালা আর একটি চিঠি, রক্তমাখা কাগজে লেখা। 

অর্নব চিঠিটা পড়তে লাগল, “তোমরা যাকে জাগিয়েছো, সে ঘুমোয়নি। সে বন্দি ছিল শতাব্দীর শেকলে। আজ তোমাদের ছোঁয়ায় ভেঙেছে সে শিকল। তোমরা যদি বাঁচতে চাও, তার অতীত জানো। জানতে হবে 'অগ্নিবীর'-এর অভিশপ্ত চুক্তির কথা। নয়তো আগুনে পোড়াবে সে তোমাদের সত্তা। গোপন প্রকোষ্ঠে ফিরে যাও। তিনবার বলো— ‘জ্বলন্ত শপথে ফিরুক সে, সত্য উন্মোচনের জন্য।’ তবে সাবধান—প্রতিটি সত্যের দাম দিতে হয় রক্তে।”

ঐন্দ্রিলা ফিসফিস করে বলল, “তাহলে আমাদের ওখানেই ফিরতে হবে... আবার সেই নিচে?”

তন্ময় কাঁপা গলায় বলল, “তবে কি আমরা নিজেরাই ওকে জাগিয়ে তুলেছি?”

অর্নব চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওকে জাগিয়েছি আমরাই, কিন্তু দায়িত্বও আমাদের। আমরা জানব ওর কাহিনি। দরকার হলে আগুনের ভেতর দিয়েও যাব।”

রাত ৯টা | আবার সেই গোপন প্রকোষ্ঠ

এইবার তারা সঙ্গে নিয়েছে ধূপকাঠি, রুদ্রাক্ষের মালা, আর ঐন্দ্রিলা এনেছে তার ঠাকুমার দেওয়া পুরনো শ্লোকের বই।

তিনবার উচ্চারণ করা হলো সেই মন্ত্র—

“জ্বলন্ত শপথে ফিরুক সে, সত্য উন্মোচনের জন্য।

জ্বলন্ত শপথে ফিরুক সে, সত্য উন্মোচনের জন্য।

জ্বলন্ত শপথে ফিরুক সে, সত্য উন্মোচনের জন্য।”

চারদিক কেঁপে উঠল। দেয়াল কেঁপে উঠল ধ্বনিতে। খাঁচার পেছনের দেয়ালটা খুলে গেল ধীরে ধীরে। তার ভেতরে দেখা গেল একটি তামার ফলক, তাতে খোদাই করা—“অগ্নিবীরের চুক্তি”।

তামার ফলকে লেখা ভাষা সংস্কৃতের মতো, কিন্তু কিছুটা পাল্টে যাওয়া। ঐন্দ্রিলা পড়তে লাগল— “আমি অগ্নিবীর, প্রতিশোধের আগুন। রাজা মহীধরের আদেশে, শত নিরপরাধ পুরুষ- নারী-পুড়েছিল আমার হাতে। আমি প্রশ্ন করিনি, কারণ আমি ছিলাম রাজপুরোহিত ও যোদ্ধা।

কিন্তু একদিন আমার চোখ খুলল—যখন পুড়ল আমারই পরিবার।

তখন আমি চুক্তি করলাম এক অতল শক্তির সঙ্গে— যতদিন না প্রতিটি অপরাধী আগুনে পোড়ানো হয়, আমি শান্ত হব না। আমার আত্মা শাস্তি পাবে না যতক্ষণ না ‘সত্য প্রকাশ’ হয়। এই বাড়ির ভেতরে রয়েছে আমার প্রতিশোধের ইতিহাস। যারা এ সত্য জানতে চায়, তাদের দিতে হবে আত্মা ও সাহসের পরীক্ষা।”

তন্ময় অবাক হয়ে বলল, “তাহলে এটা শুধু ভূতের গল্প নয়! এটা ইতিহাস, প্রতিশোধ আর অপরাধের কাহিনি।”

হঠাৎ ঘরে আলো কমে এলো, আর তামার ফলক থেকে উঠতে লাগল আগুনের রেখা। ছায়ার আকারে দেখা গেল একজন উচ্চাঙ্গ পুরুষ—লম্বা চুল, লাল চোখ, গায়ে ছাই মাখা। তার মুখ যেন দগ্ধ ইতিহাস।

সে বলল, “তোমরা সত্য জানতে চাও? তবে প্রস্তুত হও... কারণ আগামীকাল তোমাদের সামনে খুলবে প্রথম পাপের পর্দা।”

হঠাৎ সব আলো নিভে গেল। তারা আবার উপরে উঠে এলো।

ঐন্দ্রিলা ধীরে বলল, “আগামীকাল আমরা জানব সেই পাপের কথা… যার জন্য অগ্নিবীর আজও ঘুমোতে পারেনি।”

(৪)

রাতটা একেবারে নির্ঘুম কেটেছে অর্ণব, ঐন্দ্রিলা, তন্ময় আর ভাস্করের। কারও চোখে ঘুম নেই। প্রতিবার চোখ বুজলেই যেন সেই আগুনের মুখ, লাল চোখ আর ভয়াল উচ্চারণ ফিরে আসে।

সকাল বেলা সূর্যটা উঠে এলেও, মৃত্যু মঞ্জিলের ছাদে যেন আলো পৌঁছোয় না। ছায়া গাঢ় আর নিস্তব্ধতা গা ছমছমে। পাখির ডাকও নেই, কুকুর পর্যন্ত দূরে থাকে এ বাড়ি থেকে।

এই দিনটা ছিল সত্য প্রকাশের দিন। অগ্নিবীরের প্রতিশ্রুতি—আজ প্রকাশ পাবে প্রথম “পাপ”।

সকাল ১০টা | আগের রাত্রির সেই গোপন প্রকোষ্ঠ।

চারজন আবার নেমে আসে নিচে। সেই খাঁচার পেছনের দেয়ালের তামার ফলক এবার মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেখানে এখন রয়েছে একটি পুরনো কাঠের বাক্স। উপরে খোদাই করা — “পাপ ১ : শ্মশানের বেদনা”

অর্ণব বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এলো একটি রক্তমাখা দিনলিপি। সেই বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা,“আমি রাজপুরোহিত অগ্নিবীর। এই দিনলিপিতে লিখছি আমার বিবেকের রক্তক্ষরণ। প্রথম পাপ—সেই শ্মশানযজ্ঞ, যেদিন মানুষ নয়, পুড়েছিল মানবতা।”

ঐন্দ্রিলা পড়তে লাগল—

দিনলিপির প্রথম পাতা (অগ্নিবীরের কণ্ঠে):

"রাজা মহীধরের আদেশে শ্মশানের পাশে তৈরি হয় বিশেষ যজ্ঞবেদি। বলা হয়েছিল, দুর্ভিক্ষ নিবারণ ও রাজ্যরক্ষার জন্য দেবতাকে ‘মানববলি’ দিতে হবে। আমি, অগ্নিবীর, তখন রাজপুরোহিত।

তিনটি পরিবার—দরিদ্র, অসহায়—তাদের ছেলেমেয়েদের ধরে আনা হয়। আমি প্রশ্ন করিনি। শুধু বলেছিলাম—‘এই বলি দেবতা চায়’। কিন্তু আমি জানতাম, এই তিনজন হল রাজ-অপমানকারীর পরিবার। আমি চুপ করেছিলাম। শাস্ত্রে লেখা নিয়মের নামে আমি দিয়েছিলাম মৃত্যু। তাদের পুড়িয়ে দেওয়া হয় জীবন্ত।

আমি দেখেছি, সেই শিশুদের চোখে আতঙ্ক। মা চিৎকার করেছে, আমি তাকাইনি। দেবতা সেই বলি নেননি। আকাশ কালো হয়ে এসেছিল, ঝড় এসেছিল। কিন্তু রাজা হেসেছিল। বলেছিল—‘আরও বলি চাই’। সেই দিনই আমার বিবেক প্রথম চিৎকার করেছিল।”

তন্ময় চোখ নামিয়ে বলল, “এটা একেবারে পিশাচসুলভ কাজ। এই রাজা, পুরোহিত—সবই ছিল হত্যার দালাল।”

ভাস্কর জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আমরা কেন এই কথা জানতে পারছি? আমাদের সাথে এসব অতীত পাপের সম্পর্ক কী?”

