তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

পর্বান্তর | সুদীপ্তা সরকার | গল্প ১৬

রাজনন্দিনী থেকে কবে যে সবাইকার নন্দিনী হয়ে উঠেছিল আজ আর মনে নেই। মায়ের কাছে শুনেছিল প্রথম পুত্রসন্তান হওয়ায় বাবা একেবারেই খুশি হননি। মনে মনে স্বপ্ন দেখেছিলেন ঘরে লক্ষ্মী আসবে, বিশ্বাসও করতেন স্বপ্ন একদিন সত্যি হবেই। তাই দ্বিতীয়বার মা যখন সন্তানসম্ভবা বাবা আগে থেকেই রাজনন্দিনী নাম রেখে বসলেন। মা হেসে বললেন এবারও যদি ইচ্ছেপুরণ না হয় উনি আত্মঘাতী হবেন। তবে এবার আর বাবাকে হতাশ হতে হল না। মেয়েকে কোলে নিয়ে তার মুখে যে স্বর্গীয় হাসি, সে ছবি মা কোনোদিন ভুলতে পারেননি।

রাজনন্দিনী, আমার নন্দিনী,বার বার উচ্চারণ করে বাবা এক মানসিক তৃপ্তি  অনুভব  করতেন। মায়ের মুখে এসব গল্প কতবার যে শুনেছে নন্দিনী। কর্মহীন কোনো অবকাশে এসব কথা কতবার যে ভেবেছে সে। আসলে জীবনটা তার উপন্যাসের মত। প্রতিটি পরতে পরতে সুখ দুঃখ,হাসি কান্নার জমাট বুনোট, যেন সাদা কালো এক নক্সিকাঁথা।

বৌদিমনি উঠে পড়ো, ভর সন্ধ্যেয় খোলা ছাদে বসে থেকো না, ঠান্ডা লেগে যাবে। ঘরে  যাও।

ঘর শব্দটা খট্ করে কানে বাজে,তার কি আদৌ কোনো ঘর আছে? মুখে বলে, 

– এই তো উঠছি মিনতিদি,তুমি যাবার আগে জানালাগুলো সব বন্ধ করে যেও। 

নাহ্ এবার উঠতেই হবে, হিম পড়ছে। পুজোর পর পর এই সময়টা নন্দিনীর বড় প্রিয়। আয়েশি মেজাজে শীত তার আগমনবার্তা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেয়। সুখস্মৃতির মতো ঝরে পড়ে বিন্দু বিন্দু কুয়াশা। কুয়াশার আলতো আদর মেখে মানুষ সাময়িক হাইবারনেশন খুঁজে  নেয়, অলস শীতঘুমের প্রস্তুতি।

ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দেয় নন্দিনী। অর্ক এখন কফির ওমে টেবিল ল্যাম্পের আলোর তলে বিদেশি জার্নালে মগ্ন। অর্ককে পাশ কাটিয়ে ওঘরে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

– আজ ক্লাবে যাবে না? 

– শরীরটা আজ বশে নেই। ওর সংক্ষিপ্ত উত্তরে উদ্বিগ্ন নন্দিনী অর্কর কপালে হাত দেয়, – না তো, কপাল তো ঠান্ডা। অর্ক রেগে যায়,শরীর  খারাপ মানেই কী জ্বর হতে হবে? আশ্চর্য…! 

– না ওয়েদার চেঞ্জের সময় তাই ভাবলাম…! অর্ক কথা না বাড়িয়ে জার্নালে মন দেয়। খানিক দাঁড়িয়ে  নন্দিনী নিজের ঘরে যায়। কিছুদিন হল ওদের ঘর আলাদা হয়ে গেছে।

(২)

– তোকে রোজ আসতে বারণ করেছি না? অর্ক কী ভাবে বলতো? নিজের সংসার সামলাবি না এই বুড়োটার কাছে পড়ে থাকবি…! নন্দিনী কোনো উত্তর না দিয়ে ওষুধগুলো ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে সাজিয়ে রাখে তারপর রান্নাঘরের দিকে যায়,

