বাতাস বদলের রঙ | মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস | গল্প ১৭
না, যন্ত্রে আপটুডেট না হলে চলবেনা। স্মার্টনেস নেই কিচ্ছু না। আর ছেলে মেয়েকে বার কয়েক জানিনা, বুঝিনা ইত্যাদি বলতে গেলে'পঙ্গু' শব্দটা শুনতে হয়েছে দু'একবার। মানে মোবাইল ঠিকঠাক ব্যবহার করতে না পারাটা এক্কেবারে ক্রাইম। এ এক অসহ্য জীবন এলো দিয়াসিনীর। মনে হয় 'ডিপ্রেশন' শব্দটা বেশ বোঝে এখন সে। খুব একটা বেঁচে বর্ত্মে থাকার ইচ্ছেটা মরো মরো। ওদিকে বিশাল বিপুল মাত্রায় 'টেকসাভি', নাওয়া খাওয়া ভুলে ওতে মজে থাকাও কেমন যেন! নানা আলোচনা সমালোচনায় মুখর সময়। কোনটা ঠিক পথ দিয়াসিনীরা থই পায়না। আসলে 'ব্লিংকিটে' টিক টক সামান্য তেল নুনের বাজার বা লঙ্কা জাতীয় বাজার কিংবা চিনি আটা... যাই দরকার ওটাই সম্বল... এখনকার এসব গল্প শুনে চোখে দেখে ভিরমি খাওয়ার দশা দিয়াশিনীর। সামান্য ফোড়নের জিনিস, ডিম, পেঁয়াজ.. যাই লাগুক, জরুরি ভিত্তিতে হলেও জামা পালটে দোকানের দিকে বেরিয়ে পড়া তার স্বভাব। সেটাই সুস্থ স্বাভাবিক মনে করে সে। অন লাইন শপিং এর এই সত্যিকার অথর্ব করে দেওয়ার পন্থা গুলো দিয়াসিনী বা ওদের মত অনেকেই অন্যায় অলসতার তালিকায় রাখে।... আর সন্তান বা তাদের মত কেউ এ আচরণ লাগাতার চালালে মনে হতে থাকে, 'কেউ নেই, কিছু নেই সূর্য নিভে গেছে.... 'এ জাতীয় লাইনগুলো ঘুরতে থাকে মাথায়।
মাঝে মাঝে ঢিল ছোঁড়ার মত মনে হয় সামনের যমুনা নামের পুকুরটায় হ্যান্ডসেটটাকে ছুঁড়ে দেয়, তখনই ভিতরের সন্ন্যাসিনী দু ভাগ হয়ে কানের কাছে ফিস ফিস করে, '....আরে আছে তো হাতের কাছে, মুঠোর মধ্যে, তাই কদর বুঝলে না! '
এত দ্রুত বদলে গেল সবকিছু! আর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে তো সব। ঐ যে এরাজ্য, সে রাজ্য, বিদেশের সব খবর হাতের মুঠোয়। সেটায় চোখ ফেলে আর কথা নেই, ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় অবলীলায়। জেনজি যুগের পরিখায় পা রেখে দিয়াসিনী না ঘরকা না ঘাটকা।ওর সমসাময়িক বন্ধুরা বেশ চুলবুলে আধুনিক হয়ে উঠেছে। দিয়াসিনী কেমন অবসন্ন বোধ করে এসবে। অবসরে কবির কথাগুলো দরজায় কড়া নাড়লেও মনে প্রাণে ত্রিশের কোঠায় বসে আছে এখনো।
বাড়ির বয়সী যারা, তাদের একটু আধটু রোগব্যাধি, ওষুধ বিষুধের ফিরিস্তি না দিলে যেন মানায় না! ঘরের অন্য সদস্যরাও অবাক হয়। দিয়াসিনীর কেমন হারিয়ে ফেলা বোধ হয়। কি হারিয়েছে!! সময় আর পিছনের মানুষ। বুকে জমে ক্লান্ত শ্বাস সকালটা বেজায় ঢিলে আর অকর্মণ্য করে দিচ্ছে আজকাল। বয়সী শরীরে চুলের পাগলাটে ফির ফিরে ভাবখানা আয়নায় দেখতে খারাপ লাগে। মনে মনে বলেও ফেলে, যে যেমন, তাকে তেমনই রেখ ঈশ্বর! ঐ মাঝে মাঝে ডেকে ফেলা আর কি!
