যমুনোত্রীর পথে | মহুয়া ব্যানার্জী | ভ্রমণ ১
ব্যস্ত জীবনে ব্যতিব্যস্ত সংসার যাপন থেকে মন যখন ছুটি চায়, তখন পিঠে ব্যাগপ্যাক নিয়ে হিমালয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। এইরে! হিমালয়ে যাওয়ার কথা শুনে এটা ভেবে বসবেন না যেন যে আমি বিবাগী হতে চাই।বাস্তবটা অন্য। খুব ছোট থেকেই হিমালয় আমাকে টানে। সে টান এমন যে বিদেশ যাত্রার লোভ উপেক্ষা করেও বারবার ছুটে গিয়েছি হিমালয়ের বিভিন্ন শৈলাশহর, গ্ৰাম, পর্যটন কেন্দ্রে। খুঁজে দেখেছি সেই সব জায়গার আনাচে কানাচে কী রহস্য লুকিয়ে আছে। কখনো কখনো পাহাড় রহস্যময়ী, কখনো সে উচ্ছল ঝর্ণাদের নিয়ে লাস্যময়ী। আবার কখনো দুর্গম ,ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়ে ওঠে সেই পাহাড়। তেমনই এক ভয়ঙ্কর সুন্দরকে দেখা এবং আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়ার টানে যাত্রা করেছিলাম চার ধামের উদ্দেশ্যে। উত্তরাখণ্ডের 'চার ধাম' অর্থাৎ গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ।
নাস্তিকেরা এ পথে যায় অজানাকে জানা ও অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের তাগিদে। আস্তিকেরা যায় ভক্তিরসে জারিত হয়ে সেই পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে নিজের চৈতন্য লাভের আশায়।
আমার মত যারা ধর্মের কুসংস্কার সরিয়ে , গোঁড়ামি বাদ দিয়ে মনের ভেতরে ঈশ্বরকে পূজি, আধ্যাত্ম্য রসে জারিত অথচ একজন পর্যটকের চোখে দেখতে চাই প্রকৃতিকে, তাদের জন্য এই চার ধাম যথেষ্ট অবিস্মরণীয়।
ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে উত্তরাখন্ডের এই প্রকৃতি যতটা আকর্ষণীয় ততটাই ভয়ঙ্কর। সুউচ্চ সবুজ পাহাড়, বরফ ঢাকা পর্বতচূড়া, অনেক নীচে বয়ে যাওয়া উচ্ছল নদী সব নিয়ে গাড়োয়াল হিমালয়ের এই অংশটি বড় মনমুগ্ধকর।
চারধামের প্রতিটি ধাম যাত্রাই এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তবে আমি চারধামের সবচেয়ে কম আলোচিত ধামটিকে নিয়ে ভ্রমণপিপাসু পাঠকদের কাছে আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরব। কেদারনাথ আর বদ্রীনাথ হল এ পথের সবচেয়ে জনপ্রিয় তীর্থক্ষেত্র। পঞ্চ কেদারের প্রথম কেদার হল এই কেদারনাথ ধাম। পাণ্ডুপুত্র সম্রাট যুধিষ্ঠিরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এখানে তাই জনসমাগম বেশি। অলকানন্দা নদীতীরে অবস্থিত বদ্রীনাথ সপ্ত বদ্রীর প্রধান বদ্রী। নারায়ণ এখানে বিরাজমান। হরি ও হরের কারণেই এই দুটি ধাম বহুল জনপ্রিয়। মা গঙ্গা গোমুখ থেকে ভগীরথের তপস্যা বলে এই গঙ্গোত্রীতে অবতরন করেছিলেন। মর্ত্য বাসীর কাছে এ স্থানে তিনি ভাগীরথী নামে পরিচিত। দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা ও ভাগীরথী সঙ্গম রয়েছে। সেই স্থানেই দুই জলধারা একদেহ নিয়ে গঙ্গা নামে হরিদ্বারের পথ ধরেছেন। এসব কারণেই গঙ্গোত্রীও যথেষ্ট পর্যটক প্রিয়। তাছাড়া গঙ্গোত্রী ট্রেকপথ নয়। সহজেই গাড়িতে পৌঁছনো যায়।