ঠিক তখনই দেয়ালের এক পাশে আগুনের মতো একটা ছবি জ্বলে উঠল। তাতে দেখা গেল সেই পুরনো যজ্ঞস্থল, তিনটি শিশু, আগুনে ঘেরা। আর দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোহিত, যিনি হয়তো অগ্নিবীর। আর একদম পেছনে ছায়ার মতো চারটি রূপ—হুবহু ঐন্দ্রিলা, অর্ণব, তন্ময় ও ভাস্করের মুখের মতো!

ঐন্দ্রিলা গলা কাঁপিয়ে বলল, “আমরা…! আমরা কি ওদেরই পুনর্জন্ম?”

একটা গম্ভীর আওয়াজ পুরো ঘর কাঁপিয়ে বলল, “পাপ চক্রাকারে ফিরে আসে। তোমরা চাইলেই এই চুক্তি থেকে মুক্ত নও। তোমাদের রক্তেই লেখা হয়েছে এই ইতিহাস।

তোমরাই সেই চার আত্মা—যারা একদিন নীরব থেকেছিল।

এখন সময় এসেছে পাপের খণ্ডন করার।”

হঠাৎই ঘরের মাঝখান থেকে উঠে আসে এক জ্বলন্ত দণ্ড।

উপরেই লেখা—‘পাপ-অগ্নি’। যে সত্যকে স্পর্শ করবে, তার শরীর বয়ে নেবে সেই পাপের তাপ।

অর্ণব সাহস করে হাত বাড়ায়। দণ্ড ছুঁতেই তার চোখ উল্টে যায়, আর সে দেখতে থাকে— “নিজেকে রাজসভায়। সামনে রাজা মহীধর। তাকে নির্দেশ দিচ্ছে— তিনজন অপরাধীকে ‘শাস্তির জন্য’ শ্মশানে পাঠাও। কিন্তু সে জানে, তারা অপরাধী নয়। সে চুপ করে আছে। দেখে, কিন্তু বলে না কিছুই।”

অর্ণব চোখ খুলে ফেলল। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সে বলল, “এই বার্তাগুলো শুধু ইতিহাস নয়, এগুলো আমাদের আত্মার হিসাব। অগ্নিবীর শুধু প্রতিশোধ চায় না, ও চায় মুক্তি। ও চায়—আমরা সত্যের মুখোমুখি হই। আমাদের নীরবতা ভাঙি।”

ঘরের মাঝে হঠাৎ অগ্নিবীরের আগুনের অবয়ব ভেসে উঠল। সে বলল— “তোমরা প্রথম সত্য জানলে। এখন দ্বিতীয় পাপের প্রস্তুতি নাও। যত গভীরে যাবে, ততই ভয়ংকর হবে। কারণ পরের পাপ—ঘটেছিল এই মঞ্জিলের মধ্যেই। রক্ত, বিশ্বাসঘাতকতা আর অভিশাপ… যা আজও মুছে যায়নি।”

আলোর রেখা মুছে গেল। চারজন চুপচাপ উঠে এলো উপরে। রাত পোহালেই পরবর্তী অধ্যায়।

ঐন্দ্রিলা চুপচাপ বলল, “আমাদের অতীত, ভবিষ্যৎ—সবই বাঁধা পড়ে গেছে এই অভিশপ্ত মৃত্যু মঞ্জিলের সঙ্গে।”

অর্ণব জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলল, “আগুন যেমন পোড়ায়, তেমন আলোও দেয়। আমরা সেই আলো খুঁজব, পুড়ে গেলেও।”

(৫)

ভোরের আলোটাও যেন আজ মৃত্যু মঞ্জিলকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। চারদিক নিস্তব্ধ। হাওয়া থমথমে। আজকের সকালটা যেন কিসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

অর্ণব, ঐন্দ্রিলা, তন্ময় আর ভাস্কর নীরবভাবে নেমে গেল সেই গোপন প্রকোষ্ঠে। আগের রাতেই আগুনের ছায়া বলে গিয়েছিল—আজ জানা যাবে দ্বিতীয় পাপের কাহিনি, যা ঘটেছিল এই মৃত্যুমঞ্জিলের অভ্যন্তরেই। রক্ত, বিশ্বাসঘাতকতা, আর এক অভিশপ্ত সিংহাসনের গল্প।

সেই রহস্যঘরে ঢুকে তারা দেখতে পেলো নতুন এক কাঠের বাক্স। বাক্সের গায়ে লেখা— “পাপ ২ : বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া”

ঐন্দ্রিলা বাক্সটা খুলতেই বেরোল এক পুরনো ধাতব মুখোশ, আর এক রক্তমাখা পার্চমেন্ট।

অর্ণব পড়তে শুরু করল- 

অগ্নিবীরের দিনলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড:

“আমি অগ্নিবীর। এই মৃত্যুমঞ্জিল একদিন ছিল শক্তির প্রতীক। এখানে রাজা মহীধর বসতেন তার সিংহাসনে। তবে যে বিশ্বাসঘাতকতা এই প্রাসাদে ঘটেছিল, তা এই ভূমির উপর চিরন্তন অভিশাপ নামিয়ে এনেছিল।”

“রাজা মহীধরের ছোট ভাই ছিল বিরাজ। তিনি প্রতিশ্রুত ছিলেন রাজার উত্তরাধিকারী। কিন্তু এক গোপন চুক্তিতে, মহীধর তাঁর বন্ধু ‘ভীষণ সেন’কে রাজকোষের অধিকর্তা বানান। এই ভীষণ সেন রাতের অন্ধকারে রাজকোষ লুট করে নেয়। বিরাজ বুঝতে পারে—তার ভাই নিজেই বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত। রক্তমাংসের সম্পর্ক ছিন্ন করে সে পালিয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা এখানেই শেষ হয়নি।

মহীধর, নিজের গোপনতা রক্ষা করতে, আমাকে দিয়ে জাল অভিশাপ রচনা করান। ঘোষণা হয়—বিরাজ রাজদ্রোহী।

আর আমি, অগ্নিবীর—প্রজাদের সামনে দাঁড়িয়ে, বিরাজের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করি। কিন্তু আমি জানতাম, আমি মিথ্যে বলছি। জানি, এই বিশ্বাসঘাতকতার অংশীদার আমি নিজেও। রাজা, কোষাধ্যক্ষ, পুরোহিত—সবাই রক্তে মাখা হাত নিয়ে বসেছিল সিংহাসনে। এই মৃত্যু মঞ্জিল তখন থেকেই অভিশপ্ত হয়ে পড়ে।”

তন্ময় কাঁপা কণ্ঠে বলল, “এটা শুধু বিশ্বাসঘাতকতা নয়, এটা একটা সমগ্র রাজ্যের চরম ভাঙন। আমরা কি এই অতীতের দায় বইছি?”

ঠিক তখনই দেয়ালের এক কোণায় আবার জ্বলে উঠল আগুনের ছায়া। এক ভিডিও বা দর্শনের মতো দৃশ্য দেখা গেল:

রাজদরবার। রাজা মহীধর হাসছেন। কোষাধ্যক্ষ ভীষণ সেনের হাতে এক ঝুলি সোনার মুদ্রা। বিরাজ ধীরে ধীরে সিংহদুয়ার ছাড়ছে। আর অগ্নিবীর দাঁড়িয়ে—নীরব।

ঐন্দ্রিলা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “এই দৃশ্যে... আমাদের মুখ!” “তুমি অগ্নিবীর! আমি সেই রাজশিল্পী! তন্ময়... সে ছিল বিরাজের বন্ধু! আর ভাস্কর... সে ছিল সিংহদুয়ারের প্রহরী!”

ভাস্করের চোখে জল। সে বলল, “আমরা সবাই জানতাম সত্য। তবু চুপ ছিলাম।”

ঠিক তখনই সেই আগুনের ছায়া বলে উঠল, “প্রাচীন পাপ কখনও মুছে যায় না, যদি না তা স্বীকার করা হয়।

তোমাদের সত্য জানার সাহস হয়েছে। এবার সময় এসেছে শোধনের। এই মৃত্যু মঞ্জিলেই লুকিয়ে রয়েছে সেই কোষাধ্যক্ষের রক্তমাখা মুখোশ। যে মুখোশ চেয়েছিল ক্ষমতা, পেয়েছিল মৃত্যুর অভিশাপ।”

এক হাড়জিরজিরে হাত উঠে এল মেঝে ফুঁড়ে। হাতে সেই রক্তাক্ত মুখোশ।

ঐন্দ্রিলা ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমাদের কাজ শুধু ইতিহাস জানা নয়। সত্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে এই অভিশাপ ভাঙতে হবে।”

হঠাৎ একটি দরজা খুলে গেল। সামনে এক গোপন সিঁড়ি। নিচে গভীর অন্ধকার। দেয়ালে আগুনের শব্দে ভেসে এল—

“তৃতীয় পাপ তোমাদের অপেক্ষায় আছে। সেই পাপ—ঘুমিয়ে আছে অগ্নিকুণ্ডের নিচে। যেখানে মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর কিছু লুকিয়ে রয়েছে…”

চারজন একে একে সেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল।পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল নিজে থেকেই।

(৬)

নিচে নেমে এলো অর্ণব, ঐন্দ্রিলা, তন্ময় আর ভাস্কর। সিঁড়িগুলো আঁকাবাঁকা, স্যাঁতস্যাঁতে। বাতাস ভারী, যেন কোনো চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে দূর থেকে। প্রতিটি ধাপে পাথরের গুঁড়ো ঝরে পড়ছে, আর পায়ের নিচে জমে থাকা শ্যাওলা পিচ্ছিল করে তুলেছে পথ। টর্চের আলোয় তারা দেখল, দেয়ালজুড়ে খোদাই করা প্রাচীন প্রতীক আর অসম্পূর্ণ ছবি—মানুষের কাঠামো, আগুনের শিখা, আর কিছু অশুভ প্রাণীর অবয়ব।

সিঁড়ি শেষ হতেই তারা একটি বিশাল গোলকক্ষে এসে পৌঁছাল। ঘরের মাঝখানে একটি বিশাল অগ্নিকুণ্ড, যা নিভে গেছে বহু বছর আগে। তবুও তার চারপাশে পোড়া কাঠের কটু গন্ধ, আর দেয়ালের গায়ে পোড়া ছাইয়ের দাগ। ঘরের এক কোণে একটি পাথরের ফলক, তার উপর লেখা— "পাপ ৩ : অগ্নিকুণ্ডের আত্মাহুতি"।

ঐন্দ্রিলা এগিয়ে গিয়ে ফলক স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের গায়ে দপ দপ করে জ্বলে উঠল আগুনের শিখা। শিখার আলোয় স্পষ্ট হলো একটি ছবি—একজন নারী, যাকে শেকল দিয়ে বেঁধে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তার চোখে অসহ্য যন্ত্রণা আর মুখে শেষ প্রার্থনা।

অর্ণব বিমূঢ় হয়ে বলল, "এটা কী? আর একজন বলি?"

