পরজীবী | স্বর্ণাভ বন্দ্যোপাধ্যায় | গল্প ৯
অনেকদিন পর বেশ ভালো ঘুম হয়েছে আমার। ঘুম থেকে উঠে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে বলে সকালের মিষ্টি রোদে শরীরটা তাতিয়ে নেওয়ার জন্য সামনের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। এত সক্কাল বলেই হয়তো কোনো গাড়িঘোড়া রাস্তায় বেরোয়নি। বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল সামনের রাস্তার উপর একজন লোক মাটির উপর উল্টো হয়ে শুয়ে রয়েছে।
নেশাটেশা করে শুয়ে আছে মনে হয়। এই ভেবে লোকটাকে এড়িয়ে গিয়ে সামনের বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চতুর্দিকে আলো ঝলমল করছে। আকাশে দুধ সাদা মেঘের ঘনঘটা চারপাশের প্রকৃতিটাকে বড্ড মনোরম করে তুলেছে। গাছের পাতাগুলো তিরতির করে নড়ছে। মসৃণ রাস্তার উপর কোনো গাছের পাতাটুকুও পড়ে নেই, সব মিলিয়ে বড্ড মায়াবী পরিবেশ।
হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই পা টা থেমে গেল পিছন থেকে উঠে আসা একটা শব্দে। কেউ যেন হাঁক দিয়ে আমায় ডাকল না?
চমকে ফিরে তাকালাম। সেই রাস্তার উপর শুয়ে থাকা নেশাখোর লোকটা মাটির উপর উঠে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি সোজা আমার দিকে। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, চুল উস্কোখুস্কো, চোখ দুখানি রক্তাভ। দেখে মনে হচ্ছে নেশা এখনও কাটেনি। বেশ রোগা, লম্বা দেহ। কিরকম যেন পাগলাটে চেহারা। কিন্তু ওর দৃষ্টি দেখে আমার কেমন যেন মায়া হলো। খিদে পেয়েছে হয়তো। এগিয়ে গেলাম লোকটার দিকে।
"আপনি ডাকলেন আমায়?"
লোকটা কেমন অদ্ভুতদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। কোনো উত্তর দিচ্ছে না। বোবা তো নয়, কারণ একটু আগেই আমি স্পষ্ট আমার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। এই লোকটাই ডেকেছে তো? মনে হলো লোকটা আমাকে চেনার চেষ্টা করছে। আমিও সোজাসুজি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, "কিছু বলবেন?"
"বলবো... মানে..." লোকটার মুখে কথা ফুটেছে। একটু ইতস্তত করছে বলে মনে হলো।
"বলুন না?" আমি আগ্রহী হয়ে বললাম, "খিদে পেয়েছে? কিছু খাবেন?"
প্রশ্নটা যেই করলাম, অমনি চমকে উঠে লোকটা আমার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো। প্রায় কয়েক মুহূর্ত লোকটার চোখে কোনো পলক পড়ল না। তারপর ধীরে ধীরে খুব অদ্ভুতভাবে মাথাটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে থেমে থেমে উত্তর দিল, "হ্যাঁ, পেয়েছে তো।"
কথাটা এমন ভাবে বললো যে এই দিনের ফটফটে রোদের মধ্যেও আমার গা টা কিরকম ছমছম করে উঠল। ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই কারণ ভূতপ্রেত দিনের বেলায় বেরোয়না বলেই শুনেছি। কিন্তু এই দিনের বেলায় মিষ্টি রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার অনুভব হলো চতুর্দিকে এই সুন্দর মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশের মধ্যেই যেন জীবিত মানুষের বড্ড অভাব। কথাটা মনে হতেই চমকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম আমি যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আমি আর ওই নেশাখোর পাগলাটে মানুষটা ছাড়া আর কোনো প্রাণী উপস্থিত নেই।
