তমোহন উত্তরবঙ্গের অন্যতম ভারত সরকারের পি.আর.জি.আই কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বার্ষিক গবেষণামূলক মুদ্রিত পত্রিকা। পাশাপাশি লেখক-পাঠকদের অনুরোধে অনলাইন ডিজিটাল ওয়েবপত্র হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ। সারাবছর জুড়ে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে তমোহনে লিখতে ও পড়তে পারবেন; পাশাপাশি দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে তমোহন ক্রয় করতে পারবেন। আপডেট পেতে আমাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে যুক্ত থাকুন। প্রকাশিত সংখ্যার বিবরণ : ১. (২০২৩-২৪) : তমোহন, ময়নাগুড়ির ইতিহাস, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০২৩, ২. (২০২৪-২৫) : তমোহন, সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৫

ফিরে পাওয়া জীবনে: নতুন এডভেঞ্চারের খোঁজে | বাবলু সাহা | পর্ব ৩


পিটারের মুখ থেকে যা জানলাম, সেটা হচ্ছে যে, আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ আর হাসাহাসির কারণ আমার রোগা হাড় জিরজিরে প্যাংলা চেহারা নিয়ে আমি পূর্ব নেপালের এক অজানা অচেনা পথে একাই ট্রেক করতে যাবো, যেখানে অপ্রচলিত পাহাড়ী পথ ধরে আমি ছাড়া আর কেউ যাওয়ার পাগলামি করেননি; মূলত আমি আমার হিমালয়ের বুকে পূর্ববর্তী যেসব ট্রেক এর কথা বা কাহিনী ওদের কাছে গপ্প  করেছি, সেসবই পিওর গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস এর কুফল। এরপর পিটার যখন তাদের সবিনয়ে আহ্বান জানালো যে, তারাও চলুক সান্দাকফুর প্রচলিত পথ ছেড়ে আমাদের সাথে, সেইমুহূর্তে ঘর নিস্তব্ধ, কারও মুখেই কোনও কথা নেই।

পিটার জানিয়ে দিল, আগামীকাল সকাল ৮টা নাগাদ আমরা এখান থেকে রওনা দেব। আমি যেন তৈরী থাকি। এরপর পিটার মাকে শুভ রাত্রি জানিয়ে বিদায় নিতেই, আমি চলে গেলাম জীবনদার ঘরে। ঘরে ঢুকেই আবার আরেক চমক; সামনের চেয়ারে বসে আছে আমার পূর্ব পরিচিত বন্ধু, সামানদেন গ্রামের একমাত্র হোমস্টের মালিক ছিরিং। ও নিজেও খুবই অবাক হয়ে গেছে আমাকে দেখে, কারণ আমি যে এখানে এসেছি, জীবনদা সেটা ওকে বলেনি। আমাকে দেখেই ও চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার সাথে করমর্দন  ও দুজনে দুজনকে আলিঙ্গন করে আবার এসে চেয়ারে বসলাম। সেখানে তখন কড়ায় মাংস পাকানো পর্ব চলছে, সাথে পাহাড়ী কড়া রামের গ্লাস সাজানো। সারা ঘরে রান্নার খুশবু ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের গল্পগুজব চলতে থাকলো। অবশেষে রান্না শেষ হওয়ার পর, আমরা একত্রে খেয়ে উঠে, যে যার ঘরে শুতে চলে গেলাম। পরদিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে, স্যাক গুছিয়ে পিটারের আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম। খানিকক্ষণ পরেই পিটার এলো, ওর ছোট্ট একটি জরুরী কাজের দারুণ আমাদের বেরোতে ঘণ্টা দুয়েক দেরী হতে পারে, এই বলে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো।

অতএব এই দুঘন্টা সময় আমি এদিক সেদিক ঘুরে, দুতলার বারান্দা থেকে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে সময় কাটাতে লাগলাম। এরমধ্যে আমার পাশের দুই ঘরের সবাই এক এক করে আমার চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো।  আমাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, তাদের মধ্যে একজন বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, "কী দাদা, আপনারা আজই রওনা দিচ্ছেন তো?" আমি কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেলাম। এরমধ্যে দেখি, যারা ভাড়া করা জীপে যাবে  সান্দাকফু, নীচের রাস্তায় তাদের গাড়িতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে সবাই যার যার লাগেজ, খাবারদাবার বাঁধাছাদা করে গাড়ির উপরে রাখছে। হঠাৎ আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়, একজনকে দেখি হাতে এক ক্রেট মুরগীর ডিম নিয়ে দাড়িয়ে আছে, উপরে তুলবে বলে। ওরা চলে গেলে আমি জীবনদাকে বললাম সেকথা। শুনেই জীবনদা বললো, ওই ডিমের ক্রেট যখন গাড়ি থেকে নামাবে, তখন দেখবে সব ডিম একসাথে অমলেট হয়ে গেছে। এতক্ষণে সব ঘর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর, রয়ে গেলাম আমি একাই।

