তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

স্মৃতির দোকান | দেবাঙ্গনা চৌধুরী | অণুগল্প ৭


একটা শহর ছিল, সেখানে মানুষজন মিলেমিশে থাকত। হঠাৎ একদিন সেই শহরে এক অদ্ভুত রোগ দেখা দিল। শহরের সব প্রবীণদেবাঙ্গনা চৌধুরীরা ধীরে ধীরে সবকিছু ভুলে যেতে লাগলেন। তারা আচরণ করতে লাগলেন, একেবারে শিশুদের মতো। কেউ মাঠে খেলতে যাওয়ার জন্য জেদ করতেন, কেউবা ফ্রক পরে লাল রিবন দিয়ে চুল বেঁধে ঘুরে বেড়াতেন। পরিবারগুলো হতবাক হয়ে গিয়েছিল। প্রিয় মানুষগুলো হঠাৎ কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠছিল পরিবারগুলোর কাছে। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে শহরের এক কোণায় গড়ে উঠলো এক আজব দোকান—"স্মৃতির দোকান”। শোনা গেল, এখানে কেউ চাইলে তাদের কাছের মানুষদের মনোরম স্মৃতি বিক্রি করে, তার বিনিময়ে পরিবারের বয়স্কদের জন্য হারানো স্মৃতি ফেরত নিয়ে যেতে পারে।

সেই শহরেই থাকত উপাসক, তার মা, স্ত্রী অপর্ণা ও তাদের আট বছরের ছোট মেয়ে রিয়া। উপাসক সদা চুপচাপ, চিন্তায় নিমগ্ন থাকতো। কারণ, তার মা এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতেন, বিকেলে পুতুল নিয়ে খেলতেন, নিজের ছেলেকে “ভাই” বলে ডাকতেন আর বৌমাকে “পাড়ার মেয়ে" ভাবতেন। রিয়াকে দেখলেই রেগে যেতেন আর বলতেন, “ও আমার জায়গা দখল করতে কেন এসেছে? সরাও ওকে এখান থেকে।”

উপাসক অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। কোনো ওষুধ, কোনো চিকিৎসা কাজে লাগছিল না আর। তাই সে একদিন “স্মৃতির দোকান” এ যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। দোকানে গিয়ে অসহায় হয়ে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বললো দোকানদারকে। দোকানি অনেক ভেবে বললেন, “হুম, তোমার মায়ের সব স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব, যদি সেটার বিনিময়ে তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলো বিক্রি করে দাও”। উপাসক এইকথাটা শোনার পর চুপ করে গেল। "কোন স্মৃতি?"—আমতা আমতা করে জানতে চাইল সে। তখন দোকানদার বললেন, “তোমার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত যেমন তোমাদের প্রথম চুমু খাওয়া, বিয়ের ফুলসজ্জার রাত, মেয়ের প্রথম "বাবা" বলে ডাকা, রিয়ার প্রথম স্কুলে যাওয়া—সব কিছু। পারবে দিতে? ওরা ভুলে যাবে সব, কিন্তু তোমার মনে থাকবে সারাটা জীবন।“ উপাসক দ্বিধায় পরে গেল।

রাতে খাওয়ার পর উপাসক নিঃশব্দে দরজার আড়ালে এসে দাঁড়ালো। অপর্ণা তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁথিতে সিঁদুর দিচ্ছিল নিখুঁতভাবে। আর সেই মুহূর্তে রিয়া, পড়াশুনা করতে করতে মাকে দেখে বললো, "মা, বড় হয়ে আমিও না, বাবার মতো কাউকে বিয়ে করব, আর তারপর তোমার মতো করে সিঁদুর পরবো"। তবুও, তবুও সেই রাতে উপাসক কাউকে না জানিয়ে ফয়সালা করে দোকানিকে জানালো যে, সে তার স্ত্রীর আর মেয়ের সকল স্মৃতি দিয়ে নিজের মার স্মৃতি কিনবেই। দোকানদারও ভাবেননি উপাসক রাজি হয়ে যাবে তার প্রস্তাবে। “একবার মাকে ফিরে পেলেই, সব আগের মতোন হয়ে যাবে”—একটা অলীক দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নেয় উপাসকের মনে।

পরদিন সকালে তার মা সত্যিই আগের মতোন হয়ে গেলেন। উপাসককে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললেন, “আমার ছেলে! কেমন আছিস, বাবা?” উপাসকের চোখে মুখে তখন হাসি ফুটল। কিন্তু অপর্ণা, সে তখন দূরে দাঁড়িয়ে। সে উপাসকের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। রিয়াও বলে উঠলো মায়ের আঁচলের পিছন থেকে, “মা! এই কাকুটা কে গো?”

স্মৃতির দোকান বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হল। শহরও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কেবল উপাসকই রয়ে গেছে অতীতের ফ্রেমে আটকে। প্রতিদিন সে মার সাথে গল্প করে, সন্ধ্যায় মার পাশে বসে চা খায়। ঘরটা নিঃশব্দ, কিন্তু উপাসকের ভেতরে ছিল এক দারুণ ব্যস্ততা— মায়ের প্রতিটি মুহূর্তকে নতুন করে অনুভব করানোর উত্তেজনা। মা রান্না করতে করতে একদিন উপাসককে বললেন, "বাবা! আজকে তোর পছন্দের খাসির রেসিপিটা করবো?” উপাসক তখন থমকে গেল। সে ভাবলো, “আশ্চর্য তো! এটা তো নীলাদ্রির সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল। আর আমি তো সেই ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই নিরামিষাশী হয়ে গিয়েছিলাম। তাহলে কি মা এতদিন আমাকে…?”

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.