অগ্নিবীরের কণ্ঠ ভেসে এলো— "হ্যাঁ, এই ছিল শেষ এবং সবচেয়ে জঘন্য পাপ। রাজা মহীধরের ক্ষমতার লোভ যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছোট রাজ্যের রাণী লীলাবতীকে বন্দি করল। রাণী লীলাবতী ছিল সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। কিন্তু মহীধর চাইছিল তার রাজ্য দখল করতে, এবং লীলাবতীকে দিয়ে রাজপরিবারের সমস্ত গুপ্তধন ও ক্ষমতার গোপন তথ্য আদায় করতে।"

আগুনের ছায়ায় ভেসে উঠল সেই দৃশ্য: রাণী লীলাবতীকে জোর করে টেনে আনা হচ্ছে অগ্নিকুণ্ডের সামনে। রাজা মহীধরের মুখ রক্তপিপাসায় উজ্জ্বল। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভীষণ সেন আর কিছু সৈন্য। আর একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিবীর, তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ।

অগ্নিবীরের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল— "আমি, অগ্নিবীর, জানতাম এই আত্মাহুতি হবে এক নিষ্পাপ নারীর। জানতাম, এর ফলে রাজ্যের উপর নেমে আসবে মহাবিপর্যয়। আমি পুরোহিত হিসেবে যজ্ঞের নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু আমার হাত কাঁপছিল। আমি তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাজার আজ্ঞা লঙ্ঘন করার সাহস ছিল না। যখন লীলাবতীকে আগুনে নিক্ষেপ করা হলো, সে শেষবার চিৎকার করে বলেছিল— 'আমার আত্মা এই ভূমিতেই আটকে থাকবে। যত দিন না রাজা মহীধর ও তার সব পাপের শোধ নেওয়া হয়, এই স্থান অভিশপ্ত থাকবে। আমার আত্মা মুক্তি চাইবে, এবং যে আমাকে জাগাবে, সে আমার শৃঙ্খল ভাঙবে এবং আমাকে সত্য উন্মোচনের পথে নিয়ে যাবে!'"

তন্ময় ফিসফিস করে বলল, "সেই সাদা পোশাকের নারী… যাঁর কান্নার কথা অর্ণবের বাবা বলেছিলেন… ইনিই কি সেই রাণী লীলাবতী?"

অর্ণব মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ইনিই। তার কান্না তিস্তার শব্দে মিশে যেত… তার মুক্তি চেয়েছিল 'কেউ'। আমার বাবা যা অস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, সেটাই আজ স্পষ্ট হলো।"

ভাস্কর ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এলো, তার চোখে জল। "এই পাপ… এটা শুধু রাজার পাপ নয়। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ।"

অগ্নিকুণ্ডের নিচ থেকে একটা আলো জ্বলে উঠল। তার মধ্যে ভেসে উঠল একটি পাথরের মূর্তি—একজন নারীর, যার মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত। তার হাতে ধরা একটি ছোট তামার পাত্র, যার ভেতর থেকে মৃদু ধোঁয়া বের হচ্ছে।

অগ্নিবীরের কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল— "তোমরা তিনটি পাপের কাহিনি জেনেছ। শ্মশানের বলি, রাজকোষের বিশ্বাসঘাতকতা, এবং অগ্নিকুণ্ডের আত্মাহুতি। এই সব পাপের শিকল বেঁধে রেখেছিল আমাকে এবং রাণী লীলাবতীর আত্মাকে। এবার সময় এসেছে অভিশাপ ভাঙার। এই তামার পাত্রে রয়েছে শোধনের মন্ত্র। যে সাহস করে এই মন্ত্র পাঠ করবে, সে মুক্তি দেবে আমাদের। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিটি শব্দে থাকবে আমাদের সব যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। যে এটি পাঠ করবে, তাকেই বহন করতে হবে এই ইতিহাস।"

ঐন্দ্রিলা এগিয়ে গেল। "আমি পড়ব। আমরা এতদূর এসে এখন পিছিয়ে যাব না।"

সে কাঁপা হাতে তামার পাত্র থেকে একটি পোড়া তালপাতার পুঁথি বের করল। তার উপর অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা একটি মন্ত্র। ঐন্দ্রিলা শ্বাস নিল গভীর করে, তারপর উচ্চস্বরে পাঠ করতে শুরু করল সেই মন্ত্র―

"অগ্নি সাক্ষী, রক্ত সাক্ষী, সত্যের শপথে আমি করি অঙ্গীকার। পাপের শৃঙ্খল ভাঙুক, মুক্তি পাক আত্মা—যারা ছিল নিরপরাধ। অগ্নিবীর, তুমি জাগো, পাপের হিসাব আজ সম্পূর্ণ হোক। অতীতের ছায়া মুক্ত হোক, সত্যের জয় হোক, অভিশাপ মুছে যাক।"

মন্ত্র শেষ হতেই পুরো কক্ষ কেঁপে উঠল। অগ্নিকুণ্ড থেকে দপ করে জ্বলে উঠল এক বিশাল শিখা। সেই শিখার মধ্যে রাণী লীলাবতীর মূর্তি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল, তার মুখ থেকে যন্ত্রণার ছাপ মুছে গিয়ে শান্ত ভাব ফুটে উঠল। অগ্নিবীরের আবছা অবয়বও মূর্তির পাশে ভেসে উঠল।

তারা একসঙ্গে বলল, "আমরা মুক্ত!"

তারপর ধীরে ধীরে দুটি অবয়বই মিলিয়ে গেল আগুনের শিখায়, যেন এক অনন্ত আলোয় মিশে গেল তারা। অগ্নিকুণ্ডের শিখা ধীরে ধীরে নিভে গেল। কক্ষের সমস্ত আলো ফিরে এলো, যেন দীর্ঘদিনের অন্ধকার দূর হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।

অর্ণব দেখল, ঘরের দেয়াল থেকে পোড়া ছাই আর শ্যাওলা খসে পড়ছে। তামার ফলকগুলো চকচক করছে, এবং বাতাস থেকে সেই দমবন্ধ করা গন্ধ উধাও হয়ে গেছে। যেন বাড়িটা নিজেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুক্তি পেল।

ভাস্কর অবাক হয়ে বলল, "সব শেষ? ওরা মুক্তি পেল?"

তন্ময় হাসল। "হ্যাঁ, মনে হয় পেয়েছে। আর এই মৃত্যু মঞ্জিল… এটা হয়তো এখন আর 'মৃত্যু মঞ্জিল' থাকবে না।"

তারা যখন উপরে উঠে এলো, দেখল সূর্য হেসে উঠেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে জঙ্গল মুখরিত। বাড়ির চারপাশের নীরবতা ভেঙে গেছে, যেন এক দীর্ঘ অভিশাপের অবসান ঘটেছে।

অর্ণব জানালার বাইরে তাকিয়ে এক গভীর শ্বাস নিল। "বাবা বলেছিলেন, 'মৃত্যু মঞ্জিল… একদিন যদি আমার না বলা গল্পটা কেউ জানতে চায়, তবে সে তুই হবি।' আজ আমি সেই গল্পটা জেনেছি। এটা শুধু একটা ভূতের গল্প ছিল না, এটা ছিল এক গভীর ইতিহাসের আর্তনাদ, যা মুক্তি চেয়েছিল।"

ঐন্দ্রিলা অর্ণবের পাশে এসে দাঁড়াল। "আমরা শুধু ঐতিহাসিক নই, অর্ণব। আমরা সেই নীরবতার সাক্ষী ছিলাম, আর আজ আমরা সেই নীরবতা ভেঙেছি। নতুনভাবে জীবন শুরু করার শক্তি পেয়েছি।"

ভাস্কর হাসিমুখে ক্যামেরা বন্ধ করে বলল, "আমার কাছে একটা অসামান্য ডকুমেন্টারি আছে। এটা কেবল একটা বাড়ি বা ভূতের গল্প নয়, এটা সত্যের জয়।"

তন্ময় গেটের দিকে তাকিয়ে বলল, "চলো, এবার ফেরার পালা। কিন্তু এই স্মৃতি… এটা আমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকবে।"

তারা চারজন গেটের দিকে পা বাড়াল। পিছন ফিরে তাকাল না। কারণ, তারা জানত, মৃত্যু মঞ্জিলের অভিশাপ এখন আর নেই। সেটি এখন কেবল একটি পুরোনো বাড়ি, যা নিজের বুকের ভেতর ধারণ করে রেখেছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস, আর তার মুক্তির দীর্ঘশ্বাস।

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.