কিন্তু যমুনোত্রী ধাম ততটাও আলোচিত নয়। যম ও যমীর কাহিনী বলে চলে এ ধাম। আর বলে সেই শক্তির কথা যা উর্জা, ফোটন অথবা সোলার নামেই বাস্তব জীবনে পরিচিত। সেই শক্তির উৎস সূর্যদেবের কাহিনী বলে চলে এই যমুনোত্রী ধাম। ভারতের সনাতন সেই পৌরাণিক কাহিনী।
আমাদের যাত্রার প্রথম ধাম ছিল এই যমুনোত্রী।
পূরাণ অনুসারে
মৃত্যুর দেবতা যম ও তার বোন যমুনা হলেন সূর্যদেব ও তাঁর স্ত্রী সংজ্ঞার দুই সন্তান। সংজ্ঞা সূর্যদেবের তেজ সহ্য করতে না পেরে বার বার তাঁর দৃষ্টি অবনমন করেন। এতে সূর্যদেব ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে সংজ্ঞা সংযমনকারী পুত্র প্রসব করবেন। তাই যম মৃত্যুর দেবতা। আবার এই শাপের ফলে ভয়ভীত হয়ে সংজ্ঞা চপল ভাবে স্বামীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে আবারও শাপগ্ৰস্ত হন যার ফলে তিনি চপলমতি যমীর জন্ম দেন। সেই কন্যাই যমের বোন যমুনা। যা নদীরূপে প্রবাহিত হয়েছে।
সেই যমুনা নদীর উৎসস্থল হল বান্দরপুঞ্ছ পর্বতের পাশে কালিন্দী পর্বতের পাদদেশের যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে। এই হিমবাহের কয়েক কিলোমিটার নিচে এই যমুনোত্রী ধাম অবস্থিত। এসব তথ্য আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে হাতের মুঠোয় হলেও নিজে গিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা সে এক অন্য অনূভুতি। তাই আর তথ্য না দিয়ে সোজা চলে যাবো ২০১৮ সালের সেই দিনটিতে।
অক্ষয় তৃতীয়ায় চার ধামের দরজা খুলল আর তার কদিন পরেই আমরা বেশ বড় দলবল নিয়ে কলিঙ্গ এক্সপ্রেসে চেপে পাড়ি দিলাম হরিদ্বারের পথে।
হরিদ্বারে পৌঁছে সেদিনটি গঙ্গা আরতি দেখে আর বাজারে রাবড়ি, লস্যি খেয়েই কাটল প্রায়। সন্ধেবেলা আরতির পর গঙ্গায় প্রদীপ ভাসানো হল। তারপর টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতে বাজারে ঢুকেই অবাক হলাম। 'রেনকোট বিশ রুপিয়া' বলে হাঁকডাক শুরু হয়েছে। কৌতূহল বশে আমি ও আমার ননদ এগিয়ে গিয়ে দেখি সাদা পলিথিন কে কেটে জুড়ে একটা আলখাল্লা মত বস্তু বানিয়েছে। মাথায় গলিয়ে নিলেই হল। পিঠের ব্যাগেও অতি সামান্য জায়গা নেবে।
সেটাই চার ধাম যাত্রার রেনকোট বলে বিক্রি করছে। বেশ মজা পেলাম। বুদ্ধিকরে কেমন হালকা অথচ কাজের জিনিষ তৈরী করে ফেলেছে। এই না হলে ভারতীয় ব্রেন। মনে মনে খুব তারিফ করলাম। দামে কম অথচ কাজের। দলের সকলেই কিনলাম একটা করে। এই রেনকোটগুলি চার ধাম যাত্রাপথে ভীষণ কাজে দিয়েছিল।
যাইহোক সেদিন তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। এদিকে পাশের বড় ঘরটিতে আমার মেয়ে ও তার পিসি পিসেমশাইয়ের হা হা হাসির শব্দ কানে আসছে। ভাগ্নাও তাতে সামিল।
