নন্দী ভিটের ভুতুড়ে কাণ্ড | অঞ্জলি দেনন্দী | গল্প ৫
ভারত। বঙ্গ। হুগলী। চৈতন্যবাটী। নন্দী ভিটে। বিরাট এক পুরোনো, শেওলা ধরা, ভাঙা চুন সুরকির, করি বর্গার দোতলা বাড়ি। সামনে বিশাল উঠোন। এরপর বড় দরজা। উঠোনের ঈশান কোণে শিব ও শক্তির এক খুব বড় মন্দির। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাড়ির পিছনে গভীর দীঘি। এটারও প্রাচীর আছে। বাড়ির পিছন দিক দিয়ে খিড়কি দরজা। সেটা দিয়েই বাঁধানো ঘাটে সবাই আসে। দীঘির ওপারে বৃহৎ ফুল ও ফলের বাগান। গাছে গাছে গাছে গাছে হরেক পাখির বাসা। এলাকার বিখ্যাত নন্দী বাড়ি। শিব রাত্রিতে খুব জাঁক জমকে সারা রাত ধরে পুজো অর্চনা হয়। বহু ভক্ত জমা হয়। সারা রাত এখানেই জেগে আর প্রদীপ জ্বেলে কাটায়।
এই বাড়ির মালিক দু যমজ ভাই। এরা সোনার ব্যবসা করে। পৈতৃক সম্পদ রূপে অনেক কেজি সোনা পেয়েছে। সেগুলি দিয়েই এখন দুজনে ব্যবসা করে। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে ওদের শো রুম। চোখ ধাঁধানো সব অলংকার। খুব বেচা কেনা চলে।
এদের বাড়িতে দুজনের দু স্ত্রী ও দুজনের একটি করে দুটি ছেলে আছে। বাবা ও মা গত বছর একসঙ্গে তীর্থ করতে গিয়ে রাস্তায় জঙ্গিদের হাতে প্রাণ দেয়।
এক মাঝ রাতে যমজের পাঁচ মিনিটের বড় দাদা উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছিল। ঘরে ঘুম আসছিল না তো তাই। সে দেখল কি, তার বাবা আর মা দুজনে হাওয়ায় শূণ্যে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। উঠোনের এদিক থেকে ওদিকে ঘুরছে। ও ছুটে গিয়ে ওদের সামনে হাজির হওয়ার চেষ্টা করল। ওমনি তারা ভ্যানিশ হয়ে গেল। ডাকল, " বাবা! ও বাবা! মা গো! মা! কোথায় চলে গেলে? এসো দেখা দাও গো তোমরা! " কেউ কোনই উত্তর দিল না। শুধু বড় ছেলে, নন্দ দুলালের সামনে একটা বিশাল বুঁচকি ওপর থেকে এসে ধপাস করে পরল। সেই বুঁচকি থেকে এক অপূর্ব জ্যোতি বের হচ্ছিল। উঠোন ভরে গেল। এবার নন্দ শুনল, শূণ্যে তার বাবা দর্শন না দিয়েই বলছে, " এর ভেতরে এমন ধরণের রত্ন আছে যা এ পৃথিবীর নয়। আমরা চাঁদের গুহা থেকে এনেছি। এগুলি দেশে ও বিদেশে বিক্রী করে অনেক টাকা আয় করতে পারবি। নে তুলে নিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে যা! " নন্দ তার বাবার কন্ঠ স্বর বহু দিন পরে শুনল। খুব আনন্দ পেল। বাবার কথা মত ও ঐ বুঁচকি ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। লোহার সিন্দুকের মধ্যে রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোর হল। নন্দ উঠে পড়ল। উঠেই আগে সিন্দুক খুলল। কি আশ্চর্য ঘটনা! এখানে এখন দুটি বুঁচকি। দুটি বুঁচকির ওপরে দুটি কাগজের টুকরো। তার ওপরে তাদের দু ভাইয়ের নাম লেখা। নন্দ দুলাল; রাম দুলাল। হাতের লেখা চেনা। এ তো ওর বাবার হাতের লেখা। ওর আর বুঝতে বাকি রইল না। বাবা দু ভাইয়ের জন্য দুটি বুঁচকি দিল।
ওদিকে ছোট ভাই রাম ও উঠে পড়েছে। দু ভাই উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছে। নন্দ রামকে সব বলল। ওরা ঘরে এসে সিন্দুক খুলল। দুজনে দুটি বুঁচকি খুলল। রত্নগুলিকে দেখে অবাক হল। সাত রঙের রঙ ধনুর রঙ ঠিকরে বের হচ্ছে। এরা দু জনে দুজনের ঘরে আলাদা আলাদা করে রাখল।
ওরা এবার সকালের নিত্য কর্ম সারল। বউ ও ছেলেরাও উঠে পড়েছে। প্রাতঃরাশ করে নিল। তারা দু ভাইয়ে শো রুম চলে গেল। দুজনের বিরাট বিরাট দুটি গাড়ি। ড্রাইভার দু জন চালায় ও বাড়ির একটি ঘরে তারা থাকে। ঐ দিকে বাড়ির রাঁধুনি, চাকর, ঝি, মালি, জেলে, চৌকিদার, ধোপা, সোনার কারিগর, নাপিত, দর্জি, পূজারী, ছেলেদের পড়ানোর শিক্ষক, খেলা শেখানোর শিক্ষক, তবলা বাজানো শেখানোর শিক্ষক সবাইয়ের ঘর আছে। মালিকরা খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