– গোপালদা বাবা আজ কী খাবেন ঠিক করেছো? ত্রস্ত গোপাল বলে,

– বৌমনি আজকাল দা-ঠাকুর বড় বায়না করেন, এটা খাব না ওটা খাব না, তুমিই সামলাও।

নন্দিনী রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । অপরেশ রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ান,

–এত পরিশ্রম তোর সইবে? বারবার বারণ করি…

এতক্ষণ নন্দিনী চুপ করে সব শুনছিল এবার অভিমানী  গলায় বলে–

– একই কথা বারবার বলে আমাকে কেন কষ্ট দাও বাবা…

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন অপরেশ,

– আর কতদিন তোকে সাফার করাবো কে জানে? যাকগে, যাবার সময় আমার কাছে একটু বসে যাস কথা আছে।

মাথা নাড়ে নন্দিনী।

যাবার সময় মনটা বিষণ্ণ হয়। নন্দিনীকে ডেকে অপরেশ বলেন আমার দিন বোধহয় ফুরিয়ে এল। আমার যা কিছু আছে সবই তোকে সামলে রাখতে হবে। পারবি তো? 

অপ্রস্তুত নন্দিনীর বুকে গিয়ে বাজে কথাটা, কথা বলতে পারে না কোনো, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে রাস্তায়।       

নাহ্ অনেক দেরি হয়ে গেল আজ, ঠিকঠাক অটো না পেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে। দেবদূতের মতো এক অটোড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে বলে–

দিদি যাবেন নাকি? নন্দিনী আশ্বস্ত হয়, একই রাস্তায় প্রতিদিন যেতে যেতে অনেক অটো ড্রাইভারই এখন পরিচিত মুখ। নন্দিনী যখন বাড়িতে পৌঁছল, রাত সাড়ে দশটা। বাড়িটা থম্‌থমে হয়ে আছে। ঘরে ঢুকতেই অর্ক ফেটে পরে–

– ঘড়িতে কটা বাজে খেয়াল আছে? নিজের সংসার উচ্ছন্নে দিয়ে উনি জনসেবা করে বেড়াচ্ছেন। 

নন্দিনীর কানদুটো গরম হয়ে ওঠে, কোনমতে  রাগ চেপে ওয়াশরুমে ঢোকে। বেরিয়ে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খায়। অর্কর ঘরে গিয়ে বলে,

– ডিনার সার্ভ করছি, টেবিলে এসো…          

অর্ক ধড়মর করে চেয়ার ছেড়ে সটান বিছানায়। আমার খিদে নেই, আলো নিভিয়ে এ ঘর থেকে যাও বলে চাদর টেনে শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ধকলে অবসন্ন নন্দিনী বসার ঘরের সোফায় গিয়ে ধপ্ করে বসে। সবকিছু ছাপিয়ে অপরেশের ক্লান্ত অবসন্ন মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে, বড় অসহায় লাগে নিজেকে।

মাত্র বছর পাঁচেক আগের কথা। দীর্ঘ, ঋজু, একহারা অপরেশকে প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে। ব্লাইন্ড ডেট রেস্তোরাঁর সুসজ্জিত টেবিলের একপাশে বসা অপরেশ। নন্দিনীকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন,

– তুমিই তো নন্দিনী? আমি অপরেশ সান্যাল,অর্জুনের  বাবা। নন্দিনী ঝুঁকে প্রণাম করতে যাচ্ছিলো,সস্নেহে হাতদুটো ধরে বললেন – বোসো, ছেলে আমার কিছুতেই তোমার কথাটা বলতে চাইছিলো না। আমিও তেমন, বের না করে ছাড়িনি। জেরা করে তোমার নাম ঠিকানা ঠিক জেনে নিয়েছি।