বুঝলাম সবকটা না ঘুমিয়ে মজা করছে।আমি সে সব শুনতে শুনতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। পরদিন ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের শব্দে। তারপর স্নান খাওয়া সেরে সেদিনটা সারাদিন হরিদ্বার ভ্রমণ হল। পরদিন একটি বাস রিজার্ভ করে আমাদের বড় দলটি যাত্রা শুরু করলাম। গন্তব্য 'রণচোটি'। কথা ছিল মুসৌরিতে থেমে দুপুরের খাওয়া হবে। তারপর কেম্পটি ফলস দেখে রণচোটি পৌঁছব। ওখানে রাত্রিবাস। পরদিন জানকীচটি পৌঁছে ট্রেকিং শুরু হবে। এইটি হরিদ্বার থেকে যমুনোত্রী যাওয়ার সবচেয়ে সহজ ও কম দুরত্ত্বের রাস্তা। মোটামুটি ২৪০ কিলোমিটার মত।
বাস চলছে পূর্বনির্ধারিত ম্যাপ অনুযায়ী। রাস্তার দুপাশে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য্য সবাইকে মুগ্ধ করে রেখেছে। হৃষিকেশ পেরতেই বাইরের দৃশ্যপট ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল। আমরা সকলেই খুবই উত্তেজিত। বাসের ভেতর হাসি গল্প মজা চলছে। তার সাথেই চলছে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী উপভোগ।তেহরী ড্যামের অসাধারন সুন্দর দৃশ্য পেরিয়ে খানিকটা পথ এগিয়ে বাস থামল। একটি সুন্দর গাছপালা ঘেরা লজে রান্নাকরা খাবারদাবার নামিয়ে দুপুরের খাওয়া সারা হল। তারপর আবার চরৈবেতী। অনেকটা পথ চলা হয়ে গেছে। সবাই মুসৌরির অপেক্ষায় অধীর। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যায়, অথচ মুসৌরিতে পৌঁছয়না আমাদের বাস। হঠাৎ করেই দেখি দৃশ্যপট বদলে গেল। কখনো লিচুবাগান তো কখনো আমবাগানের ভেতর দিয়ে বাস চলছে। আমরা হতবাক। কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করল এই বলে যে - রাস্তা ভুল হয়নি তো? কারণ যেসব জায়গা দিয়ে বাস চলছে তা মোটেও স্বাভাবিক গাড়ি চলাচলের রাস্তা নয়। দেখে মনে হচ্ছে বসতবাড়ি, জমির পথ মাড়িয়ে চলেছি।সকলের মধ্যেই গুঞ্জন শুরু হল। কিন্তু বৃদ্ধ বাসচালক নির্বিকার। সে কারও কথায় কর্ণপাত না করে একমনে শামুকের গতিতে বাস চালাচ্ছে। পেছনের যত গাড়ি সবাইকে পাশ দিয়ে নিজে সবার পেছনে চলছে।দলের বেশিরভাগ লোকই এবার বিরক্ত হচ্ছে বাসচালকের ওপর।
পথমধ্যে একবার বাস থামল। ম্যানেজার কুণ্ডু দা চা খাওয়ালেন। তখন আমার পতিদেব ও আরও কয়েকজন মিলে বাসের বৃদ্ধ ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেল। এই রাস্তায় গাড়িচালকেরাই ভরসা। যদিও আমাদের বাসের চালকের বয়স দেখে নিজেদের বেশ ভয়ই লাগছিল। কিন্তু তিনি সারা রাস্তা অতি ধীর গতিতে বাস চালিয়ে গেলেন।সবাই বিরক্ত হলেও আমি তাঁর ওপর ভরসা না করে পারলাম না। এই সরু পাহাড়ি রাস্তায় হয়ত তিনিই ঠিক।
চা খাওয়া শেষে পার্থ এসে বলল যে ড্রাইভার মুসৌরির রাস্তা না ধরে সবচেয়ে দীর্ঘ পথটি ধরে চলেছেন। আমাদের আশংকাই তবে ঠিক! রাস্তা ভুল হল!
