তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

মূল্য | মিষ্টু সরকার | গল্প ৭

আবার সেই মাথা ঝনঝন্! তন্দ্রাছন্ন হয়েও ঘুমটা আসতে গিয়েও এলোনা, নিজের এই পরিবর্তনের সাথে সে বেশ পরিচিত এতদিনে। হীরা মানিক জ্বলে' -র সনৎ -এর হাত যেভাবে সুশীলের হাত থেকে আলগা হয়ে গেলো, তেমন ওর হাত থেকেও কি একটা ছুটে যাচ্ছিল, তারপর আঃ! একটা ছোট্ট শব্দ। রাকা'র চারপাশের পৃথিবীটা দুলে উঠলো। সে বিনিময় শিখল। বিভূতি'র ভূষণ সেই থেকে জুড়ে গেলো তার অঙ্গে, কখনো ভরা-পূর্ণিমা আর কখনো চোখের-জল হয়ে। কোন ভালো কিছু পেতে হয় প্রিয় কিছু বিনিময়ে। এটাই নাকি পৃথিবীর অনিবার্য দস্তুর। কৈশোর পেরোনোর আগেই সে উত্তর খুঁজে পেয়ে গিয়েছিল তপব্রত বাগচী ওরফে রাকা; মাকে হারিয়ে।

তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই রাকা'র এই সব জটিল কথাবার্তা গুলো মনে গুটিপোকার মতো জড়িয়ে মনটাকে ভারী করে তুললো আর ঘুমটা ভেঙে গেলো । স্ট্রীট লাইটের আলো ঘরটাতে তেরছা ভাবে পড়ে একটা আলো-আঁধারির বাতাবরণ তৈরি করেছে যেনো জ্যোৎস্না লুকোচুরি খেলছে তার ঘরে। সেই সঙ্গে দুলছে দরজার পর্দা, মা এলো বুঝি সন্ধ্যাবাতি হাতে। এমন সন্ধ্যেতে মায়ের জন্যে মন আরো বেশি খারাপ হয়। অনেকগুলো বছর কেটে গেল যদিও, এখন সে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ম্যানেজার, সারাদিনে হাজারটা সমীকরণ সামলায়। কিন্তু মনটা ঠিক কয়েক বছর আগেই আটকে আছে ।

স্বপ্নটা না থাকলে সে যেন ভিখারি হয়ে যাবে, তার আগ্রাসী মনে সযত্নে জমায় সেসব। ঠিক যেদিন শেষবারের মতো মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল বাবা আর কাকারা, ও যেতে পারলোনা । কারণ তারপর দিন ছিল তার পরীক্ষা। মা অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে সমীকরণের অঙ্ক শিখিয়ে দিল, পরীক্ষার খাতায় সেই অংক করে সে ফুলমার্কস পেল। কিন্তু তার জীবনের সমীকরণ আর মিললনা। পক্ষীরাজের ডানায় পাড়ি দিয়ে মায়ের সাথে আর নতুন রাজ্যে যাওয়া হলো না।
পরীক্ষার পর বাড়ি ফিরে সেই দুপুরে সকলের শত চেষ্টাতেও কিছুতেই বাড়িতে থাকলো না।

হসপিটালে চলে এলো মায়ের কাছে। মায়ের বুকে মাথা রাখলো আঙ্গুল ধরে থাকলো বারবার গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে দিতে দিতে কখন যে তার নিজের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল মায়ের মুখে তার সে বুঝতেও পারলোনা। হঠাৎ মায়ের হাত তার মাথায় এসে পড়ায় মা চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল "আমি সবসময় তোমার সাথে আছি, এমন করে চোখের জল ফেলেনা সোনা, এ খুব দামী জিনিষ যত্ন করে রেখো।" 

এক এক করে ক্রমশ মায়ের পায়ের আঙ্গুল থেকে শুরু করে হাঁটু কোমর পার করে মায়ের শ্বাস বুকে এসে ঘন হতে লাগলো ঘরঘর শব্দে ; অক্সিজেন ট্যাংক'কে পেছনে ফেলে ট্যাংকের সাথে থাকা  
হিউমিডিফায়ার বোতলের জল রা-কাটা বন্ধ করে দিল। বাবা কখন যেন রাকা'র নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাকা'র তর্জনীটা মায়ের হাত থেকে আলগা হয় চিরদিনের মতো । সেই সন্ধ্যায় মা চলে গেল । চওড়া সিথির সিঁদুর, লাল পেড়ে হলুদ খোলের সিল্কের শাড়ি কপালের টকটকে লাল সিঁদুর টিপ, রজনীগন্ধার মালার সাজে মাকে কি অপরূপ দেখাচ্ছিল, যেনো জোছনায় ভেসে যাচ্ছে ওদের বাড়ির তুলসীবেদীর চারপাশ। সেই থেকে ও পূর্ণিমাকে আপন করে নিল।

মায়ের বুকের ওপর মুষ্টিবদ্ধ হাত রেখে সে আদিগন্ত পূর্ণিমার ভরাজোছনায় ভেসে গেছিল। পড়শিরা বলল এই কচি বয়সে মা হারা দুধের ছেলে শোকে পাথর হয়ে যাবে না তো কি !! বাবা তখনও পেছনে নিঃশব্দে; বাবাকে দেখে রাকা বোঝে শব্দের ভার সামলানো কতো কঠিন! অতো দামী জিনিস চলে গেলে তো এমনিই কান্না আসে বুকে! কিন্তু মায়ের রাকা সেদিন বাবার দিকে তাকিয়ে চোখকে প্রশ্রয় দেয়নি। তবে আজও মায়ের কথা ওর বোধগম্য হয় না ঠিকঠাক। মায়েরশোক বড় না চোখেরজল কোনটা !! তালগোল পাকিয়ে যায় তার, আজও সে বুঝে উঠতে পারে না। সেই থেকে রাকা মায়ের জন্য লুকিয়ে চোখেরজল ফেলে সব্বার আড়ালে, এ তার একান্ত নিজস্ব। তার প্রিয়ও দামী জিনিস টার জন্য, অন্য দামীর কিছুর বিনিময়ে।

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.