একি আজব কান্ড। আমি হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক তাকানোর সাথে সাথেই মনে হলো কিছু একটা যেন স্বাভাবিক নয়। মনে পড়ল কাল রাতে যখন ঘুমাতে গেছিলাম তখন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। আষাঢ় মাসের রাত যখন, বৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তো রাস্তায় কোনো জলকাদার চিহ্নমাত্রও দেখতে পাচ্ছি না। রাতের জল এত তাড়াতাড়ি শুকানোর তো কথা নয়। আর আবহাওয়াটাও হঠাৎ এতো ঠান্ডা হয়ে গেল কেন? বৃষ্টির জন্য কি? বুঝতে পারছি না। শুধু মনে পড়ছে কিছুদিন আগেও ঠিক এইরকম অপার্থিব পাণ্ডববর্জিত পৃথিবী আমি প্রত্যক্ষ করেছি। কবে বলুন তো? মনে করে নিই। দাঁড়ান, দাঁড়ান, মনে পড়ছে মানসিক হাসপাতালের সেই রুগীটার মুখটা। কালই ভর্তি হয়েছিল। অন্য কোনো পাগলামি না থাকলেও একটা লক্ষণ ছিল, সেটা হচ্ছে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। আমি ডাক্তার হিসেবে বেশ কয়েক বছর এই হাসপাতালের সাথে যুক্ত। দীর্ঘকাল ধরে এখানে মানসিক রুগীদের কখনোই সঠিক ভাবে চিকিৎসা হয়নি। এই হাসপাতালের অধ্যক্ষ স্বয়ং নিজেই দুর্নীতির সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত। ভালো ওষুধের পরিবর্তে ভেজাল ওষুধ দিয়েই আজকাল রুগীদের চিকিৎসা করাটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে বেশ কিছু পেশেন্ট মারাও যায়। আমি কখনও এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি, কারণ আমি এই হাসপাতালের একজন সামান্য চিকিৎসক। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিয়ে মাথা ঘামানো আমাকে সাজে না। মানসিক রুগীদের মৃত্যু নিয়ে তো আর তদন্ত হবে না, কোনো অভিযোগও উঠবে না। কিন্তু এই ক বছরে কোনোদিন কোনো রুগীকে দেখে আমার এরকম অস্বস্তি হয়নি, যা কাল হয়েছিল। রুগীটা ভীষণই অদ্ভুত। চোখ মুখ দেখে কেউ বলবেই না যে মানসিকভাবে অসুস্থ। অথচ ওর মুখ চোখের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক পাশবিকতা ফুটে বেরোচ্ছিল। সেই সাথে বারবার একটাই কথা উচ্চারণ করছিল রোবটের মতন, "খিদে পেয়েছে।" তাকে হাসপাতালের তরফ থেকে অনেকরকম খাবার দেওয়া হয়েছিল। অথচ সবকিছু খাওয়ার পরেও সেই মুখ থেকে একটাই কথা বেরিয়ে এসেছিল রুগীটার।
"খিদে পেয়েছে।"
কীকরে এই খিদেকে স্তব্ধ করা যায়, সারারাত ভেবেও কূলকিনারা করতে পারিনি আমি। আমার অধীনেই ভর্তি হয়েছে যখন তাকে সুস্থ করার দায়িত্বও তো আমারই। লোকটার চেহারা বেশ লম্বা, শীর্ণকায়, মুখে হালকা দাড়িগোঁফের আভাস, আর চোখদুটো অসম্ভব রকম উজ্জ্বল। বেশিক্ষণ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না, সেটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম। লোকটার মাথায় চুল বেশ ভালই আছে, গায়ের রংও ফর্সা। জামাকাপড় দেখেও বোঝা যাচ্ছিল অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে। বয়স পঁয়ত্রিশ। বাড়ির লোকেদের বক্তব্য এই লোকটি ঠিকঠাকই ছিল। কোনরকম কোনো অস্বাভাবিকতা কখনও এর মধ্যে প্রকাশ পায়নি। ছাত্রাবস্থা সমাপ্ত হওয়ার পর পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পাশ করে রাজ্য সরকারি দপ্তরে অফিসারের পদে আসীন ছিল। বিয়েও করেছিল যদিও সন্তানাদি হয়নি। কিন্তু হঠাৎই সেদিন অনেক রাতে স্ত্রীর জন্য উপহার নিয়ে বাড়ি ফেরার পর, রাতে ঘুমিয়ে সকালে ওঠার পর থেকেই ওর হাবভাবে আচমকা পরিবর্তন এসেছে।