এতক্ষণের আনন্দ মুহূর্তে উৎকন্ঠায় বদলে গেল। প্রকৃতি যতই সুন্দর হোক না কেন সে তো অচেনা। তাছাড়া এ পথে আর বিশেষ কোন যানবাহন চলাচল করতে দেখতে পেলাম না। কেবল স্থানীয় খুব ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি জনপদগুলির লোক চলাচল দেখা যাচ্ছে। তাও খুব কম। বিকেল হতেই পথ অতি নির্জন হয়ে গেল। যে সময়ে আমাদের রণচোটি পৌঁছে বিশ্রাম করার কথা সে সময় আমরা বাসের ভেতর শ্রান্ত, উৎকন্ঠিত হয়ে বসে বসে ইষ্টনাম জপছি। সবথেকে ভয়ের ব্যাপার হল যদি কোনভাবে কেউ অসুস্থ হয় অথবা গাড়ির টায়ার পাংচার হয় তবে কি হবে? কারণ পথের দুপাশে কেবল ঘন জঙ্গলে ভরা পর্বত। কেউ কোথাও নেই। এভাবেই সন্ধ্যে নামল। গন্তব্যের কোন দিশা নেই তখনও। হঠাৎ দেখি দুরে পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝেই আগুন জ্বলছে।বাস এগিয়ে যেতে বুঝলাম সেগুলো দাবানল। আমাদের বাস চলছে , কখনো তার বাঁদিকে কখনো ডানদিকের পাহাড় দাউদাউ জ্বলছে। ভয়ংকর কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর সে দৃশ্য।সন্ধ্যার অন্ধকার ভেদ করে যেন প্রকৃতির মশাল আমাদের পথ দেখাচ্ছে। নিমেষের মধ্যে মনে এক অদ্ভুত উদ্দীপনা জাগল।সবাই জানলার ভেতর দিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমি অবাক বিস্ময়ে সেই পরমা প্রকৃতির কাছে মনেমনে নতজানু হয়ে প্রণাম জানালাম। এইভাবে চলতে চলতে বারকোট পৌছলাম। বারকোট বড় জনপদ। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় সেখানে সবই বন্ধ।
বারকোট পেরিয়ে সানাচোটি পৌঁছতেই রাত বারোটা বাজল। এসব জায়গায় পাহাড়ে, সন্ধে হলেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তাই পথের জনপদগুলি টিমটিমে আলো দিয়েই আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল।
ততক্ষণে সবাই কাহিল। এত দীর্ঘ বাসজার্নিতে সকলেই একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খিদেও পেয়েছে বেশ। পথভুলের জন্য রাস্তায় যেভাবে খাওয়াদাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল তা সম্ভব হয়নি। এদিকে বাসচালক জেদ ধরেছে যে সে আজ আর রণচোটি যাবে না।কুণ্ডু দা, পার্থ, সৌমেন, দেবু, কল্যাণ সবাইমিলে বাসচালকে বুঝিয়ে রাজি করাতে ব্যস্ত আর আমরা মেয়েরা ও ছোটরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এদিক ওদিক শৌচালয়ের খোঁজে ছুটছি। অবশেষে একটি শৌচালয় পাওয়া গেল যা ওই মুহূর্তের জন্য আমাদের কাছে পাঁচতারা হোটেলের বাথরুমের থেকেও ভালো বলে মনে হল।
এরই মাঝে আমার নন্দাই মনোজিৎ দেখি আমায় ডাকছে।কাছে যেতে জানলাম একটি ছোট্ট ধাবা ভাগ্যক্রমে খোলা পেয়েছে সে। দোকানীকে আমাদের অবস্থা খুলে বলতেই সে রুটি আর সবজি তৈরি করে দিল। আমরা সেখানে রাতের খাওয়া সারলাম।মনোজিৎ দলের বাকিদেরও ডেকে আনল। সকলেই খেয়ে দেয়ে বাস ছাড়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কারণ রণচোটি না গেলে আমাদের এই পথের ধারে অথবা বাসের ভেতরে রাত্রিবাস করতে হবে। এইভাবে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় হল। তারপর ঈশ্বরের কৃপায় বাস ছাড়ল। আমরা প্রায় রাত দুটোর সময় রণচোটি পৌঁছলাম। কোনমতে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙল ননদ ইন্দ্রানীর ডাকে। ঘড়িতে তখন ভোর তিনটে। শরীর চাইছে না উঠতে কিন্তু মন তাকে ঠেলে ওঠাল। নিজের সঙ্গে আনা ইলেকট্রিক কেটলিতে জলগরম করে কোনমতে আমরা ছজন স্নান সারলাম ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। ততক্ষণে দলের বাকি সদস্যরাও গরম জামা কাপড়ে নিজেদের প্রস্তুত করে ফেলেছে। প্রাতরাশ ছিল সুজি, রুটি।এসব জায়গায় এইরকমই খাবার পাওয়া যায়। চাইলেও পছন্দসই কিছু পাওয়া যাবে না। তাই পর্যটকরা শুকনো খাবার সঙ্গে রাখেন। আমরা ম্যাগি করে খেয়েছিলাম আগেই। তাই বাসে গিয়ে বসলাম। একে একে সকলে বাসে বসতেই বাস আবার শম্বুক গতিতে চলতে শুরু করল। পথের দুপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে হনুমান চটি ছাড়িয়ে বাস থামল জানকীচটিতে। তখন সকাল দশটা প্রায়। এখান থেকেই শুরু হবে আসল পথ। ছয় কিলোমিটারের কিছু বেশি খাড়া পথ ধরে আমাদের হাঁটতে হবে।
তবেই যমুনোত্রী ধামে পৌঁছতে পারব।
সকলের মনে খুব উৎসাহ। স্থানীয় অস্থায়ী দোকানে টুপি, লাঠি, ইত্যাদি বিক্রি ও ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা কুড়ি টাকা করে এক একটি লাঠি কিনে নিলাম। পিঠের ব্যাগে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র,টর্চ, মোবাইল, পাওয়ার ব্যাঙ্ক, ছাতা, রেনকোট, লজেন্স, ও আর এস এবং পাণীয় জলের বোতল রয়েছে। যমুনা মাতার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ট্রেকিং শুরু হল।
প্রথমে বেশ আনন্দের সাথে চারপাশের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে আর নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে হাঁটছিলাম। সরু খাড়া রাস্তা। একপাশে পাহাড় দেওয়ালের মত রয়েছে। অপর দিকে অতলান্ত খাদ। উচ্ছল যমুনা সেখান দিয়ে বয়ে চলেছে।চোখ চলে গেল সেদিকে। মনে হল একবার যদি পড়ে যাই তাহলে হাড়গোড় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। মনোনিবেশ করলাম অন্যান্য যাত্রীদের প্রতি। অনেক মানুষ চলেছেন মন্দিরের উদ্দেশ্যে। উল্টোদিক থেকে দর্শন সেরে পূণ্যার্থীরা নামছে। তাদের ক্লান্ত মুখে এক তৃপ্তির হাসি। দেখে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু এই চড়াই ভেঙে বুকে দম বেশিক্ষণ থাকছে না। তাই অল্প করে হাঁটি আর একটু করে বিশ্রাম নিচ্ছি। রাস্তার কিছু পরপরই ছোট ছোট ধাবা রয়েছে, টিনের অথবা ত্রিপলের আচ্ছাদন দেওয়া বসার বেঞ্চ রয়েছে। আমরা সেইখানে বসে চা, জল খেয়ে আবার ট্রেক করছি। এইভাবে কিছুদুর যাওয়ার পর দেখি আমার স্বামী , ননদ, নন্দাই ভাগ্না সহ দলের লোকেরা কেউই আমাদের সঙ্গে নেই। আমরা মা মেয়ে , কুণ্ডু দা ও কয়েকজন সদস্য একসাথে হাঁটছি। একটু ঘাবড়ে গেলাম প্রথমে। তারপর ভাবলাম ঈশ্বরের ভরসায় তো এই এত লোক চলেছে। বুড়ো বুড়ি, রোগা, বিপুলকায়া, ধনী দরিদ্র সকলেই তো রয়েছে। তাহলে ভয় কিসের!