আমার উত্তরবঙ্গ: স্মৃতিরোমন্থন | বাবলু সাহা | ভ্রমণ ২
আমার এবারের 'তমোহন' পত্রিকার পুজো সংখ্যার বিশেষ লেখাটি পুরোটাই উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্র করে। তবে, এটি কোনও লম্বা লেখা নয়; বলতে পারেন, এগুলি আমার টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজ বা খন্ডচিত্র। আশা রাখি, এই লেখা পড়ে উত্তরবঙ্গের এখনকার নবীন পাঠক - পাঠিকারা খুশি হবেন, এবং যেসব পাঠক - পাঠিকা বর্তমানে এই উত্তরবঙ্গের বুকে শৈশব - কৈশোর-যুবক-তরুণ-মধ্য বয়সে এসে উপনীত হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের সেই সময়ের ফেলে আসা অতীত দিনের স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন। আপনাদের সবার ভালো লাগলে, আমার এই লেখা সার্থক বলে মনে করবো।
আমার প্রথম দেখা হিমালয় এবং দার্জিলিং :-সেটি ছিল ১৯৭৮ সাল, এই মুহূর্তে মাসটা সঠিক মনে নেই। আমরা কয়েকজন প্রায় সমবয়সী আত্মীয় ভাই এবং বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, দার্জিলিং বেড়াতে যাবো। আমরা ছিলাম মোট সাতজন। বয়েস তখন আমাদের ১৮র আশেপাশে হবে। তো, আগেভাগে সেইমত দার্জিলিং মেইল এর থ্রি টায়ার রিজার্ভ টিকিট কাটা হলো। এখন পড়লে অনেকের মনেই হয়তো বিস্ময় জাগবে যে, তখন দার্জিলিং মেইল এ শিয়ালদা থেকে এন জে পি ভাড়া ছিল ২৯টাকা ৩পয়সা। এরসাথে সিট/বাংক রিজার্ভেশন এর জন্য আলাদাভাবে একইসাথে ১০টাকা (অথবা ১৫) দিয়ে আরেকটি টিকিট কেটে এরসাথে জুড়ে দেওয়া হতো।
অবশেষে যাওয়ার দিন এসে গেল। সন্ধ্যায় ট্রেন ছাড়বে, আমাদের প্রত্যেকের মনে উত্তেজনার শেষ নেই, কারণ আমরা কেউই এর আগে কলকাতার বাইরে দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে যাইনি। সন্ধ্যার আগেই সবাই যে যার জায়গা থেকে শিয়ালদা স্টেশনের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে এসে একত্রিত হলো। যথাসময়ে দার্জিলিং মেইল এর ইঞ্জিন গর্জন করতে করতে প্ল্যাটফর্মে এসে দাড়ালো। আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কামরায় উঠে আমাদের সিটের নম্বর মিলিয়ে সঙ্গের ব্যাগ গুছিয়ে বসে পড়লাম। খানিকক্ষণ পরেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। যতদুর মনে পড়ে, সেইসময় দার্জিলিং মেইল এ প্যান্ট্রি কার ছিল।
ট্রেন চলতে শুরু করার পরেও অনেক রাত অবধি জেগে ছিলাম, ফরাক্কা ব্যারেজ দেখব বলে। পরেরদিন সকালের আবছা আলোয় যখন ট্রেন এনজেপির দিকে লাইন ধরে এগোচ্ছে, ঠিক তখনই আচমকা বাম দিকের খোলা জানলা দিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, ওই দূরে আবছা হিমালয়ের সারি দেখা যাচ্ছে। সেই প্রথম নিজের চোখের সামনে হিমালয় পাহাড় এর দৃশ্য দেখলাম মুগ্ধ হয়ে। সেদিনের সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। এরপর বহুবার এই লাইন ধরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় গেছি, এন জে পি হয়ে। কিন্তু সেদিনের সেই ট্রেনের জানলা দিয়ে হিমালয় দেখার অনুভূতি বা উত্তেজনা আর কোনদিন অনুভব করিনি।
সকাল বেলায় এসে নামলাম এনজেপি স্টেশনে, এরপর সকলে মিলে প্রাতরাশ সেরে শিলিগুড়ি থেকে উঠলাম দার্জিলিং এর ছোট বাসে। বাস হিলকার্ট রোড দিয়ে দার্জিলিং মোড় ঘুরতেই চোখের সামনে দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগলো। সারিবদ্ধ পাইন গাছ, একেবারে গা ঘেঁষে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে কু ঝিকঝিক করে খেলনা গাড়ির মতো কয়লার ইঞ্জিনের টয় ট্রেন, রাস্তার পাশেই লেপচা - গোর্খাদের ছোট ছোট ঝুপড়ি খাবারের দোকান, নেপালি শিশুদের হুটোপাটি, পটে আঁকা ছোট্ট সুন্দর স্টেশন, কিছু প্যাগোডা ধাঁচের কাঠের ঘরবাড়ি, চা বাগান। এখনকার মতো এত ঘিঞ্জি ইট কাঠ কংক্রিটের অগোছালো জঙ্গল নয়, ছোট্ট সুন্দর সাজানো গোছানো দার্জিলিং। এভাবে চলতে চলতে একসময় বিকেলে এসে নামলাম দার্জিলিং শহরে। নেমেই আমাদের মধ্যে দু - তিনজন চলে গেল থাকা এবং খাওয়ার জায়গার খোঁজ করতে; বাকিরা অপেক্ষায় রইলাম। বেশ খানিকটা পর তারা ফিরে এসে জানালো আমাদের যার যার লাগেজ ব্যাগ নিয়ে তাদের অনুসরণ করতে। এরপর আমরা যেখানটায় এলাম, সেটি ছিল দার্জিলিং শহরের পুরাতন দমকল অফিস। ঠিক তার পিছনেই ছিল ব্রিটিশ আমলের তৈরী একটি স্থাপত্য শৈলীর লাল রঙের ইটের খিলান বা গেট। উপরে নাম লেখা ছিল 'গ্যাজমা হাউস'।
সেই গেট দিয়ে ঢুকেই বামদিকের একটি একতলা ঘরে, দুটি ঘর আমাদের এইকয়দিনের অস্থায়ী ঠিকানা বা বাসস্থান। সেই প্রথম জানলাম যে, হোম স্টে কাকে বলে। যে মহিলা ঘরভাড়া দিয়েছেন, সেটি তাদেরও থাকার আস্তানা। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ঘরের আসবাবপত্র এবং যা কিছু ছিল, সেসব ছেড়ে দিয়েই আমাদের ঘর দেওয়া হয়েছিল। সংলগ্ন বড় উঠোন ছড়িয়ে সংলগ্ন রান্নাঘরের সামনে আমাদের খাবার জায়গা। প্রসঙ্গত বলে রাখি, একমাত্র এই দার্জিলিং শহরেই দীর্ঘদিন আগে থেকেই এরকম হোম স্টে প্রথা চালু ছিল ট্যুরিস্টদের জন্য।
আর, বর্তমানে পাহাড়ের আনাচে কানাচে যেসব হোম স্টে নামক পুরোপুরি বাণিজ্যিক হোটেল গড়ে উঠেছে, সেগুলিকে আসলে আদৌ হোম স্টে বলা সঙ্গত কিনা, সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। পরেরদিন দার্জিলিং পাহাড়ের আশেপাশে এবং ম্যালেই সময় কাটালাম, চোখের সামনে আরও কাছ থেকে সপার্ষদ কাঞ্চজঙ্ঘাকে দেখে। দ্বিতীয় দিন আমরা ঠিক করলাম যে, সেদিন লালকুঠি যাব। ১৯৭৮, তখন সদ্য হলে মুক্তি পেয়েছে মুখ্য চরিত্রে ড্যানি অভিনীত 'লালকুঠি'; এ ছবির কিশোর কুমারের গান ' কারও কেউ নইতো আমি… ' সেসময়ে আমাদের মুখে মুখে ফিরছে।
আগেই বলেছি যে, তখনকার দার্জিলিং ছিল শান্ত সুন্দর এবং লম্বা লম্বা পাইন গাছের জঙ্গল অনেক বেশি ছিল। আমরা যাওয়ার আগে শুনেছি, পাহাড়ের ঠান্ডায় ব্র্যান্ডি সহজে শরীরকে কাবু করতে পারেনা। সে কথা মাথায় রেখে আমরা ২৫টাকা দিয়ে একটি ব্র্যান্ডির পাঁইট কিনলাম চৌরাস্তার সবচাইতে পুরাতন ওয়াইন শপ থেকে। এরপর আমরা লালকুঠি যাওয়ার শর্টকাট ( যাকে নেপালি ভাষায় বলা হয় চোরবাটো ) পথ জেনে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলাম। অবশেষে এসে পড়লাম কাঠের তৈরী একেবারে লালকুঠির চৌহদ্দির মধ্যে।
অবাক হয়ে দেখি, বাইরে তখনও শ্যুটিং এর একেবারে শেষের দিকে ব্যবহৃত জিপটি সামনের উইন্ডস্ক্রিন এর কাচ ভাঙ্গা অবস্থায় প্রবেশপথের মুখেই রাখা আছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে, যে বা যাঁরা এই লালকুঠির পূর্বতন ইতিহাস বা এর ঐতিহ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নয় ( পাঠকদের জ্ঞানকে ছোট না করে ), তাঁদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি কথা জানিয়ে রাখি; দার্জিলিং এর এই ' লালকুঠি ' তৈরি করেন তৎকালীন স্বাধীন কোচবিহার এর মহারাজা প্রসাদ নাথ রায়, ওনার ভালোবাসার স্ত্রী, রানী ভবানীর স্মৃতি রক্ষার্থে। সেসময় নাম ছিল গোরি বিলাস বা গোরি উইলাস। এবং এরসাথে অপূর্ব স্থাপত্য শৈল এবং রোম্যান্টিক গাথা জড়িয়ে থাকার কারণে, এটিকে অনেকে বলতেন প্রসাদ নাথ রায়ের তাজমহল।
এর চারিদিকের রডোডেনড্রন, পাইন এবং বিভিন্ন ধরণের ম্যাগনোলিয়া দিয়ে ঘেরা ছিল। এই গোরি বিলাস সেসময়ে সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশদের এবং ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি আমোদ প্রমোদের জায়গা ছিল। এখানকার নিত্য মজলিসের আসরে বা পার্টিতে অনেক উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ আমলা হাজির হতেন।
এভাবে গোরি বিলাস এর প্রতি তাদের ক্রমাগত আকর্ষণ তাদেরকে মহারাজের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে প্রারচিত করে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দখল করে নেয়। তাদের কুযুক্তি ছিল, মহারাজ এই জায়গাটি ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ করতে অক্ষম। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও ব্রিটিশরা এই জায়গাটি খালি রেখে দিয়েছিল। ভারত সরকার অধিগ্রহনের আগে এটি একটি অস্থায়ীভাবে তিব্বতি স্কুল হিসেবে চলতো।
পরে এটি অতিথিশালায় রূপান্তরিত হয়েছিল এবং তারও পরে ভারতীয় অফিসারদের জন্য একটি ছুটির আবাসস্থল হিসেবে পরিবর্তিত হয়েছিল। পরে, পূর্বের এই গোরি বিলাস সৌন্দর্য এবং অবস্থানগত কারণে, বেশকিছু হিন্দী এবং বাংলা পরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে, ১৯৭৮ সালে ' লালকুঠি ' মুক্তি পাওয়ার পর, ছবিটি এতটাই হিট বা জনপ্রিয় হয়েছিল ( এবং এ ছবির গান ও ড্যানির অভিনয় ) যে, যার কারণে এই গোরি বিলাস এর, তারপর থেকে পাকাপাকি নাম হয়ে যায় লালকুঠি। এই লালকুঠি পরবর্তীকালে ডি জি এইচ সি র সচিবালয় এবং কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি জি টি এর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় এবং সচিবালয়।
অনেকটা সময় সেখানে কাটিয়ে, বিকেলের দিকে ফিরে এলাম ম্যালের খোলা জায়গায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখে আমরা সেদিনের মত চলে এলাম আমাদের হোম স্টের ঘরে। এরপর দার্জিলিং নিয়ে বিশদ বিবরণে যাবনা, শুধু মনে রাখার মতো কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনার কথা বলে শেষ করবো। একদিন সকালে সবাই মিলে বেড়িয়েছিলাম দার্জিলিং এর কোন একটি জায়গা দেখার জন্য। অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়ার পরে, আমার সাথে কোনকারণে বন্ধুদের সাথে মনকষাকষি হওয়ায়, আমি একাই পিছন ফিরে ঘরের পথ ধরি। আমাদের থাকার ঘরে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় ৩টে বেজেছে। ভীষণই খিদে পেয়েছিল, ঘরে না ঢুকে সরাসরি খাওয়ার জায়গায় চলে গেলাম।
কিন্তু কিচেনের রান্নার দিদির কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। কারণ আমরা সকালে বেরোনোর সময়ই বলে দেওয়া হয়েছিল যে, সেদিন আমরা দপুরের লাঞ্চ বাইরে করে নেব। আসলে লিমিটেড রান্না হতো শুধু আমাদের এবং কিচেন ও তাদের ঘরের লোকেদের জন্য। এই শুনে আমি মনমরা হয়ে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ শুনি পিছন থেকে সেই রান্নার কুক মহিলা দিদি আমায় ডাকছেন।
আমি কাছে যেতেই, উনি আমাকে রোয়াকের সিঁড়িতে বসতে বলে, কিচেনে ঢুকে একটি বড় থালায় সব্জি ডাল মাছ ভাত যত্ন করে সাজিয়ে এনে আমার সামনে রেখে দিয়ে বললেন ' খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাবে '। আমার খাওয়ার পর জানতে পারলাম যে, উনি যে দুপুরের খাবার আমাকে খেতে দিয়েছিলেন সেসব ওনার জন্য রাখা খাবার ছিল। যেদিন আমরা ফিরে যাব এনজেপি তে, তার আগের রাতে আমরা ঠিক করলাম দার্জিলিং এর একমাত্র সিনেমা হল ব্রিটিশ আমলের ঐতিহ্যশালী ক্যাপিটল থিয়েটার এ নাইট শো এ সিনেমা দেখবো। সেইমত টিকিট কেটে একটি হিন্দী সিনেমা দেখতে গিয়ে তখন বুঝিনি যে, আমিও এর ইতিহাসের সাথে কোনভাবে সাক্ষী রয়ে গেলাম এক বিরল অভিজ্ঞতার।
আমি এটি ভেবে দুঃখিত হয়েছিলাম যে, কেন সমতলের বাঙালি ট্যুরিস্ট এর দল দার্জিলিং এ বেড়াতে এসে, এই প্রাচীন ঐতিহ্যশালী হলটিতে একবার পা রাখেননি বা কোনও সিনেমা দেখার কৌতূহল বোধ করেননি, বরং একে আর পাঁচটা সাধারণ সিনেমা হল ভেবে এড়িয়ে গেছেন। কারণ, পরে দার্জিলিং এর ইতিহাস পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম, এই ক্যাপিটল থিয়েটার হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯১৭সালে লর্ড রোনাল্ডশের তত্ত্বাবধানে।
এরপর ১৯২১সালে তখনকার সময়ে ২,৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হয় এবং এক্ষেত্রেও মোট খরচের অর্ধেক ব্যয় করেছিলেন তৎকালীন কোচবিহারের মহারাজা। এই হলের দর্শক আসন ছিল ৬০০। এরই সাথে লাগোয়া ছিল দার্জিলিং শহরের একমাত্র ক্লক টাওয়ার, যার উচ্চতা ছিল ১০০ফুট। ১৯৯৬ সালে এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে এই ক্যাপিটল থিয়েটার এবং সংলগ্ন ঘড়িঘর এর অনেকটা অংশই পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই ঘড়িটি অচলাবস্থায় বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। এরপর রোটারী ক্লাবের সংযোগিতায় ঘড়িটি পুণরায় সচল হয়ে ওঠে।
বর্তমানে দার্জিলিং পুরসভা বোর্ড এই হেরিটেজ ক্যাপিটল থিয়েটার হল ও তৎসংলগ্ন ঘড়ি টাওয়ারটিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। এখানে একটি মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, দার্জিলিং - হিমালয়ান রেলের ইতিহাস, পর্যটকদের জন্য সেলফি পয়েন্ট এবং একটি স্কাইওয়াক তৈরি হবে। বেদনার এটাই যে, আমার একদিনের স্মৃতির সাথে সাথে আধুনিক উন্নয়নের জোয়ারে পুরাতন গন্ধ জড়িয়ে থাকা ইতিহাসটিও মুছে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এবার ফেরার পালা; আসার সময় বাসে এসেছিলাম, যাওয়ার সময় ঠিক করা ছিল টয়ট্রেনে চেপে শিলিগুড়ি ফিরবো সেইমত টয়ট্রেনে চেপে বসলাম।
নতুন রোমাঞ্চ নতুন অভিজ্ঞতা। যেহেতু জানলার ধারে বসেছিলাম, সেহেতু মাঝে মাঝেই সামনের চলতি ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়ার সাথে কয়লার গুঁড়ো ঢুকে যাওয়ার দরুণ বারবার চোখ কচলাতে হচ্ছিল। অবশেষে শিলিগুড়ি পৌঁছে একরাশ মন খারাপ নিয়ে আবার কলকাতায় ফেরার রাতের দার্জিলিং মেল এ উঠে বসা।
আমার দ্বিতীয়বার শিলিগুড়ি যাত্রা :-
দার্জিলিং যাওয়ার দীর্ঘ ১২বছর পর ১৯৯০ সালে আবার আমার শিলিগুড়িতে পদার্পণ। সেবার আমরা সাতজন বন্ধু মিলে ঠিক করি, পুজোর পর সিকিম এবং নেপাল যাব। হঠাতই সিদ্ধান্ত নেওয়া, সেকারণে ট্রেনের বদলে বাসেই যাব ধর্মতলা বা এসপ্ল্যানেড থেকে উত্তরবঙ্গের রকেট বাসে শিলিগুড়ি। সেই প্রথম আমার রকেট বাসে চড়ে যাওয়া।তার আগে এই রকেট বাস সম্বন্ধে একটি মজার গল্প বলে নিই। সেই ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় থেকে সহপাঠি বন্ধুদের মুখে মুখে শুনে আসছি এই অলৌকিক যান রকেট বাসের কথা, যা কিনা একপ্রকার মিথের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