দুপুরে বাড়ি থেকে খাবার দাবার শো রুমে পৌঁছে দেওয়া হয়। ওরা ওখানেই খায়। রাতে ওরা শো রুম থেকে বারি ফিরছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ছাদের ওপরে খুব তেজী আলো জ্বলছে। অন্য দিন তো হাল্কা আলো জ্বলে। বাড়িতে ঢুকেই তারা সোজা ছাদে গেল। দেখল যে সেখানে অনেক রত্ন ঢালা আছে। আর পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তা থেকে উজ্জ্বল আলো বের হচ্ছে। এমন সময় তাদের মায়ের কন্ঠ স্বর অদৃশ্য থেকে ওদের কানে এল। " এগুলি আমাকে স্বয়ং চন্দ্র দেব উপহার দিয়েছেন। আমরা যখন চন্দ্র লোকে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন। তোরা এগুলি নিয়ে ব্যবসা কর! খুব লাভ হবে। " রাম তো মায়ের কন্ঠ স্বর শুনে কেঁদেই ফেলল। বলল, " ও মা! একবার দেখা দাও গো মা! " মা কিন্তু দেখা দিল না। ওরা ঐ রত্নগুলি নিচে এনে দালানের বিরাট সিন্দুকের ভেতর তালা দিয়ে রেখে দিল।
এবার দু ভাইয়ে মিলে সারা পৃথিবী জুড়ে বাণিজ্য করল। খুব ধনী হল। ঐ সময়ে যখন ওদের দু ভাইয়ের বয়স চৌত্রিশ বছর তখন এক শিব রাত্রিতে শিব পুজো চলছিল। সকলেই বসে অঞ্জলি দিচ্ছিল। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্র পাত ঘটল। একসঙ্গে সবাইই মারা গেল। শূণ্য হয়ে গেল সব জায়গাই।
এলাকার মানুষ আর ভয়ে কেউই ঐ দিকে আসে না। ভূতুড়ে বলে পরিচিত। কেন সবাই ভূতুড়ে বলে? কারণ তো আছেই, তাই যে বলে! হ্যাঁ, এক সন্ধ্যের খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। দূর দিয়ে মানুষ যাতায়াত করছিল। তাদের সবাইই দেখল যে দল বেঁধে ভূত আর পেত্নীরা আকাশের মেঘের নিচে ধেই ধেই ধেই ধেই করে নাচছে আর তাদের সামনে বাবা শিব ও কালী মা ও নাচছেন। ওনাদের সাঙ্গ পাঙ্গ তো ভূত আর পেত্নীরাই। বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল। সবাই দেখল ওরা এসে ঐ পুরোনো পরিত্যক্ত মন্দিরের কাছে এসে থেমে গেল। সেটা ছিল এক শ্রাবণের অমাবস্যার রাত।
ঐ নন্দী ভিটের ভূতুড়ে কাণ্ড ক্রমশ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল।
এবার এর পর কেটে গেল পাঁচটি বছর। খুব বন্যা হল। সব দিক ভেসে গেল। অসহায় মানুষ আর্তনাদ করছিল। এই ভূতুড়ে দল এবার খুব ভাল কাজ করল। ওরা যে শিব আর কালীর দল। ওরা তো ভাল কাজ করবেই। ওরা ভূতুড়ে শক্তি দিয়ে অনেক নৌকা তৈরি করল। কি করে? জলের ওপরে কঙ্কাল দেহ নিয়ে তারা গলা পর্যন্ত দাঁড়াল। শুধু মাথার খুলিগুলি দেখা যাচ্ছিল। সেটাও ছিল এক শ্রাবণের অমাবস্যার রাত। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ওদের ঐ দেহগুলি এক একটি করে বড় বড় বড় বড় নৌকায় পরিণত হল। মানুষ ওগুলোতে চড়ল। তারা নিরাপদ হল। এবার ওদের খাবার কোথা থেকে পাবে? পানীয় জল কোথা থেকে পাবে? তারা সব ব্যবস্থা করল। ঐ নৌকারূপী ভূত আর পেত্নীরাই বলল, " এক্ষুণি খাবার ভরা থালা এসে নৌকা ভরে যাক! কুঁজো ভরা জল আসুক! গ্লাস আসুক! " সব কিছুই নিমেষে এসে গেল। তখন অনেক রাত। সবাই খালি পেটে ঘুমাচ্ছিল। কেউই জানতে পারল না। সকালে উঠে দেখল সব। খুব খুশিতে খেল দেল সবাইই। বৃষ্টি থামে নি। কিন্তু ঐ ভূত আর পেত্নীরাই তাদের শক্তি দিয়ে এমন করল যাতে করে সব জায়গায় বৃষ্টির জল পড়লেও ওদের নৌকায় এক ফোঁটাও বৃষ্টির জল পড়ল না। ওরা দেখে আর অবাক হয়ে যায়। কি সব কাণ্ড ঘটছে! তবে জীবন বেঁচে গেল তো। তাই আর কেউই কিছুই বলল না। ভয়ও পেল না। ভাল কাজকে কি কেউ ভয় পায়? তার ওপরে এই চরম বিপদের সময়। প্রায় এ ভাবে দু সপ্তাহ কাটল। বন্যার জল নেমে গেল। ওরা যে যার ভিটেতে ফিরে গেল। আবার ঘর বানাল। এদিকে নৌকাগুলি পরেই রইল। রাত এলো ঐ সব নৌকা আবার নৌকা রূপ ছেড়ে ভূত আর পেত্নীতেই রূপান্তরিত / রূপান্তরিতা হয়ে গেল। ঐ পরিত্যক্ত মন্দিরে ফিরে গেল।