তার স্বপ্নের বিরাট উঠোনটা সে নিয়ত দেখে। আগেও দেখত, এখন বেশি দেখে বৈকি! ওটা বাঁচার রসদ ও খানিক। শিশুকাল তো নাছোড়বান্দা বড় সম্পদ। ওটাই কৌটোয় ভ'রে এপাশ ওপাশ করে। মুখ ফোটে না। দাঁত ও না। বুকের মধ্যেকার শব্দগুলো হই হই করে লেখার কলমে। এরা, তারা, ওরা সকলেই এক একটা গাছ এখন।
আসলে সবুজ রঙের সঙ্গে ভারি দোস্তি দিয়াসিনীর। এ 'মূক পৃথ্বী' ওর বন্ধু, একা মনে হওয়ার কোন কারণই নেই। এখনতো নানারকম আত্মীয় আগমন উঠে গেছে। সাকুল্যে দু'একজন বন্ধু আসে। কখনো রাস্তাই বন্ধু, কখনো চুপচাপ হেঁটে যেতে যেতে মনস্ক আড্ডাধরদের দেখে আড়চোখে।যাদের হাতে হ্যান্ডসেট অথচ আড্ডা, ধূমপান সবই চলছে, তারা কেউ কেউ অল্পবয়সী ছেলে, দু একটি মেয়েও আছে বটে, ওস্তাদের মত নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। মনে মনে সে আওড়ায়, ... এ জন্মে দিয়াসিনী, তুমি কিছুই পারলে না! এই ভাষাই যখন ঘরের লোকেদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে, তখন উপেক্ষা করে দিয়াসিনী।... ও কি কেন! কি ভাবছে, কি করছে... ও বলতে যাবে কেন? আর নেগেটিভ পাবলিকদের কিছুই জানাবেনা, কোন প্ল্যানও না।
কোভিদ কালে মাঝারি একখানা ঠেলা গাড়িতে কত রকম ফল নিয়ে একটা ছেলে হেঁকে যেত, দিয়াসিনী দের গলিতে প্রতিদিনই আসত, সেই ২০২০-২১ শে, রোজ মাছ অলা, দইঅলা কেউ বাদ যায়নি। মোটামুটি জমজমাট অথচ সাবধানের মার নেই গোছের সময়টা কিভাবে যেন চলে গেল! ওরা কেউ আসেনা আর। দিয়াসিনীর মাথার পোকাগুলো সে সময় থেকেই নড়তে শুরু করেছে। মুখে পট্টি আটকে এত যে নির্জন হয়ে পড়েছে সেটা এখনো বহন করে। মনে মনে কথা বলে।
ভূটানি বাচ্চা বুদ্ধকে বারান্দায় আলোয় বসিয়ে দেয় আদর করে, ও হাতে ঠন ঠন আওয়াজ তোলে সূর্যঘড়ির প্রভাবে। ঐ ছোট্ট বুদ্ধই কখন যেন কোলের ছেলেটি হয়ে যায় আর ক্রমশ যত দিন বাড়ছে, বেলা কমছে তার জীবনের, সে কি বোঝে? বোধহয় বুঝতে পারে। একখানা ঘরে নিজে বন্দী হলে কি হয়, সব কাজে নীচে নামছে, উপরে উঠছে আবার সবুজের সংসারে। সবুজ আলো উপচে পড়ে তার সকাল থেকে রাত। আহা! লতানে'ভেনেস্তারা' এবার গেরুয়া ফুলে ভরে দেবেই মনে হয় আর ঘরের নানান কিসিমের গাছ বারান্দা থেকে রাত ভোর মন ভরে রাখে। দিয়াসিনী রাত জেগে বহুক্ষণ কথা বলে ওদের সঙ্গে।
সন্ধেয় বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা বদলে নেবে ভেবেছিল, হঠাৎ ছেলে পিলুর স্বর কানে এল, 'তোমার মুখের রঙটা কেমন সবুজ সবুজ লাগছে' 'চুলের শেডে মনে হচ্ছে তুমি রঙ করিয়েছ 'এইতো গত সপ্তাহে কথা হল ওর সঙ্গে, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল দিয়াসিনী।
-ধ্যাৎ, ঠাট্টা করছিস কেন! তোদের আদর কম পড়েছে? ওদের.. ঐ গাছেদের বেশি কাছে টেনেছি বলে...