সে বাস নাকি মানুষের কাছে এক স্বপ্নের জার্নি, একেবারে রকেটের গতিতে উড়ে চলে, অন্য সব দূরপাল্লার বাস একে দেখলেই রাস্তা ছেড়ে দেয়, এই বাসের ড্রাইভারদের আলাদাভাবে ট্রেনিং নিতে হয় এবং আরও অনেক কিছু। তো সেই জীবনে প্রথমবার তো রকেট বাসে চেপে বসলাম, এর আগে ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি বহুবার। যথারীতি বাস ছাড়লো রাত ঠিক ৮টায়, পরেরদিন সকাল প্রায় ১০টার সময়ে বাস এসে থামলো শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ডে। প্রথমেই দুজন বন্ধু গেল হোটেলের খোঁজে, তারা ফিরে এসে জানালো যে হোটেল ঠিক হয়ে গেছে। এখন যেখানে নিউ দিল্লী হোটেল, ঠিক তার পাশেই একটি নতুন নির্মীয়মান হোটেলের দুতলার দুটি ঘরে আমাদের এক রাতের অবস্থান।
এরপর আমরা দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য হিলকার্ট রোডের রাস্তার ধারে একটি সুন্দর সাজানো গোছানো হোটেলে ঢুকলাম। তখনকার শিলিগুড়ি শহর এখনকার মতো ইট কাঠ আর কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়নি, রাস্তার দুধারে অনেক বড় বড় গাছ, ছোট ছোট টিনের চাল দেওয়া ছবির মতো সুন্দর কাঠের ঘরবাড়ি, দোকান, হৈ চৈ কোলাহল অনেক কম।
এই হোটেলটি আমার স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে সারাজীবন, কারণ খাবার টেবিলে বসার পর এক বন্ধু বলে উঠলো 'পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ কারা বসে আছে'; সেদিকে তাকিয়ে আমি যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা যে, সেখানে আমার প্রিয় ক্লাবের হৃদয়ে ঝড় তোলা দুজন ফুটবল খলোয়াড় সস্ত্রীক সুরজিৎ সেনগুপ্ত, যার ইন সোয়ার্ভিং বা বাঁকানো গোলার মত শট এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে, এবং তাঁর ভগ্নিপতি স্ট্রাইকার রঞ্জিত মুখার্জি বসে আছেন। এবং আমরা এবং এনারা চারজন ছাড়া আর বাকী খাবার টেবিল ফাঁকাই ছিল। আজও খুব আফসোস হয়, সেদিন কেন একটা ছবি তুলে রাখিনি বলে। রাতে নামলো তুমুল বৃষ্টি, যদিও পরেরদিন একেবারে পরিষ্কার আকাশ।
সকালেই একটি জিপ বুক করে রওনা দিলাম সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক এর উদ্দেশে। জীবনে সেই প্রথমবার তিস্তার সাথে পরিচিত হওয়া এবং যথারীতি মুগ্ধ ও বাক্যহারা। কোথাও সে শান্ত ধীর স্থির, কোথাও সে তীব্র খরস্রোতা। এখনকার মত উন্নয়ণ এর ধুঁয়ো তুলে, যত্রতত্র অপরিকল্পিত অবৈজ্ঞানিকভাবে বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার গলা টিপে ধরা হয়নি তখনও। এই লেখা যেহেতু উত্তরবঙ্গ নিয়ে, সেহেতু সিকিম প্রসঙ্গে না গিয়ে, ফিরে আসি নেপালে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় ;
সিকিম থেকে ফিরে আরও এক রাত শিলিগুড়ির হোটেলে কাটিয়ে, পরেরদিন রওনা দিলাম পানিট্যাঙ্কি নকশালবাড়ি হয়ে মেচিখোলার উপর ছোট্ট সিমেন্টের সাঁকো পার হয়ে ভারত - নেপাল বর্ডারে নেপালে যাওয়ার প্রবেশপথ কাঁকরভিটায়। এসেই মনে হলো আমি যেন সত্যিই কোন এক বিদেশে চলে এসেছি। আশেপাশেই বহু বিদেশী বিদেশিনীদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়ানো, একটু দূরে দূরেই কাঠের তৈরী ছোট ছোট হোটেল এবং বিয়ার পাব ও বার। বাসস্ট্যান্ড এ গিয়ে কাঠমান্ডু যাওয়ার বাসের সন্ধান নিতে গিয়ে আমাদের তো মাথায় হাত, জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, সেদিনের একমাত্র বাস ছাড়বে সেই বিকেল ৫টায়। অগত্যা ওই কাঁকরভিটাতেই এদিক সেদিক ঘুরে অনন্ত অপেক্ষা। সেসময় কলকাতায় বহুজাতিক সংস্থার তৈরি নরম পানীয় কোকাকোলা, পেপসি ইত্যাদি পাওয়া যেতনা। হাতের কাছেই পেয়ে বেশ কয়েক বোতল ওই ঠান্ডা পানীয়তে গলা ভেজালাম এবং এখানেই প্রথমবার Tuburg, Carlsburg বিয়ার চেখে দেখার সুযোগ পাই।
এভাবেই কেটে গেল সময়, এরপর কাঠমান্ডু যাওয়ার বাস স্ট্যান্ডে এলো বিকেল ৫টায়। আমাদের যাওয়ার টিকিট আগেই কাটা ছিল, বাসের চেহারা দেখেই তো আমাদের আক্কেল গুড়ুম; সাধারণ গদীওলা সিটের মান্ধাতা আমলের লম্বা বাস, সামনে পিছনের প্রতিটি চাকার টায়ারে তাপ্পি মারা। তখনকার কাঠমান্ডু বা পোখরা যাওয়ার রাস্তা ছিল এবড়ো খেবড়ো অমসৃণ। তারউপর আবার বাসের ওই চিঁড়ে চ্যাপ্টা ভিড়ে লোক্যাল মানুষ ছাগল মুরগী নিয়েও উঠে পড়ত। সেই যাত্রা ছিল আক্ষরিক অর্থেই ভয়ংকর বিভীষিকাময়। সেই রোমাঞ্চকর যাত্রার বিবরণ পরে একদিন এই পত্রিকার পাতায় তুলে ধরবো।
এবার শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ির কত কথা :-এরপর থেকে প্রতিবছর পুজোর পর আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ বা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তাম। সেটি ছিল ১৯৯৩ সাল, সেবার ঠিক হলো আমরা এবারে ভুটান যাবো। সেইমত লক্ষীপুজোর পর অর্থাৎ অক্টোবর মাসের শেষের দিকে যাত্রা করবো।
এরপর একদিন ভুটান ভ্রমণ সম্পন্ন করে আমরা চলে এলাম ফুন্টশোলিং বর্ডারের এপারে জয়গাঁও এ। ঠিক হলো সেখানকার একটি হোটেলে সেদিনের রাত এবং পরেরদিন কাটিয়ে তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় ভুটান ট্রান্সপোর্ট এর লাক্সারি বাস ধরে কলকাতায় ফিরব। আচমকা আমার এক সঙ্গী বন্ধু বলে উঠলো, যেহেতু প্রায় একদিনের বেশি সময় যখন হাতে আছে, সেহেতু সে জলপাইগুড়ি যাবে তার কাছের আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে। জলপাইগুড়ির কদমতলায় তার মাসীর বাড়িতে এর আগে কোনদিন যাওয়া হয়নি, তাদের বাড়িতে যাওয়ার বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও। সেই শুনেই আমিও ওরসাথে যাওয়ার জন্য লাফিয়ে উঠলাম, কারণ জলপাইগুড়ি শহরের দিনবাজার এবং রায়কত পাড়ায় আমারও দুজন ঘনিষ্ঠ সুহৃদ তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এরআগে কোনদিন তাদের ওখানে যাওয়া হয়নি।
পরেরদিন ভোরবেলায় একটি ছোট মারুতি ভাড়া করে, দুপুরের পর এসে পৌঁছলাম জলপাইগুড়ি শহরে। একবারের দেখাতেই সে আমার মন টেনে নিলো। আমার বন্ধুর বাড়ির বা ঘরের অবস্থান অপরুপ সুন্দর একটি মনোরম পরিবেশে। ঘরের একেবারে কাছেই জলপাইগুড়ি রাজবাড়ী (এই রাজা রায়কত এর নামেই রায়কত পাড়া ও দিঘি), ঘরের বাইরে তিস্তার চর দিয়ে পায়ে হেঁটে গেলে তিস্তা ব্রীজ, বালাপাড়া হয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ; বন্ধুর ঘর টিনের ছাউনি দেওয়া একচালা ঘর, ঘরের পাশেই নারকেল আর আমগাছ, সামনেই নিকোনো উঠোন, ছোট্ট টালির ছাউনি দেওয়া গরু - বাছুরের নিজস্ব গোয়ালঘর; যে মহুর্তে আমি গাড়ি থেকে আমার বন্ধুর পরিবারের ঘরে ঢুকলাম, মনেই হলনা যে, আমি আদৌ কোনও অপরিচিত ইউন আত্মীয়ের ঘরে ঢুকেছি।
তাদের পরিবারের কাছ থেকে যে আন্তরিক ভালোবাসা আর স্নেহ আমি পেলাম, মনে হলো তাদের সাথে আমার যুগ যুগান্তরের সম্পর্ক; সেদিন রায়কত পাড়ার আশেপাশের অনেক প্রতিবেশী ছুটে এসেছিলেন শুধুমাত্র আমাকে একবার নিজের চোখে দেখবার জন্য। সবার সাথে আলাপ পরিচয় হওয়ার পর অনেক রাত অবধি কত যে গল্প, বন্ধুর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে লম্বা ঘুম। পরেরদিন সকালে যখন আমাদের গাড়ি এলো আবার জয়গাঁও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, সেইমুহূর্তে প্রস্তুত ছিলামনা যে, ফিরে যাওয়ার সময় এরকম একটি বিষাদঘণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে ভেবে। গাড়িতে ওঠার আগেই দেখলাম বাড়ির কিশোরী কন্যাদুটির ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হয়ে গেছে, যেন কতদিনকার আত্মীয় বা কাছের মানুষ তাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আমারও খুব মন খারাপ। আবার এখানে সময় পেলেই আসবো সেই কথা দিয়ে ফিরে চললাম।
মানুষের সাথে মেশা:-
এর ঠিক পরের বছরের কথা, আবারও পাড়ি দিলাম উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে, এবারে গন্তব্য জলপাইগুড়ির সেই বন্ধুর বাড়ি। আগাম খবর দেওয়াই ছিল, কলকাতা থেকে নর্থবেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট এর রকেট বাস ধরে পরেরদিন সকালে গিয়ে নামলাম জলপাইগুড়ি। এবারে হাতে সময় নিয়ে এসেছি, বেশ কয়েকদিন থাকব এবং আশেপাশের জায়গাগুলি ঘুরে দেখব এই বাসনায়। যথারীতি লাগেজ নিয়ে রিক্সা ধরে দিনবাজারের করলা নদীর ব্রিজ পেরিয়ে সোজা রায়কত পাড়া, বন্ধুর ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাওয়ার পর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম গোশালা মোড়, জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন, পাটকাটা এবং কাছেই ডাঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান।
সন্ধ্যায় আমার সাথে আলাপ হলো মোহিতনগর থেকে আসা এ বাড়ির জামাই এর সাথে। প্রথম সাক্ষাতেই একেবারে বন্ধুর মত মিশে গেলাম দুজনেই। সে ই আমাকে প্রস্তাব দিলো যে, তার পরিচিত এক জায়গায় গিয়ে নির্জনে বিয়ার খাওয়ার। সেই শুনেই আমি প্রস্তাব লুফে নিলাম, এবং দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে তিস্তার চর ধরে সাদা বালির পাড় ধরে আবছা আলোয় চললাম তারসাথে। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যাওয়ার পর আমরা ঢুকে পড়লাম ঘন গাছপালা ঘেরা নির্জন একটি জায়গায়। তারপর হঠাৎ কিছুটা এগোতেই সামনে দেখলাম লম্বা একটি ঘেরা জায়গায় সারিবদ্ধ কয়েকটি খড় আর টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট ঘর, সামনেই লম্বা উঠোন। জামাইবাবু সেখানে গিয়ে কার নাম ধরে ডাকতেই আশপাশের ঘর থেকে অনেকেই বেরিয়ে এলো, সবাইই দেখলাম জামাইয়ের বেশ পরিচিত মুখ। আসলে জীবনবিমার সূত্রে ( যদিও তারা খুবই ছোট গ্রাহক ) তারা সবাই গ্রাহক। আমাদের সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য বলতেই, একজন মাঝবয়সী ব্যক্তি ঘরে ঢুকে দুটি চেয়ার একটি ছোট টেবিল আর হাতে দুটি ঝকঝকে কাচের গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে এলেন, এরপর আমরা তার পিছু নিয়ে আরও কিছুটা বড় গাছপালা পেরিয়ে একটা ছোট্ট ফাঁকা জমিতে এসে থামলাম। উনি আমাদের চেয়ার টেবিল আর গ্লাস সাজিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
সে এক স্বর্গীয় অনুভুতি, এপ্রিল মাসের চাঁদনী রাত, চতুর্দিকে বড় বড় গাছ, প্রবল হাওয়ায় গায়ে ঠাণ্ডার শিরশিরানি, পাতার সবেগে আন্দোলনের শব্দ এবং চোখের সামনে বড় ঝোপঝাড়গুলোয় ভর্তি জোনাকির আলোকমালায় কেউ যেন হাজার হাজার সবুজ টুনি লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে, কোথাও বা উপরের গাছ বেয়ে ঝর্ণার মত নেমে আসছে। অনেক্ষণ মুক স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম; চটকা ভাঙ্গলো বিয়ারের বোতলের ছিপি খোলার আওয়াজে। ধীরে ধীরে গ্লাসে চুমুক মেরে গলা ভেজাতে লাগলাম বহুক্ষণ ধরে, কারও মুখে কোন কথা নেই, চারিদকে শুধু প্রকৃতির শব্দ।
একসময় বিয়ারের বোতল খালি হলো, ঝিম ধরা নেশা নিয়ে আরও কিছুটা সময় বসে রইলাম, তারপর চেয়ার টেবিল গ্লাস সব নিয়ে চললাম তাদের ঘরের উদ্দেশে। যেতে যেতে জামাই বন্ধুর মুখেই শুনলাম এদের নিত্যকার দৈনিক জীবন সংগ্রামের কথা। এইসব ঘরের পুরুষ এবং নারীদের জীবিকা হচ্ছে তিস্তা নদীর গভীরে গিয়ে জাল দিয়ে উত্তরবঙ্গের রুপোলি শস্য ছোট ছোট বোরোলি মাছ ধরা। সেই রাত ৩টের সময় এরা নদীর দিকে যাত্রা শুরু করে এবং ভোরবেলায় সেই মাছ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রী করেন। সেটাই এদের একমাত্র উপার্জন।
এরপর আমরা ওদের ঘরে গিয়ে ওদের জিনিসগুলো ফেরৎ দেওয়ার পর আমি সেই মাঝবয়সী লোকটিকে বললাম, ' আপনার পাশাপাশি সব ঘরের পরিবারদের ডাকুন, আমি আপনাদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে সময় কাটাতে চাই '। এরপর যা ঘটলো, সেটা আমার জীবনের অন্যতম একটি স্মরণীয় রাত।
উনি সব ঘরে গিয়ে আমার কথা বলার সাথে সাথেই এক এক করে যত ছেলে - বুড়ো - মহিলা এবং শিশু বা বাচ্চা ছিল, সব্বাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লাইন দিয়ে ঘরের সামনের লম্বা দাওয়ায় সার দিয়ে বসে পড়ল। আর আমরা বসলাম ওদের ঠিক মুখোমুখি সামনের উঠোনে দুটি চেয়ারে। শুরু হলো আমাদের খোশ মেজাজে গল্প।
প্রথমদিকে আমিই শুরু করলাম তাদের সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে, এরপর ওরাও ওদের নিজেদের মত করে প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব। এভাবে কথোপকথন চালচালি করতে করতে একেবারে ওদের ঘরের লোকের মতন মিশে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মেয়ে বা মহিলাকুল গলায় সুর চড়িয়ে আমার সাথে তুমুল তর্কে মেতে উঠলো ওদের মত করে। এভাবে একসময় কখন যে অনেক রাত হয়ে গেছে টেরই পাইনি। হুঁশ ফিরলে ঘড়িতে দেখলাম রাত প্রায় ১১টা বাজে। আমরা দুজন অবশেষে তাদের সবাইকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে আমরা আমাদের ঘরের পথ ধরলাম। সেদিন যে ওরা আমাদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে কতটা খুশি হয়েছিল, সেটি পরে বুঝেছিলাম।
আমি যেদিন সন্ধ্যায় কোলকাতার বাস ধরব, সেদিন সকালে তাদের মধ্যে একজন আমার বন্ধুর মায়ের হাতে বেশ কয়েক পোয়া বোরোলি আর পাথরচাপা মাছ একটি পলিথিনের ব্যাগে করে দিয়ে গিয়েছিল আমি ফেরার সময় কলকাতার বাসায় (অবশ্যই ভাজিয়ে নিয়ে) নিয়ে যাওয়ার জন্য। বন্ধুর মা (কাকিমা) পয়সা দিতে চাইলেও ওরা নেয়নি, ওদের বক্তব্য ছিল, ওরা তো এই মাছ আমাকে ভালোবেসে দিয়েছে। সেবার সেই ভালোবাসার উপহার নিয়ে কলকাতার বাড়িতে ফিরেছিলাম। এরসাথেই সেসময়ে একদিন দেখেছিলাম, বন্ধুর বাড়িতে চেনাশোনা কোন ইলেকট্রিক মিস্ত্রী কাজ করতে এসেছে, দুপুরে সবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, ওরা সেই ইলেকট্রিক মিস্ত্রী ছেলেটিকে একসাথে বসিয়েই দুপুরের খাবার খাইয়ে দিল। আমাদের শহর কলকাতার জটিল স্বার্থপর মানুষদের কাছ থেকে এই সহজ সরল আন্তরিকতা আশাই করা যায়না।
এরপর থেকেই প্রায়ই এপ্রিল মাসে চলে যেতাম উত্তরবঙ্গে। প্রথমে এসে আগে নামতাম শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ডে, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সেবক রোড ধরে জন জনতানগর এ আরেক কাছের আত্মীয় ভাইয়ের বাড়িতে, আগে যেখানে মদনগঙ্গা নার্সিংহোম, বালুরঘাট ট্রান্সপোর্ট, ঠিক তার পিছনেই। এখন যদিও সেখানে দু - তলা সাজানো গোছানো বড় মাপের বাড়ি তৈরি হয়েছে, তখন সেখানে পাড়ার পাশাপাশি বেশিরভাগ বাড়ীই ছিল কাঠ বা সিমেন্টের ঘরের উপরে টিনের শেড দেওয়া। অনেক বাড়ির সামনে বা বাগানেই গোলাপ জামের গাছ দেখতে পেতাম।
গলি থেকে বেরোনোর মুখেই বালুরঘাট ট্রান্সপোর্ট। বাঁদিকে একটু এগোলেই লাটপাঞ্চার যাবার শেয়ার জিপস্ট্যান্ড। এখানেই আমাদের মূল আড্ডাখানা ছিল। সাথে জুটে গিয়েছিল বন্ধুর বয়সী আমার থেকে বয়সে ছোট বেশকয়েকজন। তখনও অবধি আমি পায়ে হেঁটে অর্থাৎ সোজা কথায় যাকে ট্রেকিং বলে, হিমালয়ের বুকে পা রাখিনি, মনের ভিতরে প্রবল সুপ্ত ইচ্ছেটা ছিলই। ৯০এর দশকে প্রায় ৩৭বছর বয়সে আমি আমার সুপ্ত বাসনাটি জাগিয়ে তুলি ওই শিলিগুড়িতে গিয়েই, প্রথমদিকে ছোট ছোট দুরত্বে সন্দকফু ও সিকিমের কিছু রাস্তায়।
এবং ওখানেই আমার যে ভাই ছিল তাকে এবং আর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে প্রথম গেলাম দার্জিলিং এ একরাত থেকে, মানেভঞ্জন হয়ে টংলু - তুমলিং অবধি। সেখানে একরাত কাটিয়ে আবার শিলিগুড়ি নেমে আসা। মজার কথা হচ্ছে, আমি সেবার যাদের সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম, শিলিগুড়ি তাদের ঘরবাড়ি হলেও, এর আগে তারা কেউই কখনও দার্জিলিং শহর ও তার আশপাশ চোখেই দেখেনি বা যায়নি।
এরপরের বছর এপ্রিল মাসে আবার গ্রুপ জুটিয়ে প্রথমে গেলাম জোড়থাং। সেখানের হোটেলে রাত কাটিয়ে, পরেরদিন সকালে ছাড়া দিনের একমাত্র শেয়ার জীপে অনেকটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে, পশ্চিম সিকিমের শেষ গ্রাম রিবধি।
রিবধি - ভারেং সেসময় খুবই ছোট্ট একটি ছবির মত সুন্দর গ্রাম। সেখান থেকে গাইড হিসেবে কাঞ্চা ভাইকে পথ নির্দেশক করে, পায়ে হেঁটে সোজা চললাম ভারেং হয়ে ওপারেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গোর্খে ট্রেকার্স হাটে ( তখনও আমি লুকোনো গ্রাম " সামানদেন " এর খবর জানতামনা )। সেখানে একরাত কাটিয়ে পরেরদিন সকালে আবার আরেকটু লম্বা পথ ট্রেক করে সোমবাড়িয়া - হিলে হয়ে বার্সের গুরাসকুঞ্জে। সেখান থেকে আবার ছোট্ট ট্রেক করে রিবধি এসে শেয়ার জীপে শিলিগুড়ি ফেরা। কখনও এস এল আর ক্যামেরা হাতে একাই বেরিয়ে পড়তাম আগাম কোনও লক্ষ্য না রেখে, কোনদিন হয়তো সেবক রোড থেকে প্রাইভেট বাস ধরে হঠাৎ নেমে পড়লাম কালিঝোরা নতুন বাংলোর সামনে। পুরাতন কাঠের বাংলোটি গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় আগুনে পুড়ে ভষ্মিভূত হয়ে গিয়েছিল।
বাস থেকে নেমেই চলে গেলাম তিস্তার একেবারে কিনারে, তারপর প্যান্ট গুটিয়ে নদীর উপর বড় বড় পাথর ডিঙ্গিয়ে তিস্তার জলে পা ডুবিয়ে ক্যামেরা সেট করে সেল্ফ শাটারে নিজের একটি ছবি তোলা। দিনের বেলা হলেও, চারপাশ একেবারে মানুষজনবিহীন কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। সেখানে একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বেশ কিছুটা সময় নদীর পাশে তন্ময় হয়ে বসে সামনের ঘন জঙ্গল আর তিস্তার স্রোতের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকা, ইতস্তত ধীর পায়ে ঘুরে বেড়ানো; অনেক পর যখন আবার কালিঝোরা বাংলোর একেবারে সামনে এলাম, দেখি বাংলোর পাশেই রাস্তার ধারে একটি বড় আম গাছের ডালে অনেকগুলি থোকা থোকা কাঁচা আম ঝুলে রয়েছে। রাস্তার ধার থেকে পাথর কুড়িয়ে, টিপ করে করে অনেকগুলি আম পেড়ে বড় সাইজের রুমালে বেঁধে নিলাম, কিছু রইলো হাতে ধরা।
এবার শিলিগুড়ি হয়ে সেদিনই জলপাইগুড়ি যাবো বলে ঠিক করে ফাঁকা রাস্তার ধারে দাড়িয়েই আছি, কোনও বাস আর আসেনা। আরও কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ দেখলাম একটি খালি ছোট ট্রাক পাহাড়ে মাল নামিয়ে নীচে ফিরছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাত দেখাতেই চালক গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি দরজা খুলে ওনার পাশে বসলাম। তারপর টুকটাক গল্প করতে করতে একসময় শিলিগুড়ি। গাড়ি থেকে নামার পর আমি যেই আমার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করেছি, ওনাকে কিছু টাকা দেব বলে, সেই দেখেই উনি আমার হাতটা চেপে ধরলেন, বহু সাধ্যসাধনাতেও কিছুতেই আমাকে টাকা বের করতে দিলেননা।
আরেকদিন যাব শিলিগুড়ি এয়ারভিউ মোড় থেকে বাসে জলপাইগুড়ি। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, কোনও বাস আর আসেনা। সেদিন কোন কারণে সকাল থেকেই বাস চলাচল একেবারেই বন্ধ ছিল। বিকেলের দিকে প্রথম এলো হলদিবাড়ি যাওয়ার একটি সরকারী বাস। বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ানো মাত্র দরজা খুলে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল কে আগে উঠে বসার সিট পাবে সেই প্রতিযোগিতায়। আমার রোগা পাতলা শরীরটা ওই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে সুরুৎ করে গলিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম এবং বসার সিটও পেয়ে গেলাম। যথারীতি বাস ছেড়ে দিলো, এরপর ফুলবাড়ি পাড় হওয়ার পর কন্ডাকটর এলো টিকিট কাটতে। আমিও সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে গিয়ে দেখি পকেট ফাঁকা !