এরপর কেটে গেছে প্রায় দশ বছর। একদল ডাকাত এসে ওই নন্দীদের ভাঙা বাড়িতে এসে ঠাঁই নিল। তারা সংখ্যায় আড়াই শো জন। সঙ্গে অনেক অস্ত্র শস্ত্র আছে। প্রচুর টাকা, গয়না ও আছে। এখানে তারা এক সপ্তাহ রইল। এবার ডাকাতি করতে বের হল। এদের অনেক ঘোড়া ছিল। এগুলো উঠোনে থাকতো। ঘোড়া চড়ে ডাকাতি করে ফিরছিল। অনেক ধন পেয়েছে। মাঝ পথে ঘোড়ার দল আর সামনে এগিয়ে যেতে চাইল না। থেমে গেল। ডাকাতেরা অনেক চেষ্টা করেও ঘোড়াগুলোকে ছোটাতে পারল না। অগত্যা হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু ঘোড়ারা ওখানেই থেকে গেল। ডাকাতেরা এসে ঢুকল ঐ বাড়িতে। হঠাৎ ওদের রাখা বন্দুকগুলি হাওয়ায় শূণ্যে ওদেরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে লাগল। ওরা অস্ত্রগুলিকে ধরায় চেষ্টা করল। কিন্তু ছুঁতেই পারল না। এরপর নিজে নিজেই বন্দুক থেকে দুম দুম দুম দুম করে গুলি ফায়ার হতে লাগল। কেউ কিছুই বুঝতে পারল না। এমন সময় অদৃশ্য থেকে কারা যেন বলল, " আঁমরা এঁখাঁনে থাঁকি। দু যমজ ভাঁই। তোরাঁ এঁখাঁন থেকেঁ যা। না হোঁলে ঘ্যাঁড় মটকেঁ দেবোঁ। " শুনে ডাকাতরা খুব জোরে হেসে উঠল। এবার সত্যি করেই ওরা দু যমজ ভাই মিলে এক এক এক এক করে সব ডাকাতদের ঘাড় মোটকে মেরে ফেলল। আর শূণ্যে তুলে এনে সবাইকে এক এক এক এক করে সেখানে ফেলে দিল যেখান দিয়ে সকালে লোকজন যাতায়াত করে। এই ডাকাতদের জন্য লোকজন খুব ভয়ে থাকত। এবার সবাই স্বস্তি পেল। আর ঐ ঘোড়াগুলোকে দু ভাই টেনে এনে উঠোনে রাখল। এরাই তো তখন টেনে ধরে রেখে আগে এগোতে দেয় নি। ডাকাতেরা এদের তাই তো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে নি। এখন ঘোড়ার দল খুব সুখে আছে।
ভূতুড়ে বাড়িতে বহু বছর পর কোনো জীবন্ত প্রাণীর বাস হল। ভূতেরা এদের খুব ভালবাসে। নন্দী ভিটের ভূতুড়ে কাণ্ড সম্বন্ধে অনেক মানুষ জানল।
ঐ যে দীঘিটি ছিল। ঐ জল ঘোড়ার দল পান করত। ঐ বাগানে খেত। একদিন ঘোড়ার দল ঐ নন্দী ভিটে থেকে অনেক দূরে বেড়াতে গেল। গিয়ে পৌঁছলো একটি নদীর তীরে। সেখানে দেখা হল ওদের সঙ্গে একটি পনেরো বছরের ছেলের। সে বসেছিল। ওর কাছে ঘোড়ার দল নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। খুব মজার সব কথা। ঐ ছেলেটি ঐ কথা সব বুঝতে পারছিল। সে ছোট থেকেই ঐ নদীর তীরে থাকে। কি করে ও এসেছিল ও নিজেও জানে না। তখন ও একদম শিশু ছিল। ওকে বড় করে নদীর তীরে বাস করা শৃগালের দল। ঐ তীরে ঘন জঙ্গল। কেউই খুব একটা যায় না। কে যে ঐ নির্জন বনে ওকে ফেলে গিয়েছিল? তা যা হোক, ওকে তো বড় করেছে, বন্য প্রাণীর দল। এখন ও এখানেই থাকে। কোন পোশাক পরে না। বনের ফল খায়। নদীর জল পান করে। সব পশুদের ও পাখিদের কথা বোঝে ও। আর ওর কথাও জন্তুরা ও পাখিরাও বোঝে। ঘোড়ার দল অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। কারণ ঘোড়ার দলের কথার উত্তরে সেও মজার কথা বলছিল। আর সে যেমন ওদের কথা বুঝছিল ঠিক ওরাও ওর কথা বুঝতে পারছিল। তাই। এবার ঘোড়ার দল ওকে নিয়ে গেল ওই ভাঙা বাড়িতে। সে ওখানে থাকে।
দু যমজ ভূত ভাই ওকে খাবার ও জল দেয়। ও খায় এবং পান করে। আবার ভূত ভাই দু জনে নিজেদের সেই আগের মানুষের রূপ নিয়ে ওর কাছে আসে। তাই খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এবার ভূতেরা ওকে পোশাক পরাল। লম্বা জটা বাঁধা চুল কেটে দিল। নখ কেটে দিল। ওকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সভ্য করে দিল। ভূতেরা ওকে এবার লেখাপড়া শেখালো। ভূতেরা ওকে শিখিয়ে দিল কি ভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। শিখে নিল। ও এখন মানুষের মধ্যে আসে। আলাপ করে। এবার ভূতেরা ওকে ওদের গোপন ধনের সন্ধান জানালো। ব্যবসা করা শেখালো। ওর নাম দিল, ধনপতি নন্দী। ধনপতি এখন জমিয়ে ব্যবসা করে। নন্দীদের সোনার ও রত্নের ব্যবসা আবার চালু হল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে ও আগের জঙ্গলে বেড়াতে যায়। সেখানকার জন্তুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। পরে ওকে ভূতেরা বলল যে ও যেন আবার ঐ মন্দিরের সংস্কার করে ফের পূজা শুরু করে। আর এই পুরনো বাড়িটিরও যেন সংস্কার করে। ও ও তাইই করল। তবে কেউই এখানে ভূতের ভয়ে আসে না। কি আর করে ধনপতি! কিন্তু শিব ও শক্তির দয়া আছে ওর ওপরে। এক দিন পুরো এলাকায় খুব তেজ ভূমিকম্প হল। অনেক ক্ষয় ক্ষতি হল। কিন্তু ঐ মন্দিরটি একটুও কাঁপল না। ঐ বাড়িটিও কাঁপল না। আর সে কথা ধনপতি সকলকে বলল। ওর কথা আগে থেকেই সকলেই খুব বিশ্বাস করত। তাই এখনও করল। কিন্তু কেন? সবাই ভাবতে লাগল।