চুপচাপ। না, উত্তর দেয়নি পিলু। -আরে, ওরা কি কথা বলে! অসুবিধে বলতে পারে? দেখতো... অপূর্ব ছোট্ট পাতাবাহার খানা... কেমন দুর্বল! পাতা গুটিয়ে আছে, কি হয়েছে কে বলবে!
-তা.. এত দেখলে তোমার শরীর খারাপ হবেনা!! বাবা বলল তুমি রাতেও ওদের পাহারা দাও, কথা বল...
-তো কি হয়েছে? আমি তো গভীর রাতেই ঘুমোই। তোদের যখন নাক ডাকে, আমি ওদের শরীরের ঘ্রাণ নিই।
কয়েক মাস আগের কথাবার্তা এসব। তারপর বৃষ্টি রোদ গরমে বাইরে হাঁটার ফুরসত নেই। ফলে ছাদের পায়চারি প্রায় ১০০ বার। তাতেই যা শান্তি। এ সত্তরের কাছাকাছি দু'হাঁটু অপারেশন করতে হয় কিনা! ভাবতে ভাবতেই শান্ত স্তব্ধতা। সাবধানে চলাফেরা সবই চলছে।
... আয়নায় কাকে দেখছে! সত্যিই তো চুলগুলো পাতলা ফিরফিরে লালচে কালোর জায়গায় লতানে গাছের আঁকশির মতো দুলছে কানের পাশে। চোখের প্রতিটি পাতা সবুজ। মণি দুটোও কি... শরীর জুড়ে সবুজ উঠোনের ঘাসের জামা। ত্বকে কে যেন তুলি বুলিয়েছে।
এভাবে কি করে বাইরে যাবে! এ সমস্যা নিয়ে পারতপক্ষে হৈ হৈ করে উঠতে ইচ্ছে করেনা। কাঠ গোলাপ ফুলের হলদে মুকুট বানিয়ে নেবে সে, বেশ মানাবে।
বাড়ি শুদ্ধু কেউ চিনবে না, সকলে বাড়ির মালকিন কে খুঁজে ফিরবে, সে তো তখন গাছ হয়ে গেছে। হো হো হাসি পেল, পেটের ভিতর গুর গুর করছে।
আসলে এই পরিবর্তনে ওরা ভয় পাবে। অন্য গহের প্রাণি ভর করেছে ভাববে। এমনও হতে পারে যে সব ওর পোষ্য গাছগুলোকে কেটে সাবাড় করে দিল। যেমন রাতের অন্ধকারে ছাদের পাশের ঝাপড়া হয়ে ওঠা কাঁঠাল গাছের পাতারা যেমন ফিসফিস কথা বলে, দিয়াসিনী ঠিক শুনতে পায়। সূর্যও ওঠে ঐ গাছের ফাঁকে, অস্ত গেলে অন্যদিকটা লালচে হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত গোলক নেমেছিল গত সন্ধেয়। দিয়াসিনী যেন ঐ ক্ষুদে মানুষ পোকার দলে ভিড়ে গিয়েছিল।
ওর বর'দিয়া দিয়া' বলে ডাকছিল কি! মনে হয়েছিল, না, তারপর সব চুপ। নীরব। পৃথিবীটায় অপ্রয়োজনীয় বেধড়ক একখানা মাংসপিন্ড এখন চলে ফেরে কথা বলে, দরকার মনে হলে খায়, নয়তো উপবাস। গুচ্ছের ওষুধ নিজেই এনে রাখে। খাওয়ার কথা মনে থাকলেও খায়না। শুধুই গাছেদের জলে নিমতেল মেশায়। সার দেয়... ভার্মি কম্পোজ। জানলার কার্নিশে রাখা গাছগুলোয় অদ্ভুত সবুজ আভা। মানিপ্ল্যানট্ ওর জানলা দিয়ে এসে ঘুমের মধ্যে ওর শরীরে ঢুকে যায়। ওর কেমন তারুণ্যের তৃপ্তি আসে। নির্বাক গাছের মাঝখানে সব ভুলে মস্ত মহীরুহ ভাবতে থাকে নিজেকে। সন্ধে রাতের অন্ধ পাখি একঝাঁক এসে বসে বারান্দার কার্নিশে। দু'একখানা ফিঙে লেজ ঝুলিয়ে সারারাত বসেই থাকে। ওদের বাসা নেই। এই রেলিঙ বারান্দা খুঁজে পেয়েছে ওরা।
মাঝে মাঝে দিয়াসিনীর হ্যান্ডসেটে বৃন্দাবনী সারং বা বেহাগ বাজে। ভোরের শুরু হতেই পাখিগুলো ছটফট ডানা ঝাপটায়, বারান্দায় রাখা জলে ঠোঁট ঘষে। জল খায়, তারপর ওড়ে। দিয়াসিনী পরজন্মে পাখি হবে। কি পাখি তা জানেনা। আপাতত গাছেদের প্রজাতি সে। ওর সবুজ চুলে এখন আর তেল, শ্যাম্পু কিচ্ছু লাগেনা। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে ভোর একটা মানুষ দিনে দিনে গাছ হয়ে গেল, কেউ টের পেলনা।
বাইরের পৃথিবীটা নিজের মত মেতে উঠেছে যে! কে কার খোঁজ রাখে! স্বার্থের অবশ্যম্ভাবী ওড়াউড়ি। বাইরে রাস্তায় বড় সড়কে ঝলমলে আলো, বড় বড় শপিং মল। দেদার লোকজন ঢুকছে বেরুচ্ছে। দুপাশের গাছগুলোকে কারা যেন কেটে শেষ করে দিয়েছে, বদলে আকাশ ঢেকে বড় বড় ফ্ল্যাট। সেখানকার জানলা দরজা ছাদ থেকে পরিমাপ মত সবুজ পাতারা টুকটাক টব থেকে উঁকি দেয়। কারো বারান্দায় সংকীর্ণ পরিসরে গাছেরা দোল খায় আর লম্বা শ্বাস ফেলে। দিয়াসিনী বাইরে বেরিয়ে সে সব বাড়ির দিকে আনমনে তাকিয়ে আটকে যায়। রাতের ভ্রমণ শেষ করে আকুপাঁকু ছোটে নিজের সবুজ ছানা পোনার কাছাকাছি।
আর অদ্ভুত! ও যে চুল থেকে পায়ের নখ ক্রমশ বন্য... অরণ্য জাতি হয়ে যাচ্ছে ওর কাছের মানুষেরাও টের পায় না। ফুরসত নেই কারো। আর অবাক হওয়ার বিষয় হল দিয়াসিনী কে আজ কাল কেউ খুঁজেই পাচ্ছেনা।
ছেলে বর মিলে খবরের কাগজে নিরুদ্দেশের পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ফেলেছে―
'... একজন বৃদ্ধা সত্তরের কাছাকাছি, সম্প্রতি নির্বাক ও মানসিক রোগগ্রস্ত, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেননি। সহানুভূতিসম্পন্ন কারো নজরে এলে নীচের ঠিকানা ও ফোন নম্বরে যোগাযোগ করুন... '
আসলে ওরা কেউ বাড়ির আশপাশ ভাল করে দেখেইনি।দিয়াসিনী বর্তমানে একখানা সবুজ পাতায় ভরা আর বর্ষার জলে টই টম্বুর সাদা হলদে কাঠগোলাপ ফুলে ভরা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটা পাশের বাড়ির খ্যাংরা কাঠি অলীক বাবু কাটবে বলে জোর করেছিল। লোক ডেকে আনার আগেই দিয়াসিনীই প্রতিরোধ করেছিল। নিজের বাড়ির চৌহদ্দির গাছ সে কেন দেবে কাটতে অন্য বিজাতীয় আক্কেলহীন মানুষকে!.... না, বাড়ির কেউ পাশে দাঁড়ায়নি তখন, ওই একাই সবকিছুর বিরোধিতা করে করে একসময় নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই গাছ হয়ে গেছে কবেই! কেউ জানলে তো কাহিনি শেষই হয়ে যেত। এখন খুঁজে মরুকগে... গল্প বাড়ুক। আড়ালে অন্ধকারে এখনো কান পাতলে দিয়াসিনীর হাসির শব্দ ঠিক শোনা যায় খুব জোর বাতাস বয়ে গেলে...
Comments
Post a Comment