ভালোবাসা আসলে অনুভূতি | মনোমিতা চক্রবর্তী | গল্প ৩
বছর পঁচিশের শ্রেয়ার আগামীকাল চাকরিতে জয়েনিং। মায়ের সঙ্গে নতুন শহরে থেকেই চাকরিটা করবে সে। শান্ত স্বভাবের শ্রেয়াকে নিয়ে মা, জয়াদেবীর চিন্তার শেষ নেই। এই যুগের, বিশেষত এই বয়সের মেয়েরা খুবই উচ্ছল, প্রাণবন্ত হয়। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে হইচই করে সময় কাটাতে এরা ভালোবাসে।অথচ ,শ্রেয়া একদম বিপরীত! মেলামেশা করা তো দূর, কারোর সঙ্গে ঠিকমতো কথাটা পর্যন্ত সে বলতে পারে না। বন্ধুবান্ধব বলতে কেউই তেমন নেই। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা ঘরকুনো। আজ অফিসে বেরোনোর আগে জয়াদেবী, শ্রেয়াকে পইপই করে বলে দিলেন অফিসের কলিগদের সাথে কথা বলতে, বন্ধুত্ব করতে।
অফিসে গিয়ে শ্রেয়াতো পুরো অবাক! শ্রেয়ার ছোটবেলার ক্রাশ আবির বোস তার বস! শ্রেয়া কি স্বপ্ন দেখছে?
নিজেই নিজের গায়ে চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো শ্রেয়া, সে স্বপ্ন দেখছেনা। আবির সত্যিই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তবে, আবির কিন্তু শ্রেয়াকে চিনতে পারেনি।
শ্রেয়া আবিরের থেকে কাজ বুঝে নিয়ে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব সেরে নিল।এরপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। কিন্তু কিছুতেই সে কাজে মন বসাতে পারছেনা। থেকে থেকে চোখটা শুধু আবিরের দিকেই যাচ্ছিল তার। কিছুক্ষণ বাদে আবির অফিস থেকে বেরোনোর আগে শ্রেয়ার কাছে গিয়ে বলে সে আজ বেরোচ্ছে।বাকি কাজ নিয়ে কাল আলোচনা করবে। শ্রেয়া শুধু হালকা করে ঘাড় নাড়লো। শ্রেয়া বেশ জড়োসড়ো হয়ে আছে দেখে আবির শ্রেয়াকে স্বাভাবিক করার জন্য হাতটা শ্রেয়ার দিকে বাড়াতেই পরম আনন্দের সাথে শ্রেয়াও হাত বাড়ালো। আবির বাই বলে বেরিয়ে গেল। শ্রেয়ার হাতে আবির স্পর্শ! এই অভাবনীয় ঘটনায় শ্রেয়া আজ ভীষণ খুশি। অফিস ফেরত শ্রেয়ার হাসিমুখ দেখে জয়াদেবী বললেন―" কি ব্যাপার? গোমরা মুখ আজ হাসি খুশি যে? অফিসে কি পছন্দের মানুষ পেলি নাকি?
শ্রেয়া― "মা, কীযে বলোনা? খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।"
জয়াদেবী― "খিদে! আর তোর!"
শ্রেয়া― "আমি মানুষ তো? খিদে পাওয়াটাই স্বাভাবিক বলো।"
ক'দিন ধরেই জয়াদেবী দেখছেন শ্রেয়ার মধ্যে বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। যে মেয়ে কোনদিনও সাজগোজ করতে ভালোবাসতোনা, সে সাজগোজ করে অফিসে যাