ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া | ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | ভ্রমণ ৪
পূজাবার্ষিকী আর পুজোর বেড়ানো, দুর্গাপুজোর উৎসবমুখর আনন্দ হুল্লোরের পাশাপাশি এ দুটির সঙ্গেও বাঙালির প্রাণের যোগ চিরকালের। একেবারে ছোট থেকেই বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে যায় পুজোর ছুটিতে ঘর থেকে দু পা বাইরে ফেলে জগৎ ঘুরে দেখার দুর্বার ইচ্ছে, জগৎ জানার অদম্য অনুসন্ধিৎসা। বলা বাহুল্য এ নিয়মের ব্যতিক্রম নই আমিও। সেই কোন কৈশোরবেলা থেকে এই পরিণত বয়স অবধিও নিরন্তর চলছে এই চরৈবেতি পর্ব। কাছেপিঠের পাশাপাশি আরও যেসব জায়গায় একাধিকবার যাওয়া হয়েছে এই পুজোর ছুটিতে ঘোরার নেশায় তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরের জানুয়ারির বাইশে এই উত্তরপ্রদেশেরই অযোধ্যায় যখন বহু প্রতীক্ষিত রামমন্দিরের উদ্বোধন হল তখন থেকেই অযোধ্যায় যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে আমাদেরও। এরপর প্রায় বছর খানেকের পরিকল্পনা শেষে সকলের সময় ব্যস্ততা সুবিধা ইত্যাদি বিবেচনা পুনর্বিবেচনা করে অবশেষে পাটনা হয়ে অযোধ্যাধাম পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত হয়। আসলে এই পাটনা হয়ে যাওয়ার সুপ্ত আকর্ষণটি ছিল নালন্দার ধ্বংসাবশেষ দেখা। পাটনার ঠিক আগের স্টেশন বেগুসরাই থেকে গাড়িতে নালন্দা ঘন্টা দুয়েক। এই বেগুসরাই থেকেই নালন্দা দেখব বলে ঠিক করি আমরা। তবে বেগুসরাইতে নামলেও গাড়ি কিন্তু আমরা পাটনা থেকেই বুক করেছিলাম যা বেগুসরাই এসে আমাদের তুলে নিয়ে নালন্দা ঘুরিয়ে সন্ধ্যেবেলায় পাটনায় ছেড়ে দেয়। তবে সবকিছু আগে থেকে প্ল্যানমাফিক ছকে রাখলেও দিনের দিন প্রথমেই বিধি বাম! নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ভোর ছটার বন্দে ভারতে আমরা যখন ঠিক সকাল দশটায় বেগুসরাই পৌঁছই, স্টেশনে নেমে দেখি কথামতো গাড়ির দেখা নেই! অনেকক্ষণ চেষ্টার পর কথাবার্তা বলে শেষমেষ যা জানা গেল তা হল বেগুসরাইয়ের শহরাঞ্চল ছেড়ে বেড়োতেই যে রেলের ক্রসিং পড়ে সেখানে রেললাইনের ওপর স্থানীয় গাঁয়ের মানুষজনের বিশাল ধর্না বসেছে। ফলে রেল চলাচল তো বেগুসরাইয়ের পর থেকে বন্ধই, ক্রসিঙের দুদিকেও মাইল দেড় দুয়েকের দীর্ঘ গাড়ির লাইন। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি পাটনার দিক থেকে এসে লাইনের ওপারে জ্যামে আটকে আছে, এদিকে ঢুকতে পারছে না। এখন আমরা যদি কোনও একটা গাড়ি জোগাড় করে ক্রসিং অবধি পৌঁছে রেললাইন পেরিয়ে ওপারে যেতে পারি তাহলে ড্রাইভার আমাদের গাড়িতে তুলে নেবে। অভাবনীয় এ পরিস্থিতিতে অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে শেষে বেগুসরাই স্টেশনের বাইরে থেকেই একটি স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিয়ে দিলাম আমরা। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখি মাঠ ঘাট রাস্তা রেললাইন জুড়ে সব বয়সী স্থানীয় মেয়ে পুরুষের উত্তেজিত বিশাল জটলা আর দুদিকের গোটা রাস্তা ধরেই গাড়ি অটো লড়ি ভ্যানের দীর্ঘ নট নড়নচড়ন লাইন। শোনা গেল এই জায়গাটিতেই গ্রামের একটি নাবালিকা মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের কারণে উত্তেজিত বাসিন্দারা রেল অবরোধ করে চলেছে ভোর থেকে। এখন প্রশাসনিক কর্তারা না এলে এরা কিছুতেই উঠবে না। যে খবর দুদিন বাদে বাদেই খবরের কাগজের পাতায় পড়ে ব্যথিত ক্রুদ্ধ ক্ষতবিক্ষত হই ভেতরে ভেতরে, দৈনন্দিনের একঘেয়ে বিবর্ণ ঘেরাটোপ থেকে বাঁচার আশায় প্রথম পদক্ষেপটি বাইরের দুনিয়ায় ফেলতেই সম্পূর্ণ অভাবিতভাবে আবারও সেই ভীষণ নির্মম সত্যেরই মুখোমুখি হয়ে পড়তে হল। ঘটনাটা শুনেই মনটা তেতো হয়ে গেল মুহুর্তে। অথচ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাও যায় না। সঙ্গে দুজন বয়স্ক সদস্য। কোনমতে এরপর দুই গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা বলে সমস্ত ছোট বড় মালপত্র নিজ দায়িত্বে বয়ে প্রায় কিলোমিটার দুয়েক পায়ে হেঁটে রেলের লাইন পেরিয়ে ওপারে গিয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠলাম। তারপর অন্তত শ পাঁচেক অপেক্ষমান বিভিন্ন গাড়ির সর্পিল দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে অবশেষে গন্তব্যের দিকে রওনা দিল আমাদের গাড়ি। পুজোর বেড়ানো হল শুরু।
শিক্ষা জ্ঞান ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে আদিকালে বিহারের নালন্দা ছিল জগৎ বিখ্যাত। অনেকটা সময় প্রথমেই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা নালন্দা গিয়ে পৌঁছই বিকেলের দিকে। তবে দিনশেষের পড়ন্ত আলোয় নালন্দার হারিয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষের অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে, বিস্তৃত কেয়ারি করা সবুজ বাগান জোড়া সরু পায়ে চলা পথে হাঁটতে হাঁটতে মন শান্ত হয়ে এল একসময়, নিজেরই এ পোড়া দেশকে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোয় পুনর্বার চিনলামও যেন নতুন করে, সচেতনভাবেই গর্ব বোধ করলাম একজন ভারতবাসী হিসেবে। নালন্দার খোলা বিস্তীর্ণ মাঠের বুক জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হারিয়ে যাওয়া সোনালি ইতিহাস শরীরে মেখে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সার সার ইঁটের দেওয়াল, ছাত্রদের থাকার কেবিন ও ডরমিটরি, শস্য গোলা, বিশালাকার গভীর কুয়ো, পাঠদানের ছড়ানো জায়গা, ধ্যান ও প্রার্থনার খোলা চত্বর। কোথাও কোথাও আবার এই ইঁটের ফাঁকেই জন্ম নিয়েছে ছোট্ট কচি সবুজ উদ্ভিদের দুটি পাতা, যেন মৃত অতীতের বুকে আশাভরা আগামীর সহজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ! কী আশ্চর্য স্বাভাবিক এই সহাবস্থান! কী ভীষণ অনায়াস এই আপাত বৈপরীত্যের মিলন! কিছু দৃশ্য জীবনে মন ছুঁয়ে যায় নিঃশব্দেই। আশ্চর্য এই যে, বিশ্বজোড়া অতীত গরিমায় ঋদ্ধ নালন্দার পথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ভাঙাচোরা দেয়ালের ফাঁকে হঠাৎই চোখে পড়ে যাওয়া ওই দুটি নরম কচি সবুজ পাতার অনন্য সুন্দর দৃশ্যটুকুই নালন্দা ভ্রমণের একমাত্র সুখস্মৃতি হয়ে আমার মনে গেঁথে রয়েছে আজও, অন্য কিছু নয়! নালন্দা ঘিরে পাহাড়প্রমাণ দারুণ সব জরুরি তথ্যের অনাবশ্যক ভার নয়, ওর অন্তরের ওই আলোটুকুই প্রাণ ছুঁয়ে আছে কেবল।