সেদিন ছিল রবিবার। আগের দিন শনিবার অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেছিল অমরেশ, মানে আমার পেশেন্ট। বাড়ির লোকেদের বক্তব্যনুযায়ী সেদিন রাতে বাড়ি এসে অমরেশ খায়ওনি। খালি পেটে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ার পর ভোরবেলা উঠে ওর মুখে "খিদে পেয়েছে" শুনে কারুর মনেই কোনো সন্দেহ দানা বাঁধেনি, কারণ খিদে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সেই শুরু। মহারাজের খিদে কিছুতেই মেটানো যাচ্ছে না। ব্রেকফাস্ট করার পরও বলছে খিদে পেয়েছে। ওনার স্ত্রী ব্রেকফাস্টের পর সকালেই ওনার জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থাও করে ফেলেছিলেন, তাতেও অমরেশের খিদে মেটানো যায়নি। খাবার না পেয়ে রাগে চেঁচামেচি করতে শুরু করেছিল অমরেশ, যা দেখে মা, বাবা, ওনার স্ত্রী প্রথমে ওকে সাধারণ মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল।
ডাক্তার সব পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেছিল, শরীরের সমস্ত অঙ্গ ঠিকঠাকভাবে কাজ করছে, কোথাও বিন্দুমাত্র কোনো গোলমাল নেই। সেই হিসেবে এই অস্বাভাবিক ক্ষুধাবৃদ্ধিকে "পলিফাজিয়া" নামকরণ করে সেই মতন আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য উপদেশাবলী লিখে দিয়েছিল ডাক্তার। সেই উপদেশাবলী মেনে চললেও অমরেশের শরীরে বিন্দুমাত্র কোনো পরিবর্তন আসেনি। পরীক্ষার ফলও স্বাভাবিক এসেছিল। এদিকে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটায় শেষাবধি অমরেশের পরিবার মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়, এবং তার উপদেশেই ওকে কাল এই মানসিক হাসপাতালে আমার অধীনে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু এতকিছু কি পেশেন্টের বাড়ির লোক আমাকে বলেছিল? মনে তো হচ্ছে না, আমার মনে হচ্ছে এগুলো সব আমার সাথেই ঘটেছে। অদ্ভুত ব্যাপার না? কারণ অল্পস্বল্প মনে পড়ছে, আরও কিছুদিন আগে, যেদিন অমরেশ সরকারি অফিসে বসে জমির চরিত্রবদলের জন্য একজন দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিল, সেই রাত থেকেই কি কি ঘটেছিল সেসব আমি জানি।
সেই পিতা ভেবেছিল, জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবে, কিন্তু ঘুষ দিয়ে জমির চরিত্র বদল না করালে তা বিক্রি হচ্ছিল না, তাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে অনেক কষ্টে তিলতিল করে সঞ্চয় করা মেয়ের বিয়ের গয়না বন্ধক দিয়ে মহাজনের কাছ থেকে এক লহমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার করতে গিয়েছিল সেই রাতেই অমরেশের হাতে তুলে দেবে বলে। কম্পিত হস্তে অনেক রাতে অমরেশের সাথে দেখা করে সেই সারাজীবনের সঞ্চিত ধন তুলে দেওয়ার সময় মনের অজান্তেই হয়তো চরম অভিশাপ দিয়ে ফেলেছিল ওকে। সেই সাথে ঈশ্বরকেও দোষারোপ করেছিল যে কেন উনি সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করতে আসেন না, কেন এইসব দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেন না। কিন্তু দুর্নীতি তো সমাজের মূলাধার, তাই না বলুন? দুর্নীতি ছাড়া কি আর এই পৃথিবী চলে? অমরেশ কীকরে এর ব্যতিক্রম হবে? কিন্তু সেই টাকা আদানপ্রদানের পর থেকেই অমরেশের জীবনের প্রতিটা ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। তার আগে আমার কোনো স্মৃতি নেই। এই ঘটনাগুলো আমি দেখেছি ঠিকই, কবে দেখেছি কিভাবে দেখেছি তাও আমার দিব্যি মনে আছে, কিন্তু কেন দেখেছি, সেটা কিন্তু আমি জানি না। এরপর মনে পড়ছে, কাল রাতে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল, তখন হাসপাতালে অমরেশকে একটা কড়া ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলাম আমি। গোটা হাসপাতালে নিস্তব্ধতা বিরাজ করার মাঝেই হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে আমার ঘুমটা টুক করে ভেঙে গেছিল।
হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গার কোনো কারণ বুঝতে না পেরে আমি আবার ঘুমের দেশে ভেসে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করছিলাম, ঠিক তখনই আমার কানে একটা বিশ্রী চিৎকার ভেসে এসেছিল কোথাও থেকে। চিৎকারটা কানে আসতেই আমার ঘুমের অবশিষ্টাংশ দফারফা হওয়ার ফলে আমি লাফিয়ে উঠেছিলাম বিছানার উপর। আওয়াজটা শুনে মনে হচ্ছিল এ যেন কারুর মৃত্যু-আর্তনাদ। মাঝরাতে এই হাসপাতালে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন চিৎকার ভেসে আসে। ভয়, আতঙ্ক, কষ্ট মানসিক রোগীদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, যার প্রকোপ বৃদ্ধি যায় প্রায়শই মধ্যরাত্রে। কিন্তু এই চিৎকারটা যেন ঠিক সেইরকম চিৎকার ছিল না, এটা যেন ছিল... এটা যেন ছিল... অনেকটা অন্যরকম।
আমি উঠেছিলাম বিছানা থেকে। এগিয়ে গেছিলাম দরজার দিকে। দরজা খুলতেই কেউ যেন মাথার মধ্যে ফিসফিস করে বলে উঠেছিল, "যেও না। বিপদ।" কিন্তু নাহ, আমি শুনিনি। দরজা খুলে সটান পেশেন্টদের ওয়ার্ডের সামনে চলে আসার সাথে সাথেই আচমকা দেখতে পেয়েছিলাম অমরেশকে। অমরেশ পড়ে ছিল মাটির উপর। মুখটা ঐদিকে ঘোরানো। জামা দেখে চিনতে পেরেছিলাম ওকে। গ্রিলের ওপাশে অমরেশকে পড়ে থাকতে দেখে কিরকম যেন শ্বাসবন্ধ হয়ে এসেছিল আমার। দেখে মনে হচ্ছিল ওর দেহে প্রাণ নেই।
সাথে সাথে ডেকেছিলাম ওয়ার্ডবয়কে। ওয়ার্ডবয় এসে অমরেশকে ঐভাবে পড়ে থাকতে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে হাসপাতালের অধ্যক্ষকে ডেকে এনেছিল। কারণ পেশেন্ট মারা গেলে নিয়মানুযায়ী সেটা ওনার কাছে সর্বপ্রথম রিপোর্ট করা হয়। সেই মত অধ্যক্ষ ডাঃ চিন্ময় নন্দী খবর পেয়ে সাথে সাথে দৌড়ে এসে ওয়ার্ডের সামনে উপস্থিত হতেই আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলাম অমরেশের দিকে, আর সেই সাথে ওয়ার্ডবয়কেও দরজা খুলতে বলেছিলাম। কিন্তু অধ্যক্ষ কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। কাল রাতে অমরেশকে যে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিলাম, তার মধ্যেও কি ভেজাল ছিল? সেই কারণেই কি... অমরেশ এভাবে... কিন্তু চিন্ময়বাবু ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কেন?... দেখে মনে হচ্ছিল... মনে হচ্ছিল... ও যেন ভয় পেয়েছে।
কিন্তু এর পর আমার আর তো কিছু মনে পড়ছে না। এরপর কি হয়েছিল? অধ্যক্ষ আমাকে দেখে কেন ভয় পেয়েছিল? কি হয়েছিল তারপরের পরিণতি? এরপর আমি আজ সকালে উঠে সব এভাবে ভুলে গেলাম কীকরে? আবার এখন ধীরে ধীরে আচমকা সব কেমন করে যেন পরপর স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠছে। কেন হচ্ছে এরকম? এই লোকটাই বা কেন এভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে? কেন আমার মনে হচ্ছে এই পাগলাটে নেশাখোর লোকটার চোখ দুটো যেন বড্ড চেনা চেনা? বড্ড পরিচিত? কেন আশেপাশে কোনো জনপ্রাণী নেই? কেন ? কেন? কেন?
মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাবো। ভয় যেন আমার অন্তরাত্মা গ্রাস করে আমার সর্বাঙ্গ অসাড় করে তুলছে। কিন্তু কিসের ভয়, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। চারদিক দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন এক অন্য পৃথিবীতে চলে এসেছি। এক অন্য ডাইমেনশন। অথচ এই রাস্তা আমার চেনা। এই গাছটা আমার চেনা। ওই তো, ওই হাসপাতালটা রাস্তার এপাশ থেকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, অথচ মনে হচ্ছে এগুলো কোনোটাই আমার চেনা নয়। কোথাও কেউ নেই, কেউ চেনা নেই। এরকম ঠিক হয়েছিল সেই রাতেও, যে রাতে সেই দরিদ্র পিতা অমরেশকে মনে মনে অভিশাপ দিয়েছিল, যে রাতে অমরেশ ঘুষের টাকায় স্ত্রীর জন্য উপহার কিনে এনেছিল, যে রাতে অমরেশ খায়নি, প্রচণ্ড ঘুমের নেশায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিল, সেই রাতেও ঠিক এইভাবেই ভয় পেয়েছিলাম আমি। মনে হয়েছিল এক অচেনা পৃথিবীতে আমি চলে এসেছি। আশেপাশে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই, কোনো পাপ নেই, কোনো দুর্নীতি নেই, কোনো কান্না নেই, কারণ কোনো মানুষ নেই। এই লোকটা দাঁত বার করে হাসছে। দেখে মনে হচ্ছে আমার ভিতরের সবকিছু ও দেখে ফেলেছে, আমার ভয়, আমার আতঙ্ক, আমার বিস্মরণ, এই সবকিছু যেন ও প্রত্যক্ষ করতে পারছে। কিন্তু কে এই লোকটা? দেখে মনে হচ্ছে যেন আমি কোথাও ওকে দেখেছি, লোকটা কি এই ডাইমেনশনেই থাকে? সে ই কি এই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক? লোকটা একটু আগে কি নামে ডাকল যেন আমাকে? সেটা আমার মনে পড়ছে না কেন?
হঠাৎই লোকটা নিচু হয়ে একটা ছোট্ট জিনিস কুড়িয়ে এনে আমার হাতে তুলে দিল। জিনিসটা আর কিছুই না। একটা ছোট্ট আয়না। আয়নায় আমি নিজের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সূর্যের আলো আমার মুখে পড়ে প্রতিফলিত হয়ে যে ছবি এই দর্পণে ফুটিয়ে তুলেছে, সেটা তো আমার মুখের প্রতিচ্ছবি নয়, এটা তো...এটা...তো... ডক্টর চিন্ময় নন্দীর মুখ, যে বছরের পর বছর ভেজাল ওষুধের কারবার করে আমাদের হাসপাতালের বহু পেশেন্টকেই যমের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছিল, যার শেষ শিকার ছিল.....কাল রাত্রে ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে থাকা অমরেশ, কিন্তু আমি? আমি এভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেলাম কীকরে? আমার শরীর ছেড়ে আমি চিন্ময়বাবুর শরীরে ঢুকলাম কীকরে? আমার কি হয়েছে? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নাকি চোখের ভুল? কোনটা?
