উপলব্ধি | নিশীথ কুমার রায় | প্রবন্ধ ৬
উপলব্ধি ১ : কর্মধারা নদীর মতো গতিশীল
একটা ফুটকি (.) কি ফুল স্টপ (পূর্ণ বিরতি) করাতে পারে! ফুটকি একটা সেনটেন্সকে থামাতে পারে। তাতে কি সব কথা থেমে যায়! যায় না। ফুটকির (বিরতি চিহ্নের)পর আবারও সেন্টেন্স (বাক্য) চলতে থাকে যতক্ষণ কথা শেষ না হয়। আরও কথা উহ্য আছে (মানে এখানেই শেষ নয়) পর পর তিনটে ফুটকি(...) চিহ্ন থাকলে সে কথাই বোঝায়। অর্থাৎ ফুটকি তিনটি (...) হলেও কথা থেমে যায় না। চাকরি থেকে অবসর মানে আদৌ ফুলস্টপ নয়। জীবনে চলার পথে অবসর একটা ফুটকি, মানে একটা বিরতি মাত্র। অবসর মানে সব থমকে যায় না। পুনরায় নতুন উদ্যমে বাড়ির নানা কাজে, সাধ্যমত সমাজের ছোট বা বড় কাজে লেগে গেলেই জীবন পথে পর পর বাক্য গঠন হতেই থাকে। "যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ"। উদ্যমীকে ফুল স্টপ (.) করানো যায় না, মানে থামানো যায় না। তিস্তানদীকে দেখে প্রত্যয় হল― গতিতে জীবন স্থবিরতায় সমাপ্তি। দেখেছি যখন তিস্তায় জল কমে যায় তখনও সে নদী স্রোত হারায় না, স্থবির হয়ে যায় না। সুখা মরসুমেও অবিচল ধারা প্রবাহে তার উদ্যমে ভাটা নেই, বইছে তো বইছেই, বিরতি নেই। বর্ষায় নব যৌবনপ্রাপ্ত হলে খরস্রোতা হয়, ভয়ংকর রূপও ধারন করে বটে! তবু উভয় কূলে বিস্তির্ণ চরে মানুষের জন্য নিয়ে আসে আশীর্বাদের সাজি। উজার করে ভরে রাখে রূপালি শষ্য বোরলি মাছে, ভেসে আসা বেওয়ারিস কাঠে। প্রতিবছর বর্ষায় এই তিস্তা চরে চরে দিয়ে যায় পর্যাপ্ত পলিমাটি। তিস্তার বদান্যতায় এখানকার জমি উর্বরতায় ভরে ওঠে। বিস্তির্ণ তটভূমি বন্যাবাহিত পলিতে বরপূত হয়। সেখানে এপার ওপার পলিগঠিত উর্বর বিস্তির্ণ চরে চরে সারা বছর ফসলে ফসলে কৃষকের মনে সন্তুষ্টি বয়ে আনে যা কিনা তিস্তাপারের মানুষের বারমাসের খুশির রসদ জোগায়। ওরা বিরাম জানে না। সারা বছর ওরা চাষবাসে ব্যস্ত থাকে। ভরা বর্ষায় তিস্তা নদীর ভয়ংকর স্রোতে ভেসে আসা কাঠ ধরা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তেমনই ওদের নিরলস জীবনযাপনের সাক্ষ্য বহন করে।
ওদের জীবনধারা যে ফুটকিহীন (বিরামহীন) তিস্তার মতন গতিশীল প্রাণস্পন্দনে ভরপুর একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় ।
উপলব্ধি ২ : বিশ্বাস-অবিশ্বাস
