আড্ডা নিয়ে যত কথা | শুভময় সরকার | পর্ব ৩ | ফিচার ১
এক আনন্দঘনবর্ষাযাপন এবং 'জলশহর' : এই আড্ডাবেলার গল্পগুলো কোনো ক্রমতালিকা মেনে করছি না। আমার আড্ডাবাহিত জীবনের সেই অর্থে ক্রমানুসারী বর্ণনা নয়, স্মৃতির পাতায় যখন যে পৃষ্ঠা উঠে এসেছে, সেটাই লিখছি খুব নিঁখুত ধারাবাহিকতা না মেনেই। কত স্মৃতিই যে উঠে আসছে। এক বর্ষামুখরিত দিনের কথা খুব মনে পড়ে। সে এক ঘোর শ্রাবণের সময়। শেষ কবে সূর্যের মুখ দেখা গিয়েছিল ভুলে গেছে জলশহরের মানুষ। জলপাইগুড়িকে আমরা সে-সময় 'জলশহর' নামেই ডাকতাম,যদিও এই শহরের নামের আক্ষরিক অর্থে জল নয়, জলপাই যুক্ত। তো সে যাই হোক, সেই ঘন বর্ষার এক দুপুরে আমার কলেজ হস্টেলের উনিশ নম্বর ঘরের দরজায় বেশ জোরেই কড়া নাড়া। সে-সব দিনে আমরা সাধারণত রাতের কড়া নাড়ায় অভ্যস্ত ছিলাম, ছুটির দিনে, বিশেষত সেই ঘনঘোর বর্ষাযাপনের আবগারি আবহাওয়ায় হস্টেলের ফ্লোরগুলো নিস্তব্ধই থাকতো, আর রাত যত বাড়তো জেগে উঠতো হস্টেল। অলিন্দে অলিন্দে তখন নেশাতুর সময়।
কড়া নাড়ায় কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়েই দরজা খুলে যাকে দেখলাম, তিনি এক উস্কোখুস্কো মানুষ, কাঁধে ঝোলা, একমুখ দাড়িগোঁফ, আধভেজা নোংরা জামাকাপড়, আপাদমস্তক অগোছালো। একমুখ হাসি দিয়ে বললেন আমার নাম আনন্দ সরকার, তুমিই তো শুভময়? ভেতরে নিয়ে এলাম। ঝোলা থেকে একটা তেলচিটে গামছা বের করে আধভেজা প্যান্ট আর শার্ট খুলে দরজার হুকে মেলে দিয়ে ঝোলা থেকে লুঙি আর একটা হলদে পাঞ্জাবি বার করে পরে নিলেন। এই সমস্ত কিছুর মাঝে কোনো অনুমতি, দ্বিধা বা সংকোচ কিছুই ছিল না। আমার রুমমেট তখন সম্বিত। কমার্সের ছাত্র। রোববার ছিল সেটা, সম্বিত ওদের চা-বাগানের বাড়িতে গেছে। ওর বিছানায় আধশোয়া হয়ে দিব্য স্বচ্ছন্দভাবে কথা শুরু করে আনন্দদা। আসলে এই আনন্দদা, অর্থাৎ কবি, গদ্যকার আনন্দ সরকারের নাম শুনেছিলাম কবি-বন্ধু গৌতম গুহরায়ের কাছে এবং এক শীতের দুপুরে গিনিগলা রোদে দূর থেকে দেখেছিলাম কলেজের গেটের পাশে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটি ছিল, তার তলে বসে একজন কবিতাপাঠ বা ওই জাতীয় কিছু একটা করছে আর তার চারপাশে কয়েকজন সাহিত্যানুরাগী ছাত্রছাত্রীর একটা বলয়, সঙ্গে গৌতম। সে-সব শীতের দুপুরে কবিদের আঁতেলমার্কা আড্ডার চাইতে ঢের বেশি আকর্ষণ ছিল ইংরেজি বিভাগের বান্ধবীদের সঙ্গ। পরে গৌতমের মুখেই শুনেছিলাম শিলিগুড়ি থেকে কবি আনন্দ সরকার সেদিন এসেছিলেন। কাছে যাইনি বটে তবে 'দ্যোতনা' পত্রিকায় ওনার লেখা পড়ে আগ্রহ জন্মেছিল। জলপাইগুড়ি এ.সি কলেজে পড়তাম বটে তবে শিলিগুড়ির সঙ্গে আমার একদম শৈশবকাল থেকেই নিবিড় যোগাযোগ মাতুলালয় সূত্রে। তো জলপাইগুড়িতে কলেজ হস্টেলে থাকার সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই শিলিগুড়িতে চলে আসতাম মামাবাড়িতে আড্ডার টানে। আমার দুই দাদা সে'সময় আড্ডার মূল আকর্ষণ। শিলিগুড়ির লেখক মহলেও এই আনন্দ সরকারের নাম কানে আসতো। জলপাইগুড়িতেই শুনেছিলাম এই লেখকেরা সব আড্ডা মারে কলেজপাড়ার বইয়ের দোকানগুলোর উল্টোদিকে মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনের ওপর এক অস্থায়ী চায়ের দোকানে এবং ড্রেনের ওপর সেই চায়ের দোকানের নাম দেওয়া হয়েছিল 'ক্যাফে দ্য ড্রন'। বোঝো কাণ্ড…! তো এক বর্ষণসন্ধ্যায় শিলিগুড়ি শহরের সেই বইপাড়ার বইয়ের দোকানে আনন্দ সরকারের খোঁজ করে জানা গেল সেদিন সে আসেনি। আমি নিজের নাম, হস্টেলের রুম নম্বর জানিয়ে পরদিন ফিরে এসেছিলাম জলপাইগুড়িতে প্রতি সপ্তাহের মতো এবং হঠাৎ করেই কবি আনন্দ সরকারের আগমনের কারণ সেটাই।
