চেয়ার | সুনির্মল বসু | রম্যরচনা ১
চেয়ার
সুনির্মল বসু
পাড়ার ঠেকে সেদিন সন্ধ্যায় আড্ডার আসর বসেছিল। গগন সেন বলছিলেন, “চেয়ারের মাহাত্ম্যের কথা বলিয়া শেষ করা যায় না।"
ঝন্টে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল, “দাদা, খোসা ছাড়িয়ে বলো।"
দীপন বলল, “ইহা শুধুমাত্র দাদার মুখনিঃসৃত কথা নহে, অমৃত বাণী।"
গগন সেন শুরু করলেন, “তোর আমার বাড়িতে চেয়ার অবহেলায় পড়ে থাকে। অতিথি এলে, ব্যবহৃত হয়। অন্য সময় মায়ে তাড়ানো, বাপে খেদানো সন্তানের মতো অবহেলায় পড়ে থাকে।
তাই কিনা?"
গোবিন্দদা বলল, “আমাদের পাড়ার ভ্যাবলাদা সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে কর্মজীবন শুরু করেছিল, কিন্তু চেয়ার পাবার পর রাতারাতি ওর ভোল পাল্টে গেল।
সেদিন মালতীর মা বলছিলেন, “হ্যারে ভ্যাবলা, তুই কি ছিলিস, আর কি হয়েছিস, তোর ওই গালের আঁচিলটা না থাকলে, তোকে তো আমি চিনতেই পারতুম না!"
গগন সেন বললেন, “আমার এক বন্ধু বলছিলেন, ওনাদের সাহিত্য সভায় একজন কবি যশো প্রার্থী
চেয়ার চাইছিলেন।
বন্ধুটি বলে দিয়েছেন, “আপনারে আমি চেয়ার দিমু আনে, কিন্তু মঞ্চে নয়, দর্শকের আসনে।"
সম্বিত মুখার্জি বললেন, “চেয়ারের গুরুত্ব স্থান বিশেষে বদলে বদলে যায়। যেমন,লোকে বলে, “মন্ত্রীর চেয়ার", “ বিচারপতির চেয়ার", “অধ্যাপকের চেয়ার", “হেডমাস্টারের চেয়ার",
"অফিসের বড় বাবুর চেয়ার, “ "লিফট ম্যানের চেয়ার।"ইত্যাদি ইত্যাদি।
শ্যামল বলল, কফি হাউসে রবি ঠাকুরের ছবির সামনে চেয়ারে বসার জন্য কত আকচা আকচি।"
গগন সেন বললেন, “চেয়ার ক্ষমতার উৎস। চেয়ার না থাকিলে, তুমি তিন দিনের পচা পান্তা ভাত।"
বিপ্রদাস সান্যাল বললেন, “এই কারণে লোকে গরুর গায়ে আঠালু পোকার মতো চেয়ার আঁকড়ে বসে থাকে। মিউজিকাল চেয়ারে যেমন কেউ কেউ চেয়ার ছাড়তেই চায় না।"
গুলে সামন্ত বলল, “পরান ত্যাগ করিবো, কিন্তু কদাপি চেয়ার ত্যাগ করিবো না।"
গগন সেন বললেন, “যতক্ষণ চেয়ার, ততক্ষণ তুমি একজন মানুষ। চেয়ার গেলে, পুরোনো কলিগরা অনেকেই চেয়ার হারানো ব্যক্তিকে কৃপার দৃষ্টিতে দ্যাখেন।
ভাবটা এইরকম, তাঁরা চিরদিন চেয়ারে
অধিষ্ঠিত থাকবেন।"
অধিক্রম চৌধুরী প্রশ্ন করলেন, “স্বর্গেও কতবার চেয়ার নিয়ে চড়াচড়ি হয়েছিল।"
পল্টু চৌধুরী প্রশ্ন করল, “দাদা আপনি কোন্ ইন্সিডেন্টের কথা বলছেন?"
