গোরস্থানে কে | শোভন মণ্ডল | গল্প ১০
চন্দ্রনাথবাবু সপ্তাহে প্রায় তিন-চারদিন এখানে আসেন। জায়গাটা নির্জন। একটু দূরে একটা স্টেশন দেখা যাচ্ছে। তবে ট্রেনের দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সকালের দিকে একটা ট্রেন যায়। বিকেলের আগে আর একটা। সন্ধের পরে ট্রেনও আসে না। লোকজনেরও টিকি দেখা যায় না। শুধু নিথর নীরব হয়ে স্টেশনটা কেমন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
চন্দ্রনাথবাবু আসেন একটু বিকেলের পর। দ্বিতীয় ট্রেনটা ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেলে তবেই তিনি এই ঘাটে এসে বসেন। ঘাট মানে একটা পুকুরের এবড়োখেবড়ো বাঁধান ঘাট। পুকুরের সংস্কার করার কেউ নেই। তাই কচুরিপানাতে একেবারে ভরে গেছে। চন্দ্রনাথবাবু এই পুকুরের ভাঙা শানের ঘাটে বসে সাহিত্যচর্চা করেন। এটা তার গোপন শখ। হাতে গোনা কয়েকজন যারা একেবারে কাছের মানুষ তারাই এই বিশেষ শখটির কথা জানে। নেহাত নিজের ভাললাগা থেকে তার এই চর্চা। নামডাক হোক — সে ইচ্ছা তার কোনও দিনই ছিল না। আজও নেই।
আসলে এই জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছেন তিনি। লোকজন খুব একটা এ দিক মুখো হয় না। যাবেই বা কোথায়? সামনেই রাস্তা শেষ। জঙ্গল শুরু হয়েছে। জঙ্গলের শুরুতেই একটা গোরস্থান। তাও অনেকদিন হল পরিত্যক্ত। কেউ আসে-টাসে না। আর ঠিক একটু আগে আসার রাস্তায় একটা ভাঙা বাড়ি পড়ে আছে। শোনা যায় কোনও এক বড়ো লোকের ইচ্ছে হয়েছিল এখানে বাগান করে ছুটি কাটাতে আসবে। সেই মতো এই বাড়িটা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই বাড়িতে কেউ আর আসেনি। পোড়ো বাড়ি হয়ে পড়ে আছে। চোর-ছ্যাঁচড় এসে দরজা জানালার সবটুকুই খুলে নিয়ে চলে গেছে।
একটা ফুরফুরে হাওয়া বয় এখানে। এটাই সবচেয়ে ভাল লাগে চন্দ্রনাথবাবুর। প্রকৃতির সেই হাওয়া খেতে খেতে চলে তার সাহিত্যচর্চা। একটা ডায়েরির পাতাতে পেন দিয়ে হাত খুলে লিখতে থাকেন কত কিছু। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও ধরেন।
আজ চন্দ্রনাথবাবু একটু দেরি করে এসেছেন। আসলে একটা দরকারি কাজ সেরে আসতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। এমনিতে পিছুটান বলে তার কিছু নেই। বিয়ে-থা করেননি। কোনো কূলে কেউ আছে বলে কেউ শোনেনি। একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ান। তাও সকালের দিকে। তারপর সারাদিন তার অগাধ সময়। এতদিন শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই জায়গাটা আবিষ্কার করার পরই যেন তার এই সাহিত্যচর্চার ইচ্ছেটা জেগে উঠেছে। স্থান-মাহাত্ম বলাই যায়! সময়ও কাটে বেশ সুন্দর। এখন মনটাও কেমন ফুরফুরে হয়ে যায়।
বিকেল এখন একটু গড়িয়ে গেছে। আলো আছে তবে অন্য দিনের মতো নয়। শানের ঘাটে বসে দু'লাইন লিখলেন। এরপর মনে হল অন্ধকারটা আস্তে আস্তে নামছে। লিখতে গেলে চোখে চাপ পড়ছে। বয়স তো আর কম হয়নি। নয়-নয় করে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই প্রায়। ডায়েরিটা বন্ধ করে ঝোলার মধ্যে ঢোকালেন। একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছেন কয়েকদিন। রোজ একটু একটু করে লেখেন। আজ আর লেখা এগলো না। একটা সিগারেট ধরিয়ে পোড়ো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। তার উপন্যাসে এইরকম একটা পোড়োবাড়ির কথা তিনি লিখছেন। মনে মনে বেশ কয়েকটা প্লট চিন্তা করলেন। আজ না হলেও কাল একটু বেশি লিখতে হবে।
পোড়োবাড়ি থেকে দু'টো কুকুর বেরিয়ে চন্দ্রনাথবাবুর দিকেই আসছিল। তারপর চন্দ্রনাথবাবুকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে উলটো দিকে চলে গেল। হাওয়াটা আজ অন্য দিনের থেকে বেশি। পানাপুকুরের কচুরিপানাগুলো জলের ওপর নড়াচড়া করছে। একটা পানকৌড়িও ঝুপ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাছ-টাছ ধরতে পারল কিনা কে জানে! এই পুকুরে অবশ্য মাছ আছে। চন্দ্রনাথবাবু বেশ কয়েকবার ঘাই মারতে দেখেছেন। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তিনি।