পরদিন ভোরে পাটনা জংশন স্টেশন থেকে আমরা অযোধ্যা রওনা হই বন্দে ভারতে। ট্রেনটি পাটনা থেকে ভোর ঠিক ছটা পাঁচে ছেড়ে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ অযোধ্যাধাম স্টেশনে পৌঁছয়। এর মধ্যে সকাল নটায় পড়ে বেনারস। এই বেনারস থেকেই গাড়িতে ভীষণ ভিড় হয়ে গেল। এবং সেই ভিড়ে বাঙালির সংখ্যাই দেখলাম সিংহভাগ। আসলে গতবার বরাবরের বেনারস লক্ষ্ণৌ পুজোর ট্যুরের সাথে রামমন্দিরের কারণে অযোধ্যা ছিল সকলের কাছেই অবশ্য সংযোজন। তবে এ বছর মহাকুম্ভের সময়েও প্রয়াগ থেকে ফেরার পথে অযোধ্যাধাম ও বেনারসে অসম্ভব জনসমাগম হয়েছে। যাই হোক, যথাসময়ে অযোধ্যাধাম স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছলে প্ল্যাটফর্মে নেমেই বুঝলাম যে মহা ধুমধাম করে অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনটুকু হয়ে গেলেও শহরব্যাপী বিপুল নির্মাণকার্যের অধিকাংশই এখনও বাকি। স্টেশনেরও সামনের কিছু অংশ বাদে কাজ প্রায় কিছুই হয়নি। মন্দিরের অবস্থাও তথৈবচ। তবে দিনরাতের শিফট মেনে সারা শহর জুড়েই কাজ এগোচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে, এবং, এটা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে এভাবে চলতে থাকলে আগামী বছর দশেকের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশের এই ছোট শহরটি সেই সত্যযুগের রামায়ণে বর্ণিত সুন্দরী অযোধ্যানগরীতেই আবার পর্যবসিত হবে। সে লক্ষ্যপূরণে পেশা নির্বিশেষে আমজনতার অক্লান্ত দায়বদ্ধতাটি গোটা শহরের পথে ঘাটে সর্বত্র ভীষণরকম চোখেও পড়েছিল প্রতি মুহূর্তে।
আমরা অযোধ্যায় ছিলাম দু রাত তিন দিন। রীতি অনুযায়ী এখানে প্রথমে সরযূতীরে সরযূ বন্দনা ও আরতি এবং হনুমানগড়িতে পুজো দিয়ে তারপর রামলালা দর্শনের প্রথা। আমরাও সেই নিয়ম মেনে প্রথম দিন সন্ধ্যায় সরযূ ঘাটের আরতি দেখতে যাই। বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটের চোখধাঁধান গঙ্গা আরতির মতো জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও এ আরতির অকৃত্রিম সহজ ভক্তি ও সরলতা মন ছুঁয়ে যায়। অযোধ্যাধামে শ্রীরামজন্মভূমি চত্বরের ঠিক মধ্যস্থলে নবগঠিত রামমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রামলালা যেহেতু আদতে হিন্দুধর্ম স্বীকৃত কোনও উপাস্য দেবতা নন, বরং ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসেবেই মান্য, তাই প্রথামতো মন্দিরের গর্ভগৃহে চার বেলা কেবল তাঁর আরতিই হয়ে থাকে, কোনপ্রকার পুজো হয় না। আগ্রহী ভক্তদের এই আরতি দর্শনের কুপন আগের দিন মন্দিরের মূল গেটের সামনে অবস্থিত কাউন্টার থেকে বিনামূল্যে আধার কার্ড দেখিয়ে সংগ্রহ করতে হয় এবং সেইমতো পরদিন ভোর চারটের মঙ্গল আরতি, ভোর সাড়ে ছটার শৃঙ্গার আরতি, দ্বিপ্রহরের ভোজন আরতি ও রাত্রির শয়ন আরতি দর্শনের অনুমতি পাওয়া যায়। তবে মঙ্গল, শৃঙ্গার, ভোগ ও শয়ন আরতির মধ্যে ভোর চারটের মঙ্গল আরতিটিই সবচেয়ে মনোলোভা। মন্দির প্রাঙ্গন থেকে দিনের এই প্রথম আরতিটি শুরু হতেই অপূর্ব রামনাম ভজন মাইকে মাইকে চতুর্দিকে প্রচারিত হতে থাকে। আমরা মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকেই একটি হোমস্টেতে ছিলাম। ফলে মঙ্গল আরতি অদর্শনে খেদ থাকলেও সেদিন নিদ্রাভঙ্গ কিন্তু হয়েছিল মন্দির থেকে ভেসে আসা ভোরের এই ভজনসঙ্গীতের অপূর্ব সুরেলা ধ্বনিতেই। সে সত্যিই এক অনন্য সুন্দর অনুভূতি। সম্পূর্ণ অপার্থিব, সম্পূর্ণ ব্যাখ্যাতীত।