অধিক্রম চৌধুরী বললেন, “সুন্দ এবং উপসুন্দ দুই দৈত্য ভ্রাতা দেবরাজ ইন্দ্রের গালে শপাটে চাটি মেরে
স্বর্গের চেয়ার কেড়ে নিয়েছিলেন। তখন স্বর্গের ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বকর্মা তিলোত্তমা মূর্তি তৈরি করে দুই ভাইয়ের মধ্যে ক্যাঁচাল বাঁধিয়ে ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দেন। সুন্দরী তিলোত্তমার জন্য দুই দৈত্য ভাই একে অন্যকে ফিনিশ করে।"
দীপন বলল, “যত আলো, ততো অন্ধকার!"
গোবিন্দদা বলল, “শোলে সিনেমায় সঞ্জীব কুমার আর আমজাদ খাঁনের ফাইট সিনটা আর কি!
গুলে সামন্ত মন্তব্য করল, “ঈশ্বর করলে লীলা, আর আমরা করলে ভিলা।"
বিপ্রদাস সান্যাল বললেন, “ডোন্ট টক লাইক এ ফুলিশ।
গড বলে কথা!"
সম্বিত মুখার্জি বললেন, “সিনেমা দেখতে গেলে, ব্যালকনিতে চেয়ারের দাম বেশি, অথচ, আমি তো কতদিন পঁয়ত্রিশ পয়সার টিকিটে জিতেন্দ্র ববিতার ছবি দেখে এসেছি।"
গুলে সামন্ত প্রশ্ন করল, “ওই ভিড়ের মধ্যে কি করে টিকিট ম্যানেজ করতিস রে?"
সম্বিত মুখার্জি বললেন, “শরীরটাকে হালকা করে এলিয়ে দিয়ে অন্যের মাথার উপর দিয়ে কাউন্টার বক্সের ভেতরে হাত গলিয়ে দেওয়া।"
গোবিন্দদা বললেন, “এতো আলাদা করিশমার ব্যাপার! জেনারেল পাবলিক এটা করতে পারবে না।"
পল্টু চৌধুরী বলল, “চায়ের দোকানে চেয়ার এর অন্য মূল্য আছে। আমাদের পাড়ার অবনীবাবু একটা চা আর দুটো লেড়ো বিস্কুট নিয়ে এখানে বসে গোটা দৈনিক পত্রিকাটা মুখস্থ করে ফেলেন, যেন আগামীকাল তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবেন।"
গুলে সামন্ত বলল, “বলো কি?"
দীপন বলল, “পাত্র পাত্রীর বিজ্ঞাপন থেকে শেয়ার বাজার, জোয়ার ভাঁটার খবর, সোনা রুপোর দাম,
সবকিছু দাদার ফিরিতে পড়া চাই।"
গগন সেন ডান হাতটা উঁচু করে বললেন, “আমি শুনেছি, রাইটার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে বসে এক সময় লিখতেন। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও, তিনি ভাঙ্গা চেয়ার বদলাননি।"
বিপ্রদাস সান্যাল বললেন, “দেশে দেশে চেয়ারের মাহাত্ম্য ভিন্ন রকম।"
সম্বিত মুখার্জী প্রশ্ন করল, “হোয়াট ডু ইউ মিন?"
বিপ্রদাস সান্যাল বললেন, “রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ প্রধানমন্ত্রীত্ব যাবার পর, একটি কারখানার ফোরম্যানের চাকরি নিয়েছিলেন, আমাদের মাদারল্যান্ডে এটা কল্পনা করা যায় না।"
দীপন বলল, “ওই জন্য ভ্যাবলাদার শাশুড়ি সেদিন বলছিলেন, আমাগো জামাই চালাক চতুর আছে।"
রাত বাড়ছিল। সবাই বাড়ি ফিরে গেল। আমিও বাড়ি ফিরে এলাম।
ঘরে ঢুকতেই, গিন্নী প্রশ্ন করলেন, “কোথায় চরিয়ে এলে?"
আমি রেগে গেলাম। প্রশ্ন করলাম, “চরিয়ে আসার কথা কেন বলছো? তুমি কি আমাকে গরু মনে করো?"
গিন্নী মৃদু হেসে বললেন, “আমার বাবার সিলেকশন কখনো মন্দ হতে পারে?
যাও, চেয়ারে গিয়ে বোসো।
খেতে দিচ্ছি।"
আমার রাগ বেড়ে গেল।
আমি বললাম, “চেয়ারে নয়, আমি মেঝেতে বসেই আজ ভাত খাবো।"
Comments
Post a Comment