অন্ধকারটা আর একটু নামল। তবে একেবারে আঁধার বলতে যা বোঝায় তা নয় । আলোর শেষ আভাটা এখনো আছে। অন্যদিন হলে এতক্ষণ থাকতেন না চন্দ্রনাথবাবু। কিন্তু আজ দেরি করে এসেছেন বলে বাড়িমুখো হতে যেন মন চাইছে না। আর একটু থাকতে ইচ্ছে করছে । পোড়োবাড়ি থেকে কে যেন বেরিয়ে উলটো দিকের রাস্তায় হনহন করে হেঁটে গেল। গায়ে একটা চাদর। চন্দ্রনাথবাবু বেশ অবাক হলেন। ওই লোকটা এতক্ষণ ওই বাড়িতে ছিল তিনি বুঝতেই পারেননি। চোর-টোর হবে হয় তো। শুধু পিছনটা দেখা গেল তার। মুখ দেখার কোনও উপায়ই ছিল না। লোকটা মিনিটের মধ্যে চোখের আড়ালে চলে গেল।
চন্দ্রনাথবাবু কখনো সন্ধের পরে এখানে থাকেননি। হঠাৎ মনে হল আর বোধহয় থাকা ঠিক হবে না। এমনিতে সাহসী মানুষ তিনি। এক সময় ভাল শরীর চর্চা করতেন। যোগ ব্যায়ামে বেশ কয়েকটা মেডেলও আছে । কলেজ লাইফে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে শ্মশানে রাতও কাটিয়েছেন। কিন্তু এই বয়সে সাহসটা একটু পড়তির দিকে। এই নির্জন জায়গায় সন্ধের পরে চোর-ডাকাতদের আনাগোনা বাড়তে পারে। বিশেষ করে ওই অচেনা লোকটাকে দেখার পর এ ব্যাপারে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে। ফালতু ঝামেলায় পড়ার থেকে চলে যাওয়াই ভাল। উঠে দাঁড়িয়ে একটু আড়মোড়া ভেঙে পিছন দিকে ঘুরে তাকাতেই চমকে গেলেন। এতক্ষণ গোরস্থানের দিকে তাকাননি। তাকানর কিছু ছিল না অবশ্য। একটা পুরনো গোরস্থান। আগে নাকি এখানে সাহেবদের কবর দেওয়া হত। সাহেবরা চলে যাবার পরে আর এটি ব্যাবহার করা হয় না। কাক-পক্ষীও আসে না।
কিন্তু চন্দ্রনাথবাবু স্পষ্টই দেখলেন গোরস্থানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। এত দূর থেকে দেখলেও পরিষ্কার মনে হচ্ছে লোকটা বিদেশি। ধবধবে ফরসা। যাকে বলে সাহেব। লোকটার হাতে একটা বড়ো-সড়ো ট্রলি ব্যাগ। হাতে আর একটা কিছু আছে। শাবল বলে মনে হল। চন্দ্রনাথবাবুর কেমন যেন সন্দেহ হল। এই রকম একটা নির্জন গোরস্থানে লোকটা করছে কী? প্রথমে ভাবলেন একবার ডাকবেন। কিন্তু পরক্ষণেই মত পাল্টালেন। ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দু'পা এগোলেন। লোকটা বোধহয় তার উপস্থিতি খেয়াল করেনি। তাই এদিকে তাকাচ্ছেই না। চন্দ্রনাথবাবু আরও কয়েক পা এগোলেন। লোকটা এবার ট্রলিটা এক পাশে রেখে শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়তে শুরু করল । দেখে মনে হল এই কাজ এর আগে কখনো করেনি সে। বেশ হাঁপাচ্ছিল। সন্ধে প্রায় নেমে আসছে। দু'দিন আগে পূর্নিমার গেছে বলে চারিপাশটা এখনো ঘুটঘুটে হয়নি। চন্দ্রনাথবাবুর কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল লোকটা বোধহয় চোর-টোর হবে। অনেকে লাশ-টাশ চুরি করে। কী সব কারণে যেন মোটা দামে বিক্রিও হয়। এরকমই কিছু হতে পারে। তাহলে তার কাছে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে।
কিন্তু একটু ভয়-ভয় পেলেও চন্দ্রনাথবাবু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, লোকটার কাছে যাবেন। সে কি করছে জানতে চাইবেন।
একটু এগিয়ে যেতেই পায়ের শব্দে লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। অন্ধকারে সেভাবে কিছু বোঝা না গেলেও লোকটা সাহেব বলে বোধহয় তাকে দেখা যাচ্ছিল। চন্দ্রনাথবাবু ব্যাগে একটা টর্চ রাখেন সব সময়। সেটাকে ব্যাগ থেকে বের করে সোজা আলোটা মারলেন সাহেবের গায়ে। চিৎকার করে বললেন, ''কে আপনি? এখানে কী করছেন?'' তারপর ভাবলেন — সাহেব মানুষ বাংলা বুঝবে তো?