শৃঙ্গার আরতির জন্য মন্দির কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো ভোর ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আমরা রিপোর্ট করি মন্দিরের মূল গেটে। এই গেট থেকে ব্যারিকেড নির্ধারিত লাইন ধরে এঁকেবেঁকে অনেকটা পথ হেঁটে তবে মূল রামমন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছানো যায়। এই প্রাঙ্গনের অন্দরেও মূল মন্দিরকে ঘিরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে। আসলে অযোধ্যায় জানুয়ারির বাইশে কেবলমাত্র মূল মন্দিরের ভেতরে রামলালার মূর্তির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনটুকুই হয়েছিল। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক সেজে উঠতে অযোধ্যাধাম স্টেশন, শহরের ভেতরের বিস্তীর্ণ অংশ, এমনকি শ্রীরামজন্মভূমি ও মূল মন্দিরের ভেতর ও বাইরের বিশাল অংশ জুড়ে দিনরাতের শিফটে পুরোদমে এখনও চলছে নির্মাণ কাজ। হেঁটে মূল মন্দির চত্বরে পৌঁছে রামলালা দর্শনে ওঠার আগে জুতো দুখানি সিঁড়ির পাশে নির্দিষ্ট স্থানে খুলে রেখে অনেক ক’টি সিঁড়ি বেয়ে তবে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করা যায়। একদম ভেতরে নিকষ কালো পাথরে নির্মিত অপরূপ রামলালার বিগ্রহটি গর্ভগৃহের ঠিক মধ্যিখানে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে মূল মন্দিরের প্রাঙ্গনে পা রাখামাত্রই বহুদূর থেকে সোজাসুজি তাঁর চোখে চোখ পড়ে, এমনই অবিশ্বাস্য এ মন্দিরের নির্মাণ! এবং, রামলালার সাথে অলৌকিক এই দৃষ্টিবন্ধনমাত্রেই রোমকূপে রোমকূপে নিমেষে যেন চাড়িয়ে যায় এক অত্যাশ্চার্য অনুভূতি! শরীর জুড়ে ঢেউ তোলে বোধাতীত আনন্দের শিহরণ! এত করুণাময় সে দুখানি চোখ, অথচ কী নিদারুণ অন্তর্ভেদী! গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন মুহুর্তে বিলীন হয়ে যায় সেই চোখদুটির পানে পূর্ণ হৃদয় মেলে চাইলে! নিজের অস্তিত্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় মুহুর্তে। জগৎ সংসারের সব দুঃখ কষ্ট শোকের ওপরে উঠে নিজের সঙ্গে নিজেরই যেন পলকে চোখাচোখি হয়ে যায় দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের সব ভণিতা, সব ভণ্ডামি, সব অসততার জাল ছিঁড়ে! লক্ষ আলোকবর্ষের বেগে নিমেষে মনশ্চক্ষের সামনে দিয়ে এক ছুট্টে পেরিয়ে যায় নিজের এযাবৎকালের ভুল ত্রুটি দৈন্যতায় ভরা ধূসর অতীত জীবন, আর, সেই সাথেই ঝলসে ওঠে তার প্রেক্ষিতে জীবনে নিজের প্রকৃত অবস্থানটিও। প্রকৃত ভক্তের কাছে এ রামরাজ্যে তাই যথার্থই কেবল সেই অটল সত্যেরই বিরাজ যেখানে সব ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতা ও মলিনতার ওপরে উঠে শেষমেষ নিজেকেই খুঁজে পাওয়া যায়। তাই এ শহরে কাজ থেকে ফাঁক পেলেই স্বেচ্ছায় শ্রীরামজন্মভূমির পবিত্র রামপথ ঝাঁট দিতে আসে অযোধ্যার সাধারণ কোনও নামগোত্রহীন মোটবাহক, ভোর থেকে রাত অবধি রামলালা দর্শনে আগত বৃদ্ধ চলৎশক্তিহীন ভক্তের জন্য নিঃশুল্ক হুইলচেয়ার সেবা দেয় শহরের বিত্তশালী কোনও পরিবারের একমাত্র পুত্রও।