বিশ্বাস হল একটা বোধ, একটা অনুভব। কখনো কখনো সেই অনুভব একটু ঝাপসা হয়ে ওঠে অনেকটা হেরিকেনের চিমনির মতন। চিমনির ভিতরের দিকটা অনেক সময় কার্বনের আস্তরন প'ড়ে প'ড়ে ভিতরের আলোক শিখাকে আবছা ক'রে তোলে। তখন চিমনিতে আঁটকে থাকা কার্বন ধুয়ে মুছে নিয়ে ব্যবহার করলে আলো পরিস্কার হয়। চিমনির স্বচ্ছ প্রাচীরের সুরক্ষায় হেরিকেনের আলো বাতাসের ধাক্কায় নিভে যায় না কিংবা আলো ঝলমলে হয় এবং বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। সেই কারনে হেরিকেন শিখার চারপাশে চিমনিটা পরিরক্ষক তথা পরিবর্ধক হিসেবে লাগানো হয়ে থাকে। এবারে সেই চিমনিতে যত বার কার্বন পড়ে একটা বোধ থেকে তত বার মুছে নিয়ে স্বচ্ছ করবার প্রয়াস চলে। সেই বোধ হল চিমনি আবার পরিস্কার করে নিলে চিমনিটা বাতাসের ধাক্কায় হেরিকেনের শিখাকে নিভতে দেবে না এবং আলোর যথেষ্ট বিচ্ছুরন ঘটাবে। এরকম একটা বোধ হল বিশ্বাস। উপরে বলা সেই বিশ্বাসটা ততক্ষণ অটুট থাকে যতক্ষণ চিমনি ঠিক ঠাক পরিষেবা দিতে পারে। কাচের চিমনি একবার ভেঙে গেলে ভাঙা টুকরোগুলো সাবধানে আবর্জনাস্তুপে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। ভাঙা কাচের টুকরো সরানোর সময় সাবধান হতে হয়, কেননা ভাঙা কাচে হাত কাটার সম্ভাবনা ও রক্তপাত হওয়ার ভয় উদ্রেক হয়। তাছাড়া ওই ভাঙা চিমনি কোনক্রমেই হেরিকেন শিখাকে রক্ষা করতে পারবে না। ভাঙা চিমনি দেখে যে বোধ হয় ওটা ভাঙা কাচের টুকরোর প্রতি অবিশ্বাস। চিমনিতে পড়া কার্বনের আস্তরনটা অবিশ্বাসের কারন নয়, ওটা বিশ্বাস অটুট আছে কিনা সেই বিষয়ে পরীক্ষা মাত্র।
উপলব্ধি ৩ : নিসর্গ প্রেমে স্বর্গসুখ
বেঁচে থাকতে একেক জন আমরা মৃত্যু ভয়কে মনেপ্রাণে সহচর করে মরে বেঁচে থাকি। মৃত্যু সে নাকি কী সাংঘাতিক বিভীষিকাময় যন্ত্রনা উদ্রেককারী পরিস্থিতি! কল্পনায় উঠে আসে স্বর্গবাসের কথা। কখনও আসে নরক যন্ত্রনার দুর্ভাবনা। ইহলোকে জীবিত কারও এই স্বর্গ সুখ কিংবা নরক বাসের যন্ত্রনা দেখার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যের অভিজ্ঞতা আছে -এমন কাউকে কোনো দিন পাইনি! এমন কোন জীবিত মৃত অশরীরী কেউ আছে যে বলতে পারে মৃত্যুর বিভীষিকা রূপ সে দেখেছে কিংবা মৃত্যুর সুখানুভূতি সে উপভোগ করেছে! আজন্ম এমন কাউকে দেখি নি যিনি মৃত্যু সম্মন্ধিয় বাস্তবিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। কাল্পনিক সব গাল গল্প শুনেছি। তাই বেঁচে থাকতে মৃত্যু ভয়ে সেঁধিয়ে না থেকে ভাল ভাল চিন্তা ভাবনা নিয়ে বেঁচে থাকি আজীবন। স্বর্গসুখ আছে কি নাই তা কেউ যখন জানি না, তাহলে জীবদ্দশায় নরকযন্ত্রনা কিংবা স্বর্গপ্রাপ্তির কাল্পনিক দূরাশা কেন!? এমনতর দূরাশায় না থেকে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে থাকা বাস্তব নিসর্গ সুখানুভূতি নিংড়ে নিয়ে পরম আনন্দে জীবৎকালটা না হয় কাটানো যাক।
Comments
Post a Comment