তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

পাখিদের ঘর | সিদ্ধার্থ শেখর চক্রবর্তী | গল্প ১২

ঘরের পেছনে ছোটো একফালি জলাভূমির কোণে সরলাকে আবিষ্কার করা গেল। প্রচণ্ড রাগে গজরাচ্ছিল। 

বুড়িটাও হয়েছে তেমন। কি দরকার ছিল এমন করে কথা শোনানোর। বয়স তো আর কম হলনা। এখন আরাম করো, মুড়ি চিড়ে খাও, ঠাকুরের নাম করো, চুপ থাকো। সংসার নিয়ে এত মাথা গলানোর কি আছে! 
‘চল, ঠান্ডা লাগবে। ঘরে চল।’ 
‘না আমি যাবনা। বুড়ি না মরা অবধি আমি ঘরে ঢুকবনা।’ 
‘আঃ, নাটক করিস না। ওঠ।’ 
‘তুই থাক তোর বুড়িকে নিয়ে, আমি বাপের ঘর চলি যাব।’

সরলা ভালোমতই জানে বাপের ঘরে তাই ঠাঁই নেই, তবু সেখানে যাবার ভয় দেখাতে চায়। সে বাপও আর বেঁচে নেই, সে ঘরও নেই। শালা দুলাল পুরান ঘর ভেঙে নতুন চালা তুলেছে, ওখানে সরলা কোনদিন গিয়ে থাকেনি। থাকতে দেবেই বা কেন শুধু শুধু। বাপ ঠাকুরদার আমলের কুটুমগিরি এখন আর আছে নাকি! 

গায়ের জোর খাটিয়ে পাঁজাকোলা করে তুলতে হলো সরলাকে। মুখে যতই কথার বর্ষা নামুক, শরীরটা লিকলিকে। ওজন নেই। শীর্ণ শরীরে পোটিন ভিটামিনের বড়ই অভাব। মায়া ছড়ালো। হাজার হোক একটাই তো বউ। ভালো যে বাসিনা সেটা তো না, শুধু রাগের মাথায় দু এক ঘা বসিয়ে দেই কখনো কখনো, সেটা কি কোনো দোষের? পুরুষমানুষরা বউকে শাসনে রাখবে না! এই তো গেল বেসপতিবার সোনাগঞ্জের হাটে মুরুব্বি সাহেব নিজে মুখে বললেন, বউ হল সম্পত্তি। তাকে ধরে বেঁধে রাখা শিখতে হয়। সব পুরুষ মানুষ পারেনা। কিন্তু যারা পারে, তারাই পোকিত পুরুষ। 

মার দেখে মেয়ে মাঝে মাঝে কান্দে বটে, কিন্তু কতটুকুই বা বয়স বোঝার। একটু বড় হলে নিশ্চয়ই বুঝবে সমাজ বলেও একটা কথা তো আছে, নাকি? সমাজের বাইরে গিয়ে কি আর কিছু করা যায়? বলো দিকি! 

ভেজা কাপড়ের সরলাকে নিয়ে ঘরে ঢোকার সময় চোখে পড়ল বুড়ি আর নাতনি মিলে দাওয়ায় বসে মুড়ি চিবোচ্ছে। সে চিবোক গিয়ে। মুড়ি যথেষ্টই আছে। দামও কম। দিনে যত বেশি মুড়ি খাবে ভাতের ক্ষিদে তত কমবে। বাবা ছোটবেলায় বলতেন, মুড়ি মুড়ি খাই খাই, ভাত যে নাই নাই। এত বছর পরেও, রেশনের ফি চালের পরেও, একই গান চলছে ঘরে। 

‘ মাগীর নকশা দেখে বাঁচিনে। অসভ্যদের মতো নিপেনের পেছন পেছন ঘুরছে আর হিরু বাসায় ফিরলে রঙ্গ বদলে যায়।’
‘এই বুড়ি, যত ইচ্ছে নিপেনদের ঘরে সিরিয়াল দেখতে যাব। তোর তাতে কি?’
‘সংসারে মন নাই। শুধু টিভি আর টিভি।’
‘বেশ করবো। তুই মরিস না কেন। মর। মরে শান্তি দে।’
‘আমি চোখ বুজলে তো নিপেনের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে সুবিধাই হবে। আমি বুঝিনা ভাবচিস।’ 
‘এইই মুক সামলে বলে দিচ্ছি, বুড়ি। একদম বেশি কথা বলবি না। ঘর জ্বালানি বুড়ি।’ 

নিপেনের ঘরে বউ কেন টিভি দেখতে যায় সেটা নিয়ে কোনদিন ভাবা হয়নি। ঘরে যেহেতু এখনো টিভি কেনার সামর্থ্য হয়নি, তাই যাচ্ছে তো যাক। অন্য কোনো উদ্দেশ্য যে থাকতে পারে সেটাই তো বোঝা হয়নি এতদিন। একটু মন মেজাজ ঠিক করাও তো দরকার। বুড়ি তো তার সময়ে টিভি কি জিনিস জানতোনি। তাই বোঝে না। 

‘ওই হিরু, মাগিটাকে টিভি কিনে দিসতো। তখন দেখবনি কিভাবে যায় নিপেনের কাছে।’ 

কেরালা থেকে ফেরার সময় যা টাকা আনা হয়েছিলো সবই তো ঘর সারাই করতে আর ওষুধ পথ্যে শেষ হয়ে গেল। আর পয়সা কই পাওয়া যায়! টিভি কি আর মাগনা আসে? বোঝেনা, কেউ বোঝেনা। সব শুধু দাও আর দাও। যতক্ষন যুগিয়ে যাবে, ততক্ষণই ভালো। অসহ্য লাগে সমাজকে মাঝে মাঝে। পুরুষ মানুষ কি শুধুই ডেরাইভার? 
একমাত্র শ্যামাটা কিচ্ছু চায়না। মানে, চাইতে পারেনা। জন্মবোবা মেয়েটি হাত তুলে শুধু তাই চায় যেটা সামনে পায়। বৃহত্তর পৃথিবীর আশা আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে এখনো ধারণা হয়নি। স্কুল যাওয়া এখনো শুরু করেনি। গ্রামের সরকারি প্রাইমারী স্কুলে এরকম মেয়েদের নেয় কি না সেটাও জানা নেই। 

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ফেলে ফুলে শুধু শ্যামাকে নিয়ে কেরালার ট্রেনে উঠে বসতে। মেয়েকে নিজের মতো করে মানুষ করা যায়। বউয়ের অহেতুক চোখ রাঙানি আর বুড়ির ফোড়ন থাকবেনা সাথে। বাপ মেয়ে নিলে সুন্দর জীবন গড়ে নেবে। আর এদিকপানে আসবে না। 

সরলা নিপেনের ঘরে টিভি দেখতে যাওয়ার সময় মেয়েটাকে নিয়ে যায়না। অন্তত ফেরার পর থেকে তো তাই মনে হচ্ছে। 
‘চুপ কর বুড়ি। তোর ছাওয়ার দম নেই টিভি কেনার। বিয়ে করারও সাহস না থাকলে ভালো হত। বাপটা অন্তত দুবেলা খাবারটাতো দিত।’ 
‘বাপটা তোর মরে বেঁচে গেছে। নেহাত ছাওয়াটা তোর রূপ দেখে মজেছে,  আমি কি বলছিলাম এমন নষ্ট মেয়েছেলেকে ঘরে তুলতে?’
‘আমি নষ্ট মেয়েছেলে হলে আনতে কে বলচিল? বড় ঘরে বিয়ে হতে পারত মোর। সুনীলদাদা তো বলেইছিল। ওদের টিভি চিল, রান্নার গ্যাস চিল, এমনকি ফ্রিজও কিনেচিল। তোর ছাওয়াই তখন পায়ে পায়ে ঘুরছিল বিয়ের লগে। কি কুক্ষণে যে মায়া জন্মালো হাভাতেটার প্রতি। ফেঁসে গেলাম।’ 

শ্যামা এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। খারাপ লাগছে। ডাক্তার বদ্যি তো অনেক দেখানো হল। সবাই বলে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে অপারেশ করাতে হবে। পয়সা কই? মেয়েটাও যেন জানে তার ভাগ্য। কেমন চুপসে মেরে থাকে মরা মাছের মতো। খেতে দিলে খায়, শোয়ার সময় শোয়। কোনো শখ আহ্লাদ নেই। এই বয়সের বাকি বাচ্চাদের দেখে লোভ হয়। শ্যামা কেন বাকি বাচ্চাদের মত হলোনা? 

আশা দিদি বলেছিল, এগুলো কপাল। হয়তো পরে কথা বলতে পারবে। কয়েকটা ইনজেকশনের স্লিপ দিয়ে চলে গেছিল। সরকারি ওষুধ। তাতে কি আর হাতের রেখা পাল্টায়! 

‘হিরু, প্রধান সাহেব তোর নাম নিয়ে গেল কেনো কাল? পাঁচ হাজার করে দেবে? আর কেরালা যেতে হবে না? 

বুড়ি কি আর বোঝে এখন পাঁচ হাজারে কিছুই হয়না। ওষুধই লাগে তিন হাজারের। স্বপনদারা পরশু ফের চলে যাচ্ছে কেরালায়। সাথে চলে যাওয়া যায়। অন্তত সারাদিনের সরলা আর বুড়ির এই কেচাল থেকে তো মুক্তি। কাহাতক আর ভালো লাগে একই পাঁচালী। শুধু এই নেই, ওই নেই, এই দাও, ওই দাও। 

হয়তো নিপেনের ঘরে সরলার যাওয়া বাড়বে, বুড়ির চিৎকার বাড়বে, কথা বলতে না পেরে শ্যামার আকুতিটা বাড়বে। তবে ওখান থেকে বেশ কিছু পয়সা তো পাঠানো যায় এদের সংসারে। পয়সা দিয়ে না হয় শান্তিটা কেনা যাবে আরো ছয় মাস। 

সমস্ত পেল্যান আটকে যায় বছর তিনেকের শ্যামার সামনে। ডাগর চোখে চেয়ে শুধু বাবাকে দেখে। নাকি খোঁজে একটু আশ্বাস? নিরাপত্তা? গন্ডির মধ্যে আটকে যাওয়া দিনের মুক্তিদাতা হিসেবে দেখে? এত বড় দায়িত্ব থেকে পালাতে ইচ্ছে করেনা। তবু পালাতেই হয়। হাতে পয়সা না থাকলে শ্যামার চোখেও ধীরে ধীরে দুর্বল এক হেরো পুরুষের ছাঁচে আটকে যাব একদিন। 

এখানে থেকেও বিকল্প কাজের খোঁজ যে করা হয়নি তাও নয়। ঠিকঠাক কিছু পাওয়া যায়নি। খেয়োখেয়ি বেশি। নেতাদের দাপাদাপি যথেষ্ট। ব্যবসা করতে গেলেও কাটমানি অনেক। তার চাইতে চিন্তাহীন আয়ের জন্যে বিদেশ অনেক ভালো। যা আয় করা হয় সবই প্রায় পাঠিয়ে দিতে হয় এদের সংসারে। শ্যামা হওয়ার পর থেকেই বাইরে বাইরে কেটে গেলো। ছ মাস সাত মাস পর কয়েকদিনের জন্যে এসে শুধু শুধু অশান্তির আঁচে পড়া। 

এবার গেলে আর না আসলেও হয়। বুড়ি বোনের বাড়ি চলে যাবে। সরলা নিপেনকে বাড়িতেই ডেকে নিতে পারবে। কিন্তু শ্যামা? শ্যামাকে কি নিপেন নিজের মেয়ের মত করে বড় করে তুলতে পারবে?তাদের নতুন সন্তান হলে বোবা শ্যামা কি আরো শব্দহীন হয়ে পড়বে না? 

মুড়ি চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলো শ্যামা। মন পড়তে পারে নাকি? তালগোল পাকিয়ে গেলো সমস্ত ভাবনার। এই বিশ্বাসী দৃষ্টি উপেক্ষা করে কোথাও পালিয়ে যাওয়া সম্ভব? 

ধীর পায়ে পাশে বসে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কাউকে না বলে পরশু পলান দিবি আমার সাথে?’ 
মুখ নামিয়ে বাটি থেকে বেশ কিছুটা মুড়ি নিয়ে মুখে পুরে তাকালো শ্যামা। 

তারপর থেকে আমি গোটা দিন, মেয়ের চোখে আমার নিজের প্রশ্ন পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.