অসম্ভব আপাতবিরোধী এই সহাবস্থানটুকু বোধহয় কেবলমাত্র এ রামরাজ্যেই সম্ভব। আসলে শাস্ত্র নির্ধারিত লক্ষ আচার বিচার নিয়মের বেড়াজালে শেষপর্যন্ত যতই বাঁধা পড়ুক না আমাদের রোজকার সনাতনী ধর্মসংস্কার, ঈশ্বরে বিশ্বাস যে আসলে এই তথাকথিত বাহ্যিক শুচিতার অনেক অনেক ঊর্ধ্বে, তা যে শেষপর্যন্ত একান্তই ব্যক্তিগত ও আত্মিক এক উপলব্ধি, নিঃশর্ত আত্ম অণ্বেষণ ও আত্মদর্শনেই যার পরম পূর্ণতা, যেকোনও পুণ্যধামের প্রতিটি বিন্দুতেই বুঝি ছড়িয়ে আছে তার অকাট্য প্রমাণ। অযোধ্যাও তাই ব্যতিক্রম নয়। শুধুমাত্র একটা বিশ্বাসে ভর করে আজকের উত্তর আধুনিক যুগেও কীভাবে একটা গোটা শহর প্রবল আত্মশক্তিতে জেগে উঠতে পারে তার যথার্থ উদাহরণ আজ এই শহর। আমি ব্যক্তিগত স্তরে কী বিশ্বাস করি বা না করি তার ওপরে উঠে এক বৃহত্তর সমষ্টির আন্তরিক অটল বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়ার জন্যেই তাই হয়তো সব ভারতবাসীর একবার হলেও অযোধ্যায় পদার্পণ করা উচিৎ। এবং, বহু যুদ্ধ পেরিয়ে, বহু রক্ত ঝরিয়ে এসে আজ যে অযোধ্যার হৃদয়ে রামলালার পবিত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার মান রাখার মতো সুমসৃণ ব্যবস্থাপনাও এখানে মন্দির কর্তৃপক্ষ ও সরকারের প্রশাসনিক তরফে পদে পদে চোখে পড়ল। ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণা থেকে আগত ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের ও ভাষার হিন্দুদের আশ্চর্য মিলনস্থল এখন এই শহর। এবার কথা হচ্ছে এর মধ্যেও ব্যবসায়িক হিসেব কী নেই! খুব স্বাভাবিক নিয়মেই তাও আছে চূড়ান্তভাবেই। কিন্তু তারপরেও এই বিপুল কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ সবেমাত্র গড়ে উঠতে শুরু করা এ নগরীর স্থানীয় বাসিন্দাদের আজ ধীরে ধীরে হলেও অর্থকরী ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের মানোন্নতিই ঘটছে বলে দেখলাম, এবং, শুনলামও। এবং সবচেয়ে বড় কথা, সেটি হচ্ছে জাতি ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষেই। যে বিশাল কর্মযজ্ঞ এ শহর জুড়ে আজ শুধুমাত্র একটি ধার্মিক বিশ্বাসের হাত ধরে শুরু হয়েছে তাকে সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব তর্কবিতর্কের ওপরে উঠে স্রেফ একজন আশাবাদী ও মানবতাবাদী মানুষ হিসেবেই তাই সম্পূর্ণ নতমস্তকে শ্রদ্ধা না জানিয়েই পারলাম না। কালে কালে অযোধ্যানগরী এভাবেই গড়ে উঠুক সকলকে সাথে নিয়ে। বার বার ফিরে আসব দর্শনে। আর শুধু ঈশ্বর নয়, এ ফিরে আসার অঙ্গীকারটুকু রইল এ শহরের আসল আত্মা, এ শহরের প্রকৃত আধার, অর্থাৎ, এর অধিবাসীদের জন্যেও।