বাসের সিঁড়িতে ভিড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে ওঠার সময়ে ভগবান আমার পকেট কেটে মানিব্যাগটি নিজের হস্তগত করেছেন। আমি তখন কাঁচুমাচু মুখে কন্ডাকটরকে সে কথা বলতে, উনি অভয় দিয়ে বললেন, ' পকেটমারি হয়ে গেছে যখন কি আর করবেন, আপনাকে তো বাড়ি পৌঁছতে হবে, আপনি কদমতলা বা বেগুনটারি মোড়ে নেমে পড়বেন '।
উত্তরবঙ্গ সম্পর্কে আমি তখন আমার অত্যন্ত প্রিয় দুজন শ্রদ্ধেয় লেখকের লেখা পড়ে ভীষণভাবে আগ্রহী এবং উৎসুক হয়ে পড়েছি। তাঁদের মধ্যে একজন সমরেশ মজুমদার, যাঁর লেখা ট্রিলজি উত্তরাধিকার - কালবেলা - কালপুরুষ, এবং দেবেশ রায়ের তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত।
আরও অনেক পরে পড়েছি গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যর "বেড়িয়ে আসি ডুয়ার্স"। এবং সবচাইতে বেশি যে মাসিক পত্রিকাটি (একেবারে প্রথম সংখ্যা থেকে ) আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, সেটি হচ্ছে " তথ্যকেন্দ্র "। মূলতঃ এই পত্রিকাটি ছিল উত্তরবঙ্গ ভিত্তিক। ছিল বলছি এই কারণে যে, অত্যন্ত বেদনার বিষয় হচ্ছে পত্রিকাটির প্রকাশ হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। তার কারণ সম্ভবত দুটি। তারমধ্যে এক নম্বর কারণ করোনার কারণে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, এবং দু নম্বর কারণ হচ্ছে (সুধী পাঠক আমার ভুল হলে ক্ষমা করবেন), কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের নামজাদা প্রকাশন সংস্থা 'ভিকাশ পাবলিকেশন' এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই পত্রিকার সার্কুলেশন হতো। হঠাৎ করেই ভিকাশ এর মালিক মারা যান, এবং তারপরই এই প্রকাশনা সংস্থা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়, সেইসাথে তথ্যকেন্দ্রও।
এই পত্রিকার পাতায় বিশেষ সংখ্যায় ডুয়ার্স এর চেনা - অচেনা জায়গা নিয়ে লিখতেন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, এবং সমরেশ মজুমদার শুরু করেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী মূলক ধারাবাহিক 'ভালোবাসায় আংরাভাসায় জীবনযাপন '। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই পত্রিকার পাতায় অনেক ভালো ভালো লেখকের উচ্চমানের লেখা বেরোত, কিন্তু প্রতি মাসের একেবারে প্রথমেই থাকত এই ধারাবাহিকটি। প্রত্যেকমাসে মুখিয়ে থাকতাম এই ধারাবাহিকটির জন্য।
সেবার তথ্যকেন্দ্র পত্রিকার সেই সংখ্যাটি ছিল ডিসেম্বর ২০১৯ এর, পত্রিকাটি হাতে পাওয়ার পর প্রথমেই পাতা উল্টিয়ে ওনার লেখায় মনোনিবেশ করেছি, আচমকা ওনার জীবনের একটি ঘটনার কথা পড়ে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। সেটি হচ্ছে, সমরেশ মজুমদারের বাবা যখন জীবনে প্রথমবার কলকাতায় পাঠান, সাথে সমরেশ এর একজন সহপাঠিও ছিলেন (বা যাওয়ার অনুমতি দেন ), সেদিন উনি ওনার অতি পরিচিত বিশ্বস্ত একজন বন্ধুর ছেলের ঠিকানা দিয়ে এবং আগে থেকে জানিয়ে সেখানে গিয়ে তাদের দুজনের থাকার কথা বলেন। সেই এবং বিস্মিত হয়ে দেখি, সেই বন্ধুর বাড়ি একই রাস্তায় আমার বাড়ির অনতিদূরেই। সেই বাড়ির অবস্থান ছিল বেহালা রায় বাহাদুর রোডের, চন্ডিতলার সংযোগস্থলে। পরেরদিন আমি ছুট লাগাই সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে।
ঠিকানা মিলিয়ে সেই বাড়ি খুঁজে বের করে আমি গিয়ে দরজায় নক করি। ভিতর থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এসে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই, তাকে আমার আসার কারণ বলি; শুনে উনি একটু বিরক্তির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যে, শিবুদা নামের কাউকেই উনি চেনেননা বা তার নাম মনে করতে পারছেননা।
এবং সমরেশবাবু সম্বন্ধেও কোনও রকম তথ্য দিতে পারলেননা। আমি জানিনা যে, উনি বা ওনার বাড়ির বর্তমান পরিবার আদৌ সমরেশ মজুমদারের লেখার কোন খোঁজ রাখেন কিনা বা বইও পড়েন কিনা। আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরলাম কিছুটা হতোদ্যম হয়েই।
৯০এর দশকে জলপাইগুড়িতে এস টি ডি, আই এস ডি এবং পি সি ও ফোন বুথ:-
আমি যেসময় থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়া শুরু করেছিলাম, তখন জলপাইগুড়ির অনেক বাড়িতেই নিজস্ব ল্যান্ডলাইন ফোন ছিলনা।
আমার কলকাতার বাড়িতে ফোন ছিল। ফলে রাতেরদিকে বাড়ির কারও সাথে কথা বলতে গেলে, আমাদের (এবং এলাকাবাসী আরও অনেকের) যেতে হতো জলপাইগুড়ি পোস্ট অফিসে। সেখানে তখন টেলিগ্রাফ এর দীর্ঘ লাইন। সকলেই অপেক্ষায় যার যার প্রয়োজনে ফোনের ওপারের মানুষের সাথে কথা বলা। সামনে থাকতো তারের জাল দিয়ে ঘেরা। ভিতরের একজন নম্বর দেখে দেখে কল করে লাইন ধরিয়ে দিতেন। সে এক সময়সাপেক্ষ ব্যপার ছিল।
এরপর ৯০এর দশকের শেষদিকে (সঠিক সময়টা আমার ঠিক মনে পড়ছেনা) কলকাতার 'আজকাল' পত্রিকার ৪র্থ পাতায় জলপাইগুড়ির মানুষের যোগাযোগের অসুবিধার কারণে, বড় করে একটি প্রতিবেদন লেখেন দেবেশ রায়। তখন ছিল বামফ্রন্ট সরকারের আমল। সেই লেখা ছাপার মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সমগ্র জলপাইগুড়ি শহরের বুকে ছোট ছোট কাছের দরজা লাগানো ঘরে, চালু হয়ে গেল এস টি ডি, আই এস ডি এবং পি সি ও বুথ।
বহু বেকার ছেলেই তখন এসব বুথ খুলে বসে উপার্জনের নতুন রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। এবারের মত এখানেই লেখার ইতি টানলাম, পাঠকের ভালো লাগলে, আবার সামনে কোনদিন উত্তরবঙ্গ প্রসঙ্গে আরও কিছু লেখার ইচ্ছা রইলো।
Comments
Post a Comment