সাথে সাথে মুখে হাত দিয়ে আমি দাড়িগোঁফের অস্তিত্ব টের পেলাম, যা অধ্যক্ষর মুখে এতদিন শোভা পেতে দেখেছি। তাহলে আমার মুখ সত্যিই বদলে গেছে? কিন্তু এ কীকরে সম্ভব? এই ব্যক্তিটি কে?? এ কি কোনো যাদুকর?? আমাকে সম্মোহন করছে? তাছাড়া কিই বা হতে পারে? আমি নিশ্চয়ই কোনো ঘোরের মধ্যে আছি। এই আবেশ কেটে গেলেই নিশ্চয়ই জেগে উঠবো, নিশ্চয়ই পার্থিব কোলাহল আমায় ঘিরে ধরবে, এই অপজাগতিক পরিবেশ থেকে আমি মুক্তি পাবো।
কিন্তু হঠাৎ আমার শরীরে একটা অস্বাভাবিক ব্যথার উৎপত্তি হলো। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর সব যন্ত্রণা, সব কষ্ট যেন আমার পেটের মধ্যে এসে ঘনীভূত হয়েছে। এ যন্ত্রণা কোনো সাধারণ যন্ত্রণা নয়। যেন মনে হচ্ছে গোটা বিশ্বব্রম্ভাণ্ড আমার পেটের মধ্যে ঢুকে বাসা বাঁধতে চাইছে, যা কিছুতেই আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।
এই খিদে পেলেই আমার আর কিছু মনে থাকে না, অজ্ঞান হয়ে যাই। এই খিদে যে আমায় দিয়ে কি কি করিয়ে নেয়, সেটা সে নিজেও জানে না হয়তো। আমি ছটফটিয়ে উঠলাম। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই পাগলাটে লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। ঝাপসা ভাবে দেখছি চতুর্দিকের পৃথিবী, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে আমার মুখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। আমার পেটে যেন রাক্ষসের অধিষ্ঠান হয়েছে। সে-ই গিলে নিচ্ছে সমগ্র সৃষ্টি, শুষে নিচ্ছে বিশ্বচরাচর।
অচিরেই ধ্যানভঙ্গ হলো আমার। হয়তো বা চেতনা ফিরল। দেখলাম আমি শুয়ে আছি সেই রাস্তার উপরেই। কিন্তু চতুর্দিকে প্রচুর মানুষের ঢল নেমেছে। যারা আছে, তারা প্রত্যেকেই ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেউ কেউ আমাকে চিনতে পেরে ডাকছে, "ডক্টর নন্দী? আপনি এভাবে রাস্তার উপর পড়ে আছেন কেন? কি হয়েছে আপনার?" কেউ কেউ এক হাতে ক্যামেরা আর অন্য হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলছে, "আমি মিডিয়া থেকে এসেছি। আপনার হাসপাতালে কাল রাতে তো একজন পেশেন্ট আর একজন ডক্টর, দুজনেই মারা গেছেন, আমি আপনাকে সেই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। প্লীজ আপনি কো অপারেট করুন।"
আর আমি? আমি মাটির উপর শুয়ে আছি সেই একই ভঙ্গিমায়, ঠিক যেভাবে কাল রাত্রে অমরেশকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম, কিংবা আজ সকালে সেই পাগলটাকে।
বুঝতে পারছি যাকে সকালে রাস্তার উপর শুয়ে থাকতে দেখেছি, সে পাগল নয়, সে অসুস্থ নয়, অমরেশ অফিসে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার সময় সেই পিতা মনে মনে যার কাছে বিচার চেয়েছিল, মানসিক হাসপাতালে একের পর এক পেশেন্ট ভুল ওষুধে প্রাণত্যাগের সময় যাকে মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে একবারের জন্য হলেও স্মরণ করেছিল, সে-ই এই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, ওর হাত থেকে সেই রাতে অমরেশ নিস্তার পায়নি, সেই হাসপাতালের দুর্নীতিগ্রস্ত ডাক্তারও নিস্তার পায়নি, এখন অধ্যক্ষ চিন্ময় নন্দীর পালা। এই সবকিছুর সূত্রপাত হয়তো হয়েছে সেই পিতার ডেকে আনা অভিশাপ থেকে, হয়তো হয়েছে এই সমাজের নিত্যদিন ঘটে চলা অপরাধের চরম সীমায় উত্তীর্ণ হওয়ার মুহূর্ত থেকে, যে এসেছে সমাজের সব অন্যায়কে, পাপকে গিলে নেওয়ার জন্য, শুষে নিতে এসেছে সমস্ত অপরাধীদেরকে।
কিন্তু আমি? আমি কে?