অযোধ্যায় শেষদিন সকালে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়েছিলাম মূল শহর ছেড়ে কিছু দূরে গুপ্তার ঘাটের উদ্দেশ্যে। পথে ভরতকুণ্ড ও মন্দির দর্শনও হয়। গুপ্তার ঘাটে সরযূ নদীবক্ষে অযোধ্যাধিপতি শ্রীরামচন্দ্রের জলসমাধি হয়েছিল। ঘাট সংলগ্ন পুরনো মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্রের পদচিহ্ন আজও পূজিত হয় সাড়ম্বরে। গো পূজা ও সেবা এখানকার এক বিশেষ পুণ্য কর্ম। এছাড়া মূল পুরনো ঘাটে সুবিশাল সুসজ্জিত শ্রীরামচন্দ্র ও জানকীমাতার মন্দির এবং একাধিক শিবমন্দিরও আছে। অনতিদূরের নতুন ঘাটে প্রতি সন্ধ্যায় সরযূজী আরতি হয়ে থাকে। আর এই ঘাট ছেড়ে কিছুটা এগোতেই পড়ে গুপ্তার ঘাট যেখানকার নিরিবিলি সবুজে ছাওয়া পরিবেশেই অবস্থিত বিতর্কিত গুমনামীবাবার সমাধিস্থল। সমাধিস্থল সংলগ্ন ফলকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস নামের সাথে তাঁর জন্ম মৃত্যু বিষয়ক প্রকৃত তথ্যাদি খোদিত। গুমনামীবাবা না নেতাজী এই অন্তহীন বিতর্কের শিকড় খুঁজতে একবার হলেও সব বাঙালির গুপ্তার ঘাটের এই সমাধিস্থল ঘুরে যাওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। আজ বাংলা থেকে বহু যোজন দূরে অযোধ্যার সশস্ত্র আর্মি ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত গুপ্তার ঘাটের পারে শান্ত কোলাহলহীন পরিবেশে সর্ব অর্থেই এক কালজয়ী দুরন্ত অগ্নিমানবের অজ্ঞাতপ্রায় সমাধিস্থল দেখে বাঙালি হিসেবে প্রথমবার মনের গহনে একটা চোরা অস্থিরতা উদ্বেল হয়ে উঠল। এতটা নগ্ন কঠিন সত্য শুধু বাঙালি নয়, যেকোনও দেশপ্রেমী জাত্যাভিমানী মানুষেরও ভেতরটা বুঝি মুহূর্তে এপার ওপার একেবারে তীক্ষ্ণ ফলায় ফুঁড়ে দেয়। নিজের সাথে নিজেরই চোখ মেলানো দায় হয়ে ওঠে তখন। সমস্ত অস্তিত্ব চরম অবিশ্বাস্যতার কশাঘাতে মুহুর্মুহু শিহরিত হয়। সরযূতীরের এই গুমনামীবাবা অর্থাৎ নেতাজীর সমাধিস্থলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে বারংবার শুধু একটাই কথা সেদিন মনে হয়েছিল, যে ভীষণ প্রাণময় আদ্যন্ত আগুনে বিপ্লবী মানুষটাকে এতগুলো বছর ধরে বাংলায় আমরা স্রেফ অস্তিত্ব অনস্তিত্বের দোলাচলের ঘোলাটে কুয়াশা পরিবৃত রহস্য করে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছি, তাঁকেই অন্য প্রদেশের তথা দেশেরও বৃহত্তর এক সমষ্টি নির্ভীকভাবে যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে সর্বসমক্ষে কেমন গর্বের সাথে তুলে ধরেছে, সে দেশের রাজধানীর বুকেই হোক, কি এই রামরাজ্য অযোধ্যার সরযূতীরে। বাঙালির কুখ্যাত আত্মবিস্মৃত তর্কবাগীশ চরিত্রের এর চেয়ে লজ্জাজনক উদাহরণ বোধহয় আর হয় না। সমাধিস্থলের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ তাই ভিজে আসে বাঙালি হিসেবে। অথচ গর্ব হয় ভারতবাসী হিসেবে।
অযোধ্যার পর সেবার লক্ষ্ণৌ, প্রয়াগ ও বেনারস হয়ে অবশেষে ঘরে ফিরি আমরা। এতদিন পর পেছন ফিরে দেখলে মনে হয়, ব্যক্তি নিজেকে চেনা ও বাঙালি হিসেবে নিজেকে চেনা, এই দুটো আশ্চর্য জীবনবোধের পাঠ একই সঙ্গে আমাকে শিখিয়েছিল অযোধ্যার ওই দিনগুলো। কিছু উত্তরণের গল্প ছাড়া কোনও ভ্রমণই হয়তো শেষমেষ ঠিক সম্পূর্ণ হয় না। সেদিক দিয়ে অযোধ্যার স্মৃতি এ মনের মণিকোঠায় সত্যিই রয়ে যাবে চির অক্ষয় হয়ে। সেদিক দিয়ে এ ভ্রমণ সত্যিই চিরস্মরণীয়।
Comments
Post a Comment