সে'রাতে আনন্দদা আমার রুমেই থাকে। কবি আনন্দ সরকার থেকে 'আনন্দদা' হতে সময় বেশি লাগেনি। বহুরাত অব্দি আনন্দদা, আমি আর আমার নিবিড় বন্ধু জয় টালমাটাল আড্ডা দিয়েছিলাম হস্টেলের সামনের ব্যালকনিতে। বাইরে তখন বাঁধনহারা বৃষ্টি। সে-সব দিনে জলশহরে বৃষ্টি হতো দু-কূল ছাপিয়ে, যাকে বলে রাতভর বৃষ্টি। সে-রাতেও হয়েছিল আর আমরা তিনজন অদ্ভুত এক ধোঁয়াটে সময় পেরিয়ে বৃষ্টিভেজা ভোরে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। সে-রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মাঝেই কদমতলা বাসস্ট্যান্ডে আনন্দদাকে বাসে উঠিয়ে আমি আর জয় ফিরে এলাম একবুক বিষণ্ণতা নিয়েই। অবিশ্রান্ত বর্ষণে জলশহর ডুবুডুবু…! অদ্ভুত মজার চরিত্রের মানুষ ছিল আনন্দদা। সে-সময় প্রীতীশ নন্দী সম্পাদিত ইলাস্ট্রেটেড উইকলি পত্রিকাটি নিয়ে আমাদের কয়েকজনের বিস্তর ক্রেজ, ছোট থেকেই বাড়িতে দেখেছি এই পত্রিকা নিয়ে আলোচনা। তো সে-সময় ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'বিজন' গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, সম্ভবত অনুবাদ করেছিলেন প্রীতীশ নন্দী স্বয়ং। ‘পরের সপ্তাহে ফেরৎ দেবো’’ বলে সেই যে আনন্দদা সেদিন ইলাস্ট্রেটেড উইকলিটা নিয়ে গেল, পরের সপ্তাহ আর এলো না কিন্তু মজাটা অন্য জায়গায়। বই,পত্রিকা ঝেপে দেওয়াকে কোনোকালেই খুব বড় মাপের অপরাধ ভাবিনি, আমরাও ভালোবেসে এদিক-ওদিক থেকে এর-ওর বই ঝেপেছি। গল্পের মজাটা আসলে অন্য জায়গায়। এরপর কেটে গেছে প্রায় একদশক। মাঝে কয়েকবার আনন্দদার সঙ্গে দেখা, আড্ডাও হয়েছে। মনে থাকলেও সেই পরের সপ্তাহে ফেরৎ দেওয়ার প্রসঙ্গ আর তুলিনি। বহুবছর পর দেখা হওয়াতে প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর হঠাৎ আনন্দদাকে সেই ইলাস্ট্রেটেড উইকলির কথাটা জিজ্ঞেস করাতে আকাশ থেকে পড়ে বললো, যতদূর মনে পড়ছে ওটা আমারই পত্রিকা ছিল, তুমি নিয়ে আর ফেরৎ দাওনি। আর শোনো, আমার হাতের ব্যথার জন্য আমি পা-দিয়ে লিখছি, পায়ের আঙুলের ফাঁকে কলম রেখে লিখছি, নতুন উপন্যাস। এরপর আর কথা এগোবার উপায় নেই এবং স্বাভাবিকভাবেই আর এগোয়নি। তারপরও বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে, টুকটাক সুখ-দুঃখের গল্পও হয়েছে। বছর কয়েক আগে খবর পেলাম আনন্দদা কালান্তক রোগে আক্রান্ত, রক্তবমি করছে, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে ভর্তি রয়েছে। দেখা আর হয়নি, তার আগেই চলে গেলো রঙিন চরিত্রের এক মানুষ, কবি আনন্দ সরকার। শুনেছিলাম, শেষ সময়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে যে কয়েকজনের কথা জিজ্ঞেস করেছিল, আমার নামও ছিল। জীবনে যে কত অদ্ভুত, রঙিন সব মানুষ দেখলাম, কত ভাবে যে জীবনকে দেখলাম। বড় ঋণ রয়ে গেল এ জীবনের প্রতি…! এ লেখাতেই ফের স্মরণ করলাম আনন্দদা, তোমাকে।
Comments
Post a Comment