আমি জানি না আমি কে, শুধু এটুকু বুঝেছি আমার মৃত্যু নেই। আমায় চিরটাকাল এভাবেই পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে অন্য মানুষের শরীরের মধ্যে। প্রথমে ছিলাম অমরেশের শরীরে, তারপর ঢুকেছিলাম সেই মানসিক ডাক্তারের দেহে, আর এখন পৌঁছেছি চিন্ময় নন্দীর কায়ার অভ্যন্তরে। আমি কি সেটা আমি জানি না। হতে পারে আমি কোনো ভাইরাস, হতে পারে কোনো ব্যাকটেরিয়া, হতে পারে কোনো অভিশাপ অথবা হতে পারে কোনও শক্তি। আমার কোনো আকার নেই। কোনো প্রকার নেই। আমি কবে জন্ম নিয়েছি আমি জানি না, শুধু যবে থেকে এই পৃথিবীতে পাপের উৎপত্তি হয়েছে, সেই মহালগ্নে হয়তো আমিও জন্মগ্রহণ করেছি পাপের বিনাশ করতে। নিশ্চুপ হয়ে, অতি সন্তর্পনে। আমাকে যখন আমার প্রভু, অর্থাৎ সেই পাগল ভবঘুরে ডাক দেন, অপরাধ যখন তার সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে, তখন আমি প্রভুর সেই আহবানে সাড়া দিই, অপরাধীর শরীরে প্রবেশ করে তাকে দিয়ে বাকি অপরাধীদের নাশ করি। ঠিক একজন কন্ট্রাক্ট কিলারের মতন। আমি যার শরীরে ঢুকি তারই আকার গ্রহণ করি, তারই স্মৃতি নিজের মস্তিষ্কে ধারণ করি, তাকে শেষ করার পর তার স্মৃতি ও শরীর একইসাথে ত্যাগ করি। দুই শরীরের অন্তর্বর্তী সময়ে হয়তো আমি এক অন্য ডাইমেনশনে বসবাস করি, যে মাত্রায় কোনো মানুষ থাকে না, কোনো জীব থাকে না, শুধু আমি থাকি, আর থাকে আমার প্রভু, যিনি আমায় কি নামে ডাকেন তা আমি জানি না, যাকে আমি দেখতে পেলেও চিনতে পারি না। আমি প্রবেশ করলে হোস্টের শরীরে অতিপ্রবল ক্ষুধার উদ্রেক ঘটে সেটা আমি বুঝতে পারি। কারণ হোস্টের শরীরের মধ্যে ঢুকে আমি চাই বিশ্বসংসারের সব অপরাধ গ্রাস করতে, আমি চাই এই পৃথিবীর সকল পাপ নাশ করতে। এত অন্যায়, এত দুর্নীতিতে যে ঢেকে গেছে চতুর্দিক, আমি চাই তাদের ধ্বংস করে নববিশ্বে বাস করতে।
Comments
Post a Comment