এরপর ধনপতি রাতে ঘুমাচ্ছিল। এমন সময় স্বপ্নে শিব ও শক্তি দেখা দিয়ে বললেন, " আমরা এই জায়গাতে ভূমিকম্প করাই নি। অন্য সব জায়গায় আমরাই করিয়েছি। তুই সকলকে সকালে বলবি যে যদি মন্দিরে ওরা আসে তো খুব ভাল হবে। আর না এলে ওদের সর্বনাশ হবে। " সকালে সে এই স্বপ্নের কথা সবাইকে জানিয়ে দিল। ভয়ে এবার থেকে সবাই আবার মন্দিরে পুজো দিতে এল। গ্রামের এক পূজারী পুজোর দ্বায়িত্ব নিল।
এবার ভূত ভাই দু জন যারা পুজো দিতে আসে তাদের পুজো দেওয়ার তামা বা পিতলের থালাগুলি সোনার করে দেয়। নৈবেদ্য নিয়ে তাই এখন সবাই থালা নিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে এ খবর দূর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। তাই বহু দূরের মানুষও আসতে শুরু করল।
এবার ভূত ভাই দু জন ধনপতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, " এবার মন্দিরটি সোনার বানাও! " সে তাইই করল।
এবার ভূতেরা ঐ দীঘির জলে ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটাতে লাগল। ঐ জলে যে কেউ যদি কোন সতেরো কেজি ওজনের লোহার ত্রিশূল একমাস ডুবিয়ে রাখে তবে ওটি সোনার হয়ে যায়। কি ভাবে এটা প্রচার হল! একদিন ভূত ভাই দু জন একটা ওই ওজনের ত্রিশূল এনে অনেক উঁচু থেকে জলে ঝপাৎ করে ফেলল আর এমনভাবে ফেলল যে জল ছিটকে পুরো মন্দির ভিজে গেল। আর ওই সময় মন্দিরের সামনে অনেক ভক্ত বসেছিল। তারা শব্দ শুনে ও ছেটকানো জল দেখে উঠে গিয়ে ঘাটে দাঁড়ালো। দেখল যে ঘাটের একদম কাছে একটি ভারী ও বড় সোনার ত্রিশূল। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। এমন সময় জলের ভেতর থেকে ওই দু যমজ ভাই চিৎ সাঁতারে ভেসে উঠল। আর বলল, " এই জলে যদি কেউ সতেরো কেজি ওজনের লোহার ত্রিশূল ডুবিয়ে দেয় তবে তা একমাস সময় পরে সোনার ত্রিশূল হয়ে যাবে। " এ কথা বলেই ওরা দুজনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সবাই এই কথা শুনে তাইই করতে লাগল। দীঘিটি আবার অতীতের মত ব্যবহৃত হতে লাগল।
এবার ওই মন্দিরের সামনে একদিন এসে দাঁড়াল ওই ঘোড়ার দল। তখন শিব ও শক্তির মূর্তি থেকে উজ্জ্বল জ্যোতি বের হয়ে ওই ঘোড়ার পিঠে এসে পড়তে লাগল। আর ওই জায়গা থেকে দুটি ডানা বের হল। আর ওরা উড়তে লাগল। আকাশে উড়ে গেল। এলাকার মানুষ দেখতে লাগল। এখন মানুষ ওদের পিঠে চড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া আসা করতে লাগল। আবার এদের পিঠে চড়ে স্থল পথেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া আসা করতে লাগল। সকলেই খুব খুশি।
এই নন্দীদের বাগানে মানুষ আসে। এক শিব রাত্রিতে কয়েক জন ওই বাগান থেকে বেল পাতা তুলতে গেল। তারা তো দেখে ও শুনে অবাক হল। কি ঘটনা ঘটল? প্রতিটি পাতা যেগুলি ওরা গাছ থেকে তুলে নিজেদের কাছে রাখল সেগুলি তারা হয়ে গেল আর আকাশে গিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, " আমরা অপেক্ষা করছিলাম, যে শিব রাত্রির রাতে আমাদের কোন উপবাসী ভক্ত যখন তুলে নেবে ঠিক তখনই আমাদের মুক্তি হবে। আমরা বহু বছর আগে এই মন্দিরের আশে পাশে থাকতাম। আমরা বাদুড় ছিলাম। এক শিব রাত্রিতে আমরা কোন ভক্তকে এই মন্দিরে ঢুকতে দিই নি। ঝাপটা দিয়ে দিয়ে চোখের ওপরে আঘাত করেছিলাম। তখন এই মন্দিরটি নতুন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এমন সময় প্রতিষ্ঠাতা আমাদের গুলি করে মারে। আর অভিশাপ দিয়েছিল যে আমরা এই গাছে ভূত আর পেত্নী হয়ে থাকব। আর তখন আমরা ভুত ও পেত্নী হয়ে তার পায়ে ধরে বলি, " আমরা কি করে মুক্তি পাব? আমরা জানতে চাই! সে তখন আমাদের মুক্তির উপায় বলে দেয়। আর আজ সেই রাত এলো। আমরা পাতার রূপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তোমাদের নমষ্কার জানাই! তোমাদের জন্য আজ আমরা প্রেতাত্মা থেকে মুক্তি পেয়ে আকাশের তারা হলাম। " ওরা হতবম্ব হয়ে গেল। আবার অন্য পাতা তুলে নিয়ে চলল মন্দিরের দিকে। ফিরে এসে সকলকে বলল। সবাই ওদেরকে বাহবা দিল।