আর একবার বললেন, ''হু আর ইউ?''
কিন্তু লোকটা একটু সরে গিয়ে ঝরঝরে বাংলায় বলল, '' আমি একটা বিপদে পড়ে গেছি। ''
কথাটা শুনে চন্দ্রনাথবাবুর ভয়-ভয় ভাবটা কেটে গেল।
লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কেমন যেন সাদা ফ্যাকাসে মুখ। চোখ দু'টো কেমন অসহায় ভাব। চন্দ্রনাথবাবু জানতে চাইলেন, '' কী সমস্যা? আপনি একা একা এখানে কী করছেন? ''
লোকটা ট্রলিটাকে একটা পাশে সরিয়ে ঘাম মুছল। দরদর করে ঘামছে।
চন্দ্রনাথবাবুর দৃষ্টি পড়ল ট্রলিটার দিকে বেশ ভারি বোঝা যাচ্ছে। তবে টর্চের আলোয় মনে হল ট্রলিটার গায়ে লাল-লাল ছোপ। কিসের দাগ? রক্তের নাকি?
এটা ভাবতেই তার শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল যেন।
দু'পা পিছিয়ে এসে খেঁকিয়ে উঠলেন প্রায়।
''এই ব্যাগে কী আছে?''
লোকটা কোনও উত্তর দিল না। একেবারে যেন নির্বিকার।
চন্দ্রনাথবাবু একটা আশংকা করলেন। মনে হল ওই ট্রলির মধ্যে থেকে ভয়ংকর কোনও জিনিস বেরবেই।
লোকটাকে আবার বললেন। এবার বেশ রাগত ভাবে।
লোকটা এবার কাঁচুমাচু করে বলল, ''সাহায্য করবেন কিনা বলুন?''
চন্দ্রনাথবাবু এবারে ঘাবড়ে গিয়ে বরং দু'পা পিছিয়ে এলেন।
তোতলাতে-তোতলাতে বললেন, ''কী সাহায্য!''
আর কোনও উত্তর দিল না সে। ট্রলিটাকে সোজা করে রেখে সেটা খুলতে শুরু করল।
তারপর খুলতেই যেটা দেখা গেল তাতে চন্দ্রনাথবাবুর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
একটা লাশকে কেটে ট্রলির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা আছে।
চন্দ্রনাথবাবুর হাত কাঁপছে। টর্চের আলো স্থির রাখতে পারছেন না।
''কার লাশ এটা?"
অবাক হওয়ার বোধহয় বাকি ছিল।
সাহেব বলল, '' এটা আমার লাশ। ''
''মানে? কী উলটোপালটা বলছেন? ''
সাহেব এবার সুড়ুৎ করে একটা সমাধি- বেদিতে বসল। তারপর বলল, '' স্টেশনের ওই দিকটাতে আমার বাড়ি। একা থাকি। গতকাল রাতে কারা সব এসে আমাকে খুন করে পালায়। ডাকাত-টাকাত হবে বোধহয়। লাশটা পড়ে ছিল বাড়িতে। কেউ জানতে পারেনি। তিন কূলে তো কেউ নেই আমার! তাই নিজেই নিজের লাশটা বয়ে নিয়ে এলাম। কবরটা দিতে পারলে শান্তি পাই। ''
চন্দ্রনাথবাবু আবারও তোতলাতে লাগলেন।
''মানে, আপনি মানুষ নন? ভূ...''
এই পর্যন্তই উচ্চারণ করতে পারলেন।
সাহেব অনুনয়ের সুরে বলল, '' আমি আর বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। অনুগ্রহ করে যদি আমার লাশটা কবর দিয়ে দেন, চির ঋণী থাকব।''
সাহেব ভূতের মুখে এরকম শুদ্ধ বাংলা শুনে একটু গলেই গেলেন চন্দ্রনাথবাবু। লাশের কাটা মুখটা ভাল করে দেখলেন। লোকটার মুখের সাথে মিল আছে বটে! মিথ্যে বলছে বলে মনে হল না।
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা আনন্দের শ্বাস নিয়ে হাওয়ায় যেন কেমন মিলিয়ে গেল সাহেব।
চন্দ্রনাথবাবু কথার খেলাপ করেননি। বেচারি সাহেব ভূতের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য সারারাত তাকে গোরস্থানেই মাটি খুঁড়তেই কেটে গেল।
Comments
Post a Comment