সেই ক্ষণে উপলব্ধি করলাম ঈশ্বরের দরবারে আমরা সবাই এক। সকলেই এক বৃহৎ মানব পরিবারের সদস্য। মনের সব দ্বিধা কেটে গেল।মেয়েকে সঙ্গী করে মনের জোর নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দম ফুরিয়ে আসছে দুজনেরই। তখন থামছি। আবার হাঁটছি।
এই রাস্তায় খাদের দিকটি মাঝে মাঝে রেলিং বসানো রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ অংশই রেলিং বিহীন বিপজ্জনক।
আমরা প্রথমে রেলিংয়ের দিক ধরে হাঁটছিলাম। কিন্তু ঘোড়া, ডান্ডি ও কান্ডির সওয়ারী ও বাহকদের চলাচলে ধাক্কা খেতে খেতে নাজেহাল অবস্থা। তাই শেষমেশ পাহাড়ের দিক ঘেঁসে হাঁটা শুরু করলাম। এর মধ্যেই ঘোড়ার নাদি ও গায়ের গন্ধে মেয়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। কুণ্ডু দার কাছ থেকে ইনহেলার নিয়ে সে যাত্রা সুস্থ হল মেয়ে। তারপর কুণ্ডু দা সহ বাকিরাও পেছনে পড়ে রইল। আমরা মা মেয়ে চললাম লাঠি হাতে।মাঝপথে খবর পেলাম আমার ননদ ও আমার বর পার্থ হাঁটতে না পেরে ঘোড়ায় সওয়ারি হয়েছে বাকি পথটুকুর জন্য।
কিন্তু মেয়ে বলল যে সে ট্রেক করেই যাবে। তার উৎসাহেই মূলত আমি মনে জোর পেলাম। নন্দাই ও ভাগ্নাকে পথে দেখতে পেলাম না। কোন খবরও পেলাম না ওদের। হয়ত ওরাও ঘোড়া নিয়েছে। কে জানে।
এর মধ্যেই একবার ঘোড়ার পায়ের ধাক্বায় আমার মেয়ে খাদের দিকে ছিটকে গেল।সেই মুহূর্তে আমি ওর এক হাত ধরে টানি আর ও অন্য হাতে রেলিং ধরে রক্ষা পায়। ঈশ্বরের কৃপা একেই বলে তা সেদিন প্রমাণ পেলাম।
ঘটনাটি ঘটতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেও সেই সময় আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
বহুক্ষণ হেঁটে অনেক সিঁড়ি পেরিয়ে অনেক চড়াই অতিক্রম করেও গন্তব্য আর ধরা দেয় না। উল্টোদিক থেকে আসা যাত্রীদের যখনই জিজ্ঞাসা করি― ওউর কিতনা দুর?
উত্তর আসে― ছে কিলোমিটার। ধুর! ছয় কিলোমিটার কি শেষ হবে না? এসব ভাবতে ভাবতেই দুরে একটা মন্দিরের চূড়া দেখা গেল। সঙ্গের এক যাত্রী বললেন― ও হ্যায় ভৈরব থান। উসকে বাদ ওর থোড়া রাস্তা হ্যায়।
শুনে আমাদের একটু শান্তি হল। কিন্তু ওমা! ভৈরব থান থেকে দেখি আরও চড়াই। এইভাবে প্রায় ধুঁকতে ধুঁকতে মা মেয়ে যখন মন্দিরের নিচে এলাম, দেখি আমাদের জন্য উদ্বিগ্ন ভাবে আমার পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছে।ওখানে বড় বড় ছাউনি করে খাবারের দোকান রয়েছে। পার্থ সহ সবাই খেয়েদেয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।ওদের ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে
আমরা মন্দিরের পথে আবার উঠতে শুরু করলাম।
অবশেষে যমুনোত্রী ধামে পা রাখলাম আমরা।
হলুদ রঙের মন্দিরের গর্ভগৃহে কালো পাথরের মা যমুনার মূর্তি। পাশে সাদা মার্বেলের আরেকটি দেবীমূর্তি। পুরোহিত বললেন ওটি মা গঙ্গার মূর্তি।পাশেই সূর্য কুণ্ডের ফুটন্ত জলে চালের পুঁটলি ডুবিয়ে প্রসাদ করার জন্য ভীড় রয়েছে। আমি চাল বাঁধা পুঁটলিটি নিয়ে কুণ্ডের কাছে পৌঁছতেই পারছিলাম না। একটি অল্পবয়সী পুরোহিত আমার কাছ থেকে সেটি নিয়ে কুণ্ডের জলে সিদ্ধ করে আমায় দিলেন। কোন টাকা পয়সা দাবি করলেন না কিন্তু। খুব ভালো লাগলো এই ব্যাপারটা। তারপর প্রথা অনুযায়ী ওই চালে পূজো দিয়ে খানিকটা প্রসাদ হিসেবে ব্যাগে রেখে দিলাম। সামনেই যমুনা নদীর বাঁধানো ঘাটে যমুনার জলে অনেকে স্নান করছেন দেখলাম। তর্পণ শ্রাদ্ধাদিও হচ্ছে। আমরা দুজনে যমুনার জল নিয়ে মাথায় ছিটিয়ে প্রণাম করলাম। পুরো মন্দিরটি ঘুরে দেখলাম। গ্ৰানাইট পাথরের মন্দিরটি ১৮৩৯ সনে তেহরি গাড়য়ালের মহারাজা সুন্দর শাহ বা প্রতাপ শাহ দ্বারা নির্মিত হয়। মন্দিরটি দুইবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।বর্তমানের মন্দিরটি জয়পুরের মহারাণী গুলরিয়া দেবী দ্বারা পূনর্নিমিত। এই মন্দিরের পূজারীগন বংশপরম্পরায় খারসানির অধিবাসী। বেলা পড়ে আসছে। ফেরার তাড়া রয়েছে, তাছাড়া খিদেও পেয়েছে খুব। তাই আমরা দেরি না করে মন্দিরের নিচে নেমে এলাম।পরিপূর্ণ তৃপ্ত মনে পরিবারের সকলের সাথে ধীরে ধীরে একই পথে উল্টো অভিমুখে নামতে শুরু করলাম। ওঠা যত কঠিন ছিল নামা ততটাই সহজ লাগল।
জানকীচটিতে আমাদের বাস অপেক্ষা করছিল। আমরা যমুনোত্রী থেকে নেমে এলাম যখন তখন সন্ধ্যে হয়েছে। এক এক করে দলের সবাই নেমে এল। প্রথম ধামের ট্রেকিং সফল হওয়ায় সবাই খুব খুশি। শরীরের কষ্ট তখন উধাও হয়ে গেছে। বাস চলল উত্তরকাশী অভিমুখে। আমরা নিজেদের মনকে পরবর্তী কেদারনাথ ট্রেকিংয়ের জন্য প্রস্তুত করতে লাগলাম। সে গল্প পরের বার শোনানো যাবে নাহয়।
প্রয়োজনীয় তথ্য:-
১. ট্রেকের অভিজ্ঞতা না থাকলে এ পথে আসার আগে প্রতিদিন হাঁটা শুরু করতে হবে।
২. সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধ, জল, শুকনো খাবার রাখতে হবে। এবং তা নিজের পিঠের ব্যাগে বহন করলে ভালো।
৩. এই পথটি বেশ সরু। একটাই পথে ঘোড়া, ডাণ্ডি, কাণ্ডটি ও পদযাত্রী চলার ফলে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রেও সাবধানে সতর্ক ভাবে হাঁটতে হবে।
৪. ঘোড়ার মলে রাস্তা পরিপূর্ণ থাকায় শ্বাসকষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সঙ্গে ইনহেলার থাকা ভালো।
৫. রেইনকোট, পাহাড়ে হাঁটার উপযুক্ত জুতো থাকা দরকার।
সবশেষে বলি, যেখানে বেড়াতে যাবেন সে জায়গা পরিস্কার রাখার দায়িত্বও কিন্তু আপনার। এটা মাথায় রাখবেন।এই পথ ফূর্তি করার নয়। এপথে নেশার দ্রব্য ব্যবহার করলে নিজের মৃত্যুর দায় নরকে বা স্বর্গে বসে নিজেই নেবেন। নেশার ব্যাপারে সাধু সন্ন্যাসীদের তুলনা দেবেন না। আপনি ভোগী মানুষ,ওই পর্যায়ে পৌঁছলে তবেই ওদের মত আচরণ শোভা পায়। তাই তাদের যোগসাধনা দিকে তাকান, নেশার বস্তুর দিকে নয়।
Comments
Post a Comment