পূজো চলছে এমন সময় ওই দু যমজ ভূত ভাই এসে মন্দিরের সামনে বসল। কেউ বুঝতেও পারল না। অঞ্জলি প্রদান করার সময় সবাইই দেখতে পেল যে দুটি পুষ্পাঞ্জলি শূণ্যে উড়ে এসে শিবের শিরে পড়ছে। কেউ কেউ ভয় পেল। তখন পূজারী বললেন, " আমি দেখতে পাচ্ছি, দু যমজ ভূত ভাই এখানে আছে আর তারাই এই অঞ্জলি প্রদান করছে। শিব ঠাকুর ওদের অঞ্জলি গ্রহণ করছেন। ওরাও শিব ঠাকুরের খুব বড় ভক্ত। " সারা রাত ভক্তের দল ওখানে জেগে আছে। মাঝ রাতে সবাই দেখল যে বাবা ভূতনাথ দেব তার ভূত আর পেত্নী সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে খুব আনন্দে নৃত্য করছেন। আর মহাদেবের সামনে দেবী দাঁড়িয়ে আছেন। দেব দেবীকে গন্ধরাজের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। ভক্তরা এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলল। কত সৌভাগ্য হলে তবে এ পুণ্যের দৃশ্য দর্শন করা যায়! এবার ভূত ও পেত্নীর বর যাত্রীরা ওই মন্দিরে রাখা ফল ও মিষ্টি খেতে থাকল। দু চোখ ভরে ভক্তরা দেখতে লাগল। শিব আর শক্তি ও ওই মিষ্টি ও ফল বড় তৃপ্তির সঙ্গে খেতে লাগলেন। ভোর হল সবাই গিয়ে মূর্তির সঙ্গে মিশে গেল।
এবার চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিনে চড়কের পূজো হচ্ছে। রাতে মন্দিরের সামনে অনেক ভক্ত এসেছে। সকলে দেখল যে দীঘির জল থেকে একের পর এক ১০৮ টি করে মুক্ত দিয়ে গাঁথা মুক্তর মালা আপন আপনিই উঠে আসছে আর মূর্তি দুটির গলায় পরা হয়ে যাচ্ছে। এর পর একটি সুন্দর আলোকিত চাঁদ উঠে এসে শিবের কপালের ওপরে আটকে গেল। কি অপূর্ব আলো সেই চাঁদ থেকে বেরিয়ে সারা জায়গা মনোরম করে তুলল। এখন এই আলোর মধ্যে বহু ভূত আর পেত্নী নৃত্য করতে লাগল।
এবার একদিন পূজারী নন্দীদের বাগানে পূজোর জন্য ফুল তুলতে গেল। হাতে এক বিরাট পিতলের সাজি তার। সেটা ছিল বৈশাখ মাস। চাঁপা গাছে প্রচুর ফুল ফুটেছে। সুবাস বহু দূরে ছড়িয়ে পড়েছে। পূজারী একটি শাখা টেনে ধরে নিচের দিকে নামিয়ে ফুল তুলতে গেল। ওমনি ফুলটি বলে উঠলো, " আমি বহু বছর আগে ওই মন্দির থেকে দেবীর গয়না চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি ওই মন্দির তখন পরিষ্কার করতাম। আমার বয়স ছিল ঊনিশ বছর। আমার বাবা ওই মন্দিরের পূজারী ছিল। তার এক চোখ কানা ছিল। আমি খুব সুন্দরী ছিলাম। একটি ছেলের সঙ্গে আমার প্রেম হয়। তার সঙ্গে ঠাকুরের গয়না নিয়ে আমি রাতের বেলায় পালিয়ে যাচ্ছিলাম। যেই না কিছুটা গেছি ওমনি আমার পায়ে সাপ কামড়ালো। আর আমি কিছুটা গিয়ে আর এগোতে পারলাম না। বসে পড়লাম। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার প্রেমিক তখন আমায় ফেলে সব গয়না নিয়ে পালিয়ে যায়। আমি মরে পরে থাকি। আমাকে তখন সকাল বেলায় লোক দেখতে পায়। দাহ না করে একটি নৌকোয় শুইয়ে দিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। মাঝ নদীতে আমাকে কুমিরে খায়। সে কুমিরটি একটি পেত্নী ছিল। রূপ বদল করতে পারত। আমাকে খেয়ে নিয়ে সে খুব খুশি। আর আমার আত্মা ওই যে রাস্তায় মারা যাবার পর বেরিয়ে এসে এই চাঁপা গাছে উঠল তারপর থেকে আর নামিনি আমি। একদিন শিব ও শক্তির মন্দিরের নন্দী মহারাজ এই চাঁপা গাছের নিচে বৈশাখ মাসের দুপুরে বসে বিশ্রাম করছিল। তখন আমি পেত্নী রূপে তার পায়ে প্রণাম করে বলেছিলাম যে আমাকে তোমাদের সাঙ্গ পাঙ্গ করে নাও! সে তখন বলেছিল, " ঠিক এই দিনে যদি কোন শিব ও শক্তির পূজারী তোকে তুলে নিয়ে পুজো করতে চায় তখন তোকে তলার ঠিক আগে তুই তোর অতীতের সব ঘটনা তাকে বলবি। এরপরও যদি সে তোকে তুলে নেয় ও তোকে নিয়ে গিয়ে শিবের পায়ে রাখে তাহলে তুই আমাদের সাঙ্গ পাঙ্গ হবি। " আজ বহু বছর পর সেই সব কথা মিলে গেল। তুমি কি আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে শিবের পায়ে রাখবে? বল! পূজারী বলল যে ঠিক আছে সে তাইই করবে। এবার সেই প্রেতাত্মা রূপী চাঁপা ফুলটি নন্দীর আশেপাশে শিবের সাঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আরেক দিন গ্রামের এক যুবক ওই বাগানের কলা গাছ থেকে কলা পাতা কাটতে গেল। তার বাড়িতে তার মেয়ের বিয়ের জন্য পাত হবে বলে। সেই কলা গাছের নিচের মাটিতে গাড়া ছিল একটি কঙ্কাল। মৃত মানুষকে গেড়ে দিয়েছিল। পরে কঙ্কাল হয়। সেই গাছের তলায় যেই না ও দাঁড়ালো ওমনি কঙ্কাল মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। ও তো তাকে দেখেই দৌড় দিল। কিন্তু কঙ্কাল ছাড়ার পাত্র নয়। সেও দৌড় লাগাল। আর চেঁচিয়ে বলল, " দাঁড়া রেঁ! আঁমি তোঁর কোঁনো ক্ষতি কোঁরবো না! " ও একটু থামল এখন। বলল, " তুইঁ এঁকটি বোঁড় পিঁতলের কলসিঁ এঁনে ওইঁ দীঘির জল ভোঁরে তা আঁজকের দিনে শিবের মাথায় ধলবি। আঁর ওইঁ জল ফেঁর কলসে ধরে নিবি। মন্দিরের মেঝেতে পড়তে দিবি না! শিবের পূজোর পঁর ওইঁ কলস ভরা জল এঁনে তুইঁ এঁই মাটির ওপরে ঢেলে দিবি। আঁমার কঙ্কালে ওইঁ জল ছুঁলেই আঁমার মুক্তি হবে। আঁমাকে আঁর এইঁ কঙ্কালের ভেতরে ভূত হয়ে থাকতে হবেঁ না। " লোকটি তাই করল। ও খুব ভাল মানুষ। তার ওপরে ওর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। তার মঙ্গল কামনা করে সে ভাল কাজ করল। বাড়ি গিয়ে একটি পিতলের কলস আনল। দীঘিতে ১০৮ টি ডুব দিয়ে স্নান করল। কলস জল দিয়ে ভরল। শিবের মাথায় ঢালল ও সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার কলসে ভরে নিল। নিয়ে এসে ওই কলা গাছের নিচের মাটিতে ঢালল। সেটা মাটির ভেতরে ঢুকে কংকালকে স্পর্শ করল। ওমনি ও ভূত হয়ে না থেকে ওই গাছটিতে একটা বিরাট কলার কাঁদি হয়ে ঝুলতে লাগল। লোকটি কলা পাতা কেটে নিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেল।
এবার বিয়েতে নিমন্ত্রিত জন বসে খাচ্ছে। এমন সময় সকলের মাথায় একটা করে হিরে বসানো প্লাটিনামের মুকুট নিজে নিজেই পরা হয়ে যাচ্ছে। সবাই খুব অবাক হয়ে গেল। এ কি ঘটনা! যখন সকল লোকজন খেয়ে উঠে হাত ধুতে লাগল তখন ঐ কঙ্কাল থেকে সদ্য মুক্ত পাওয়া ভূতটি যে কলার কাঁদি হয়ে ছিল সে পেকে গেল, হঠাৎ করে আর নিজে নিজেই এসে এক একটি পাকা কলা হাওয়ায় ভেসে এসে সবার সবে মাত্র ধোওয়া হাতে এসে পড়ল। বিরাট কাঁদি। অনেক কলা। কিন্তু লোকজন তার থেকেও অনেক বেশি। অথচ কাঁদির কলা কিছুতেই আর শেষ হল না। সবার হাতে একটা করে আসার পরই কলার কাঁদির সব কলা শেষ হল। ভূতটি তখন ওখানে বিয়ে বাড়িতে অদৃশ্য হয়ে ঘুরতে লাগল আর নানান প্রয়োজনীয় কাজ করতে লাগল। উপকারীর উপকারের বিনিময়ে সে তাকে উপকার করতে থাকল।
নন্দীদের বাগানে একটি খুব লম্বা নারকোল গাছ ছিল। বুড়ো গাছ। বারো মাস অনেক ফল দেয়। এই গাছের ওপরে থাকত একটি পেত্নী। সে মন্দিরের দেবীর কাজ করত। এ ইচ্ছা হলে মন্দিরের দেবীর কাছেও এসে থাকে। এ ওই গাছের ফলগুলিকে এমন করে দিত যাতে করে যে ওই ফল নিজে গাছের ওপরে উঠে নিজের হাতে পেরে নিজেই তা মন্দিরে পুজো দিয়ে তারপর সেই প্রসাদ খেত, তার তারপর থেকে আর কখনই অসুখ হত না। আর তারা কেউ এক শত বছরের আগে মরত না। এ কথা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল। দূর দূর থেকে সবাই এসে ওই ফল খেতে লাগল।
ওই বাগানে একটি তাল গাছ ছিল। ওই গাছে একটা বিশাল বাবুই পাখির বাসা ছিল। তাতে ভূত ও পেত্নী পাখি হয়ে থাকত। এই ভূত ও পেত্নীগুলো বহু দূরের একটা গ্রামের বন্যার সময় বহু বছর আগে মারা গিয়েছিল। ওরা উড়তে উড়তে এসে এই তাল গাছে ঠাঁই নেয়। পরে বাবুই পাখি রূপে বাসা বানায়। আর ওরা ওই বাসায় থাকে। আর যখন কেউ ওই গাছে উঠত তখন তাদেরকে গাছ থেকে ফেলে দিত। কয়েক জন পরে যাবার পর আর কেউ ওই গাছে উঠত না। ওরা তাই নিশ্চিন্তে থাকত। এদের ইচ্ছা অন্য রকম হল এবার। এরাও এবার ওই মন্দিরের দেব ও দেবীর সাঙ্গ পাঙ্গ হতে চাইল। পাখি হয়ে উড়ে এসে মূর্তির পায়ে বসল। মনের কথা দেব ও দেবীকে জানালো। ওনারা ওদেরকে নিজেদের কাজে লাগিয়ে নিলেন। ওরা আর ওই গাছে থাকে না। মন্দিরে থাকে। তবে ওই গাছে এখনও কেউই ওঠে না।
ওই বাগানের একটি গর্তে এক জোড়া সাপ ছিল। তাদের বয়স এক হাজার বছর। তাদের মাথায় দুটি মণি ছিল। সে দুটি থেকে জ্যোতি বের হত। এই সাপ দুটি নিজেদের ইচ্ছা মত রূপ বদলাতে পারত। এরা একবার রূপ পাল্টে ভূত আর পেত্নী হল। হয়ে মন্দিরের সামনে এসে খুব নাচতে লাগল। সে রাত ছিল নাগ পঞ্চমীর। ওদের নাচ দেখে দেব ও দেবীর মন ভরে গেল। তারা বলল, " কি বর চাস? চেয়ে নে! " ওরা বলল, " আমাদের মণি তোমাদের মাথায় শোভা পাবে। আর আমরা দু জনে সাপ হয়ে তোমাদের অঙ্গে থাকব! " দেব ও দেবী বললেন, " ঠিক আছে ! " ওরা এখন ওভাবেই থাকে। মণি দুটি থেকে ঠিকড়ে আলো বেরোচ্ছে। এক রাতে এক অনেক দূরের গ্রাম থেকে এক জন এল ওই মন্দিরে পুজো দিতে। মণি দুটি দেখে ওর চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠলো। সুযোগ খুঁজতে লাগল। যেই পেল ওমনি খুলে নেবার চেষ্টা করল। যেই হাত লাগালো ওমনি সাপ দুটি এক সঙ্গে ওর দু হাতে দংশন করল। ও ওখানেই মুখে ফেনা উঠে মারা গেল। লোক জন এসে দেখল। ও এখন ভূত। দেব ও দেবীতে বলল, " আমাকে আপনাদের সাঙ্গ করে নিন! " দেব ও দেবী তাকে সাঙ্গ করে নিলেন। সে এখন ভূত হয়ে দেব ও দেবীর আদেশ মত সকলের জন্য ভাল কাজ করতে লাগল।
এই বাগানে এক বার এক দল কাঠুরে এল। তারা মোটা মোটা মোটা মোটা শাল গাছ ছিল। ওরা করাত নিয়ে এল কেটে নিয়ে যাবে। যখন মালিক বারণ করতে এলো তখন তাকে সবাই খুব ভয় দেখাল। বলল যে কেটে কুঁচিয়ে ফেলবে। সে বাড়িতে ফিরে এল। যেই না ওরা গাছে করাত চালালো ওমনি সেই করাত ঘুরে এসে নিজের হাতেই নিজের গলার ওপরে চলতে লাগল। গাছের বদলে তাদের মাতা কাটা পড়ল। এবার এরা রাতের বেলায় মাথা হীন ভূত হয়ে বাগানে ঘুরতে লাগল। অনেকেই তাদের দেখতে পেল। এক কার্তিক অমাবস্যার রাতে তারা নন্দীদের বাগান ছেড়ে মন্দিরে এল। ওখানে পুজো হচ্ছিল। ওদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু ওরা সকলকে দেখতে পাচ্ছিল। ওরা অঞ্জলি দিল। এরপর দেব ও দেবী সন্তুষ্ট হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " তোরা কি চাস? " তারা বলল যে তাদেরকে যেন দেব ও দেবী নিজেদের সাঙ্গ পাঙ্গ করে নেন। ওনারা তাই করে নিলেন। এখন ওরা দেব ও দেবীর আদেশ মত খুব ভাল কাজ করতে লাগল। আর মন্দিরে থাকতে লাগল।
এবার ওই দীঘির জলে মকর সংক্রান্তির ভোরে স্নান করতে এল। তারা দেখল সারা দীঘির জলে বড় বড় বড় বড় রূপোর মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা স্নান করছে আর দু হাতে করে জল থেকে তুলে যার যত খুশি মাছ ধরে নিয়ে নিজেদের বাড়ি নিয়ে গেল।
এবার আরেক দিন - অক্ষয় তৃতীয়া - সেদিন অনেকেই ঘট ভরে জল আনতে গেল। দীঘির জলে সবাই দেখল অনেক ঝিনুক ডুবছে আর ভাসছে। এখন একজন আগ্রহ করে একটি ঝিনুক তুলে নিল। ওমনি ওই ঝিনুক ওর হাতের মধ্যে নিজের দুটি ঢাকনা খুলে দিল। ও দেখল যে ভেতরে একটা বিরাট মুক্ত। ও ওটা খুলে নিয়ে আবার ঝিনুকটিকে জলে ছেড়ে দিল। ও ডুব দিয়ে দীঘির নিচে গিয়ে পাঁকে ঢুকে গেল। এই মুক্ত দেখে এবার সবাই ঝিনুক থেকে মুক্ত নিতে লাগল। ওই অক্ষয় তৃতীয়ার রাতে যারা যারা যারা যারা মুক্ত নিয়েছে তাদের তাদের তাদের তাদের বাড়িতে ওই মুক্তগুলো পেত্নী হয়ে দাঁড়ালো। আর বলল, " আমরা সবাই পেত্নী। ভূমিকম্পের সময় বাড়ি ভেঙে পড়ে চাপা পড়ে মরি। এরপর থেকেই আমরা মুক্ত হয়ে ওই দীঘির জলে আছে। আমরা মারা যাবার আগে অনেক এক দূরের গ্রামে থাকতাম। পেত্নী হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে অনেক বছর পর ঠাঁই নিই। সেই থেকে অপেক্ষা করছিলাম কবে আমরা মুক্তি পাব। ওই দীঘির জল আমাদের বলেছিল, " অক্ষয় তৃতীয়ায় যদি আমরা ভক্তদের দ্বারা ঝিনুক থেকে বেরিয়ে তাদের হাতের পরশ পাই তবে আমাদের মুক্তি হবে। আর এর পর তাদের বাড়িতে গিয়ে রাতের বেলায় তাদেরকে বলতে হবে যে যেন তারা তাদের পাওয়া সকল মুক্ত ওই নন্দীদের মন্দিরের দেব ও দেবীদের গলায় হার রূপে বানিয়ে পরায় তবেই তারা চির কালের জন্য দেব ও দেবীর হার হয়ে থেকে যাবে। আর যদি যারা মুক্ত পেয়েছে তারা যদি এ কাজ না করে তবে তাদের তিন রাতের মধ্যে মৃত্যু হবে। " এ কথা শুনে সবাই মুক্তর মালা বানিয়ে দেব ও দেবীর গলায় পরাল। ওরা ওখানেই থেকে গেল। পেত্নী হয়ে আর তাদের জলের নিচে থাকতে হল না।
ওই দীঘির জলে এক ধরণের গাছ ভাসত। তাতে এক অপূর্ব সুন্দর ফুল ফুটত। এই ফুল তেরো বছর বাদ এক বার ফুটত। আর গাছটি ফুল ফোটার পর মারা যেত। আর গাছের বয়স তেরো বছর হলেই তবে ফুল ফুটত। এই ফুল মন্দিরের দেবীর পায়ে দেওয়া হত। এর পরে এই গাছটি মারা যেত আর মারা যাবার পর পেত্নী হয়ে যেত। এসে মন্দিরের দেবীর পায়ে মিশত। আর পরের দিন পূজোর ফুলটি যখন ওই দীঘির জলে ফেলা হত তার থেকে তখন নতুন একটি গাছের জন্ম হত। এই গাছের ছয়টি পাতা অশোক ষষ্ঠীর দিনে উপবাস করে কেউ কাঁচা চিবিয়ে খেলে তার আর মাথার চুল কখনোই পাকত না।
নন্দীদের ভিটের ভূতুড়ে কাণ্ড ক্রমশ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল।
এবার নন্দীদের বাড়ির ছাদে একদিন মন্দিরের দেব ও দেবী জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় হাঁটাহাঁটি করছেন। সঙ্গে তাঁদের ভূত আর পেত্নীরাও আছে। নন্দী ও ভৃঙ্গীও আছে। হঠাৎ আকাশ থেকে একদল ডাকিনী, যোগিনী, শাঁখচুন্নী আর ব্রম্ভদৈত্য এল। ছাদে এসে তারা দেব ও দেবীকে প্রণাম জানালো। তারা বলল যে এখন থেকে তারা ওই মন্দিরে থাকবে। দেব ও দেবী রাজী হল। ওরা রইল তখন। সেখানে তখন ক্ষরা হল। একদম নয় বছর বৃষ্টি হল না। মানুষ ও পশু মরতে লাগল। সব দিক ফাঁকা হয়ে গেল। কয়েক জন মানুষ ও কয়েকটি জন্তু বেঁচে আছে। তাও তারা ধুঁকছে। কোথাও একটুও জল নেই। শুধু নন্দীদের দীঘিতে জল আছে। ওখানেই জল খেয়ে বেঁচে রইল। দেব ও দেবীকে যারা বেঁচে ছিল তারা বৃষ্টির জল দিতে বলল। কিন্তু ওনারা দিলেন না। এমন সময় ওই ডাকিনী, যোগিনী, শাঁখচুন্নি আর ব্রম্ভদৈত্য দেব ও দেবীকে অনেক করে মিনতি জানাল। বৃষ্টি দিতে বলল। কিন্তু ওনার বললেন যে এই কাজ একমাত্র বরুণ দেব করতে পারেন। তাঁরা কিছুই করতে পারবে না। দেব ও দেবী বরুণের কাছে স্বর্গে গেল। তাঁকে রাজী করালেন। খুব বৃষ্টি হল। এবার যারা ক্ষরায় মারা গিয়ে ভূত আর পেত্নী হয়ে ঘুরছিল তারা দেব ও দেবীকে বলে বরুণ দেবকে রাজি করালো। তারা বলেছিল যে ওরা এখন থেকে স্বর্গে বরুণ দেবের ওখানে থাকবে। আর তাঁর আদেশ মত কাজ করবে। ওরা স্বর্গে চলে গেল। ওখানে থাকাকালীন ওরা একবার বরুণ দেবকে না জানিয়ে ওদের আগের জায়গায়, যখন মানুষ ছিল সেই জায়গায় থাকত, সেখানে বেড়াতে এল। পরে আবার স্বর্গে বরুণ দেবের কাছে ফিরে গেল। কিন্তু বরুণ দেব খুব অসন্তুষ্ট হলেন। ওদেরকে আর স্বর্গে থাকতে দিলেন না। ওরা তখন মর্তে এসে ওই নন্দীদের মন্দিরে এসে দেব ও দেবীকে তাদের ঠাঁই দেবার জন্য অনুরোধ করল। ওঁরা মত দিল। সেখানে ওরা ভূত আর পেত্নী হয়ে থেকে গেল। আর তাঁদের মত অনুযায়ী ভাল কাজ করতে লাগল।
এক শ্রাবণ মাসের অমাবশ্যার রাত। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের ভেতরে শুধু লাল রঙের অনেক চোখ দেখা যাচ্ছে। সেই চোখগুলি বৃষ্টির জলের সঙ্গে নেমে আসছে। এই চোখগুলি যেই নেচে এসে কোন কিছুকে স্পর্শ করছে ওমনি সেই চোখ থেকে লাল রক্ত স্রোত বেরিয়ে আসছে। যেমন, একটি চোখ ছুঁল বাগানের একটি কাঁঠাল গাছকে ওমনি ওই গাছ থেকে রক্তের প্লাবন বয়ে গেল। সারা বাগান রক্তে ভেসে গেল। এই ভাবে সারা এলাকায় যেখানে যেখানে ওই লাল চোখ পড়তে লাগল সেখান সেখান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। বৃষ্টি থামার নাম নেই। আর রক্ত প্রবাহিত হয়েই চলল। সকলেই ভয় পেয়ে গেল। এই চোখ হল পেত্নী। মন্দিরের দেবী এই রক্ত স্রোত দেখে বন্ধ করে দিতে চাইলেন। তখন তিনি একটি চোখকে নিচে পড়ার আগেই নিজের হাতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " তুই কে? " সেই চোখ বলল যে সে মঙ্গল গ্রহের পেত্নী। পৃথিবীতে এসে রক্ত স্রোত আনছে। যদি দেবী তাকে তার নিজের কপালে ঠাঁই দেন তাহলে সে খুব আনন্দ পাবে। আর সে অন্য সব চোখকে তখন তার মধ্যে যুক্ত করে নেবে। সকলে মিলে একটি মাত্র চোখে পরিণত হবে। সেই একটি চোখের শক্তি খুব বেশি হবে। তার দৃষ্টিতে পৃথিবীর খুব মঙ্গল হবে। দেবী রাজী হল। তখন বৃষ্টি হল। কিন্তু চোখের বৃষ্টি আর হল না। রক্ত স্রোত বন্ধ হল। এখন থেকে দেবীর কপালে তৃতীয় চোখ ঠাঁই পেল।
এই ভাবে নন্দী ভিটের ভূতুড়ে কাণ্ড ক্রমশ বাড়তেই থাকল।
Comments
Post a Comment