অবশেষে পিটার এলো হন্তদন্ত হয়ে। এসেই আমাকে কাঁধে স্যাক তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসতে বললো, আমি তো রেডিই ছিলাম, জীবনদার সাথে দেখা করে, নীচে নেমে আমরা সুখিয়া পোখরির শেয়ার জিপ ধরে চলে এলাম আমাদের গন্তব্যের মুখে। হায়, তখনও কী জানতাম যে, আরও কত বাধা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে! আমরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে প্রথমেই সুখিয়াপোখরি যাওয়ার শেয়ার মারুতি ভ্যান ধরলাম। যাওয়ার আগে পিটারের প্রস্তাব ছিল যে, আমি যেন প্রতিদিনের গাইড ভাড়া ভারতীয় মুদ্রায় ৫০০টাকা না দিয়ে, একেবারে ৭০০০টাকা ওর হাতে একসাথে দিই, তাহলে ও আমার এইকয়দিনের যাবতীয় দায়িত্ব ও নিয়ে নেবে, অনেকটা প্যাকেজ সিস্টেমের মত আর কি (যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে দলগত ট্রেকিং একেবারেই পছন্দ করিনা কারণ, এতে চলার পথে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয় বলেই আমার ধারণা)। ওর এই প্রস্তাবে আমি তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে যাই। সেইমত ঠিক হলো, সুখিয়াপোখরির একমাত্র এ টি এম কাউন্টার থেকে আমি টাকা তুলে নিয়ে ওর হাতে দেব।

সুখিয়াপোখরি পৌঁছে ভ্যান থেকে নেমেই ছুট লাগালাম এ টি এম কাউন্টারের উদ্দেশ্যে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে কার্ড পুশ করার পর দেখলাম সার্ভার লাইন ডাউন। অগত্যা ফিরে গিয়ে পিটারকে সেকথা জানালাম। দুজনেই আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার গেলাম এ টি এম কাউন্টারে। কিন্তু হায়, তখনও মেশিন সচল উচ্চহয়নি। আবার বেরিয়ে এসে গেলাম সামনের মোড়ের মাথায়। দেখতে দেখতে বেলা অনেকদূর গড়িয়েছে, প্রচন্ড খিদেও পেয়েছিল। সামনের একটি বড় খাবারের দোকানে ঢুকে দুজনে চানা সামোসা দিয়ে নাস্তা করে আবার গেলাম টাকা তুলতে এবং পুণরায় হতাশ হয়ে দেখলাম, সেই একই অবস্থা। অবশেষে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সার্ভার লাইন পুরোপুরি চালু হলো।

তখনকার মত ৭,০০০ টাকা তুলে নিয়েই ছুটলাম জিপ এবং শেয়ার মারুতি ভ্যান স্ট্যান্ডে। ওখান থেকে গেলাম পশুপতি মার্কেট অর্থাৎ নেপাল বর্ডারে। স্যাক নামিয়ে ওপারে গিয়ে নেপালের স্ট্যান্ড থেকে ফিক্কল যাওয়ার জীপে চড়ে বসলাম, কারণ কোনও শেয়ার গাড়িই সরাসরি পূর্ব নেপালের ইলাম বাজার অবধি যায়না। অনেক বেলা বলে গাড়ির ড্রাইভার আমাদের দুজনকে নিয়েই রওনা দিল ফিকল্ এর পথে। তার আগে নেপাল সীমান্তের রক্ষীরা এসে প্রশ্ন করার পর আমরা ট্রেকার শুনে এবং গাড়ির মাথায় আমার স্যাক দেখে আর কিছু না বলে ছেড়ে দিল। ফিক্কল যেতে খুব বেশি সময় লাগেনা, কিন্তু ফিক্কল থেকে ইলাম বাজার যেতে দীর্ঘ সময় লাগে। আগেই বলেছি যে, আমাদের গাড়িতে ড্রাইভার বাদে আমরা মাত্র দুজন। গাড়ি কিছুদূর যেতেই মাঝ রাস্তায় দুজন ব্যক্তি ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে হাত দেখাতেই তাদের দুজনকে গাড়িতে তুলে নিলো।

তাদের মধ্যে একজন বিদেশী এবং আরেকজন ভারতীয় বা নেপালী ওই বিদেশীর পথপ্রদর্শক কাম দোভাষী গাইড। তারা সামনেই কোথাও নেমে যাবেন। আলাপ পর্ব সমাধা হতেই টুকটাক কথাবার্তা চলতে লাগলো। এরমধ্যে কথা প্রসঙ্গে আমি স্যার এডমন্ড হিলারীর নেপালের শেরপাদের প্রভুত উন্নয়ন, শিশু বিদ্যালয় ইত্যাদির কথা তুলতেই সেই দোভাষী গাইড আমার উপরে রুষ্ট হয়ে রে রে করে উঠলেন, কারণ ওনার বক্তব্য হচ্ছে, স্যার এডমন্ড হিলারী শুধুমাত্র এভারেস্ট বেস ক্যাম্প এবং লুকলা ও খুম্বু অঞ্চলের জন্য কাজ করেছেন, সমগ্র নেপালের জন্য তো উনি কিছু করেননি ? অতএব…


Comments

Popular Posts

Tamohan, Govt. of India Registration Number (PRGI) WBBEN/25/A1160, New Genaration Acclaimed Bengali Literary Research Journal (Language, Literature & Cultural Studies) & Independent Publication. Maynaguri, Jalpaiguri, West Bengal, India. Estd. 2023.