অর্জুনই টেবিল বুক করে রেখেছিল। অপরেশ অনর্গল নিজের কথা, অর্জুনের  কথা বলে চললেন। অর্জুনের যখন পাঁচ বছর তখন অপরেশের স্ত্রী  বিয়োগ হয়। তিনিই অর্জুনকে মানুষ করেছেন সিঙ্গল ফাদারের মতো। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও অর্জুন  বিদেশের ভালো চাকরির অফার ছেড়ে এখানেই চাকরি নিয়ে বাবার সঙ্গে থেকে যায়। ওদের দু’জনের সংসার, গোপাল নামের একজন পরিচারক অর্জুনকে প্রায় কোলেপিঠে  করে মানুষ করেছে। এখন সংসারেরই একজন হয়ে গেছে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে যা যা থাকার কথা সবই আছে শুধু  দেখেশুনে গুছিয়ে রাখবার একজনের বড় অভাব। নন্দিনী গেলে সে অভাব পূর্ণ  হয়…! এ পর্যন্ত  বলে অপরেশ নন্দিনীর  দিকে তাকিয়ে বলেন,

– আমি তো একাই বকে গেলাম, তোমার কথা তো কিছুই শোনা হল না। 

এতক্ষণ নন্দিনী খুব মনোযোগ দিয়ে অপরেশের কথাগুলো শুনছিল এবার নড়েচড়ে  বসে। ততক্ষণে নন্দিনীর সব জড়তা কেটে গেছে আর একরকম ভালোলাগাও তৈরি  হয়েছে। সাবলীল ভাবে বলে— বাবা মারা যাবার পর মা আর দাদা বৌদির সঙ্গেই থাকে, একটা স্কুলে পড়ায়। অপরেশ তার প্যাশন জানতে চাইলে বলে– গান। অপরেশের খুশির মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল নন্দিনী সেদিন। সেখানেই নানা সাংসারিক পরিকল্পনা শুরু করে দেন। নন্দিনী হেসে বলে,

–আপনি তো ঝড়ের আগে ছুটছেন।

 লজ্জা পান অপরেশ, বলেন- কালই তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করবো।

হঠাৎ দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ পরে, রাত দুটো। উঠে দাঁড়ায় নন্দিনী ,কড়িডোর দিয়ে যেতে যেতে অর্কর ঘরের দিকে একবার তাকায়। একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে যায়,নিজের ঘরে গিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। কাল স্কুল আছে সকাল সকাল উঠতে হবে।

(৩)

প্রাক্তন হেডমিস্ট্রেস মারা যাওয়ায় তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে যায়। অনিমাদি বলেন – নন্দিনী চা খেতে যাবে? প্রতিদিন স্কুল আর বাড়ি করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। চল আজ নিয়ম ভাঙি।

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে স্কুল থেকে  কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে নন্দিনীর। কদিন ধরে অপরেশের শরীরটা একেবারেই ভালো যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হওয়াতে ভেবেছিল আজ একটু বেশি সময় অপরেশের সঙ্গে কাটাতে পারবে। অনিমাদির অনুরোধও ফেলতে পারলো না। নন্দিনীর অস্বস্তিটা অনিমার নজর এড়ালো না।

– তুমি কি কোনো সমস্যায় আছো নন্দিনী?

– না না, ওই আর কী, শরীরটা একটু… ও কিছু না। লজ্জা পায় নন্দিনী।

অনিমাদি হাত বাড়িয়ে নন্দিনীর হাতটা ধরলেন – আমায় বলতে পারো,আমি তো তোমার দিদিরই মতো।

অনেকদিন অনিমাকে চেনে  ,বাকী কলিগদের থেকে অনিমাদি আলাদা –স্বাধীনচেতা,স্পষ্টবাদী। সে-কারণে অনেকে পছন্দ করে না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণেই নন্দিনীকে খুব স্নেহ করেন অনিমাদি। নিজের পরিবারের সমস্যা নন্দিনীর সঙ্গে শেয়ার করেন। নন্দিনীর সমস্যার কথাও তার অজানা নয়। কিছু নন্দিনীর মুখে কিছু কলিগদের কানাঘুষোয় শুনেছেন। তবে বাড়তি কৌতুহল নন্দিনীকে অশ্বস্তিতে ফেলতে পারে ভেবে বেশি প্রশ্ন করেননি। নন্দিনী নিজের মধ্যেকার ঝড় সামলাতে সামলাতে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল,অনিমাদির কথায় কোথাও এক ভরসার ইঙ্গিত ছিল, বলল–

– বাবাকে নিয়ে অর্কর সঙ্গে খুব সমস্যা হচ্ছে…!

বুঝেছি,  প্রাক্তন স্বামীর বাবার প্রতি স্ত্রীর এতটা কনসার্ন থাকা অর্ক সহজভাবে নিতে পারছে না, তাইতো?  

নন্দিনী কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে থাকে তারপর বলে,

– আমি আর পারছি না অনিমাদি, আলাদা হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও দেখছি না।

– বুঝতে পারছি অর্কর কাছ থেকে যে উদারতা তুমি আশা করেছিলে, সেটা পাচ্ছো না  বলে মন ক্রমাগত ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

নন্দিনী বলে – জানো অনিমাদি, যেদিন আ্যাক্সিডেন্টে অর্জুনের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া শরীরটা আমার সামনে আনা হয়েছিল,আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা বুকে পাথর চাপা দিয়ে আমাকে সামলেছেন। আমি একটু ধাতস্ত হতেই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন  হয়ে উঠেছেন। মাথায় হাত রেখে বলেছেন – তুই আমার মেয়ে, তোর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা আমার দায়িত্ব। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বন্ধুর ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছেন। আমার প্রবল আপত্তি ছিল এ বিয়েতে কিন্তু উনি আমার কোনো কথা শোনেননি। তার জেদের কাছে আমাকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। আমিও শর্ত দিয়েছিলাম বাবার কর্তব্য থাকলে মেয়েরও থাকবে। আমি সারা জীবন বাবার দেখাশুনো করবো। সে শর্তে অর্ক সেদিন রাজিও হয়েছিল, আজ অর্কর ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারছি না অনিমাদি।

দু’জন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, 

– আমাদের বিচারবুদ্ধি যখন কাজ করে না তখন সময়ের উপর ছেড়ে দেওয়াই একমাত্র রাস্তা নন্দিনী। 

অপরেশের কাছে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে গেলো। বাড়ি ফিরতে মন চাইছিল না। অপরেশকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। অপরেশের আপত্তিতে বাড়ি ফিরতেই হল।

(৪)

গত দু’দিন জ্বর এতটাই বেশি ছিল যে স্কুল যাওয়া তো দূরের কথা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি নন্দিনী । মিনতিদি এই দু’দিন ওর সঙ্গেই ছিল, বাড়ি যায়নি । গোপালদা এরমধ্যে দু’বার ফোন করেছিল, মিনতিদি নন্দিনীর অসুস্হতার কথা জানিয়েছে তাই হয়তো বাবা গোপালদাকে ফোন করতে বারণ করেছেন ওর শরীরের কথা ভেবে। গতকাল সে কারণেই ও বাড়ি থেকে কোনো ফোন  আসেনি। আজ অনেক ভোরে ঘুম ভাঙে নন্দিনীর। শরীরটা আজ ভালো লাগছে। মিনতিদিকে বলে,

– আজ আমি ভালো আছি, তুমি বাড়ি যাও মিনতিদি…

ওয়াশরুম থেকে এসে অপরেশকে একটা ফোন করে। ফোনটা বেজে যায়, ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। বাবা তো অনেক ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। তবে কি…!  নন্দিনী বার বার রিং করতে থাকে। অনেকক্ষণ পর গোপালদার ভাঙা অস্পষ্ট গলাটা শুনতে পায় নন্দিনী–

– দাঠাকুর আর নেই বৌমনি, সব শেষ হয়ে গেলো…! কথা শেষ করতে পারেনা গোপাল।

নন্দিনী যখন অপরেশের বাড়ি পৌঁছলো তখনও কুয়াশা কাটেনি। লোহার গেটটা খুলে টলমল পায়ে মোরাম বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে নন্দিনী। এ যেন অনন্তের উদ্দেশ্যে  যাত্রা,অপরেশের সযত্নে লালিত ফ্রেমে সাজানো মাধবীলতার ক্যানোপির নীচ দিয়ে কুয়াশা ভেদ করে হেঁটে চলেছে সে – টগর ,বকুলের পাতা থেকে নৈঃশব্দ ভেঙে টুপ-টুপ শব্দে ঝরে পড়ছে প্রকৃতির কান্না। অপরেশকে যে বড় ভালোবাসতো ওরা। ওদের ভালোবাসা পবিত্র,খাঁটি। কিন্তু আজ গেট থেকে দরজা পর্যন্ত যেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? কত সহস্রবার এ পথে হেঁটেছে সে, কখনো তো এমনটা হয়নি। মাটি যেন পা দুটোকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। কোনোমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে অবশেষে ঘরে পৌঁছলো নন্দিনী। পাড়ার দু-একজন মহিলা অপরেশের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে, ওকে দেখে নিজেদের মধ্যে  ফিসফিস করে কিছু বলল তারপর সরে দাঁড়াল। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না নন্দিনী, ধপ করে বসে পড়ল অপরেশের পায়ের কাছে। গোপাল অপরেশের মাথার কাছে বসে, নন্দিনীকে দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠল। 

বেলা বাড়তেই অনাদীকাকু এলেন। প্রিয় বন্ধুর মৃতদেহের পাশে নীরবে কিছুক্ষণ বসলেন, তারপর নন্দিনীর মাথায় হাত রেখে বললেন–

– এবার উঠতে হবে বৌমা,শেষ কাজটুকু তোমাকেই তো করতে হবে।

সারাদিন সম্মোহিতের মত শ্মশানযাত্রা, দাহকাজ ইত্যাদি সেরে নন্দিনী যখন অপরেশের বাড়ি পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা নামছে,পাখিরা সব গান বন্ধ করে বাসায় ফিরে গেছে। শূন্য ঘর সমস্ত পার্থিব উপকরণ সাজিয়ে কঠোর শূন্যতা নিয়ে তাকে আহ্বান জানায়। দুর্বল  শরীর আর সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন নন্দিনী কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায়, খানিক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে পড়ে, বারান্দায় বাবার প্রিয় বসার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়াশার সাদা চাদরে চারদিক ঢাকা। বারান্দার নরম আলোর চারধারে বাষ্পের আবর্ত। উত্তুরে হাওয়ায় হঠাৎ অপরেশের আরামকেদারাটা দুলে ওঠে। কেঁপে ওঠে নন্দিনী। আত্মার নাকি মৃত্যু হয় না,সে প্রিয়জনদের আশেপাশেই থাকে…! অবিশ্বাসী মন বিশ্বাস করতে চায় অপরেশের অস্তিত্ব। হঠাৎই সিঁড়ির কাছে একটা ঝাপসা অবয়ব,

– কে ওখানে? নন্দিনীর গলা শুনে গোপাল ঘুরে তাকায় 

– ওখানে কুঁকড়ে বসে রয়েছো কেন গোপালদা? ঘরে যাও।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে গোপাল,

– দাঠাকুর আমাকে আবার অনাথ করে দিলেন গো বৌমনি। রাস্তা থেকে তুলে এনে ঘর দিয়েছিলেন, উনি তো মানুষ ছিলেন না, দেবতা ছিলেন গো দেবতা…!

জীবনের এই টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়েও গোপালদার যন্ত্রণাটা বড়ো বেশি করে বাজলো নন্দিনীর। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নন্দিনী, কাছে গিয়ে গোপালের মাথায় হাত রাখে। মুখ তুলে অদ্ভুত এক ভরসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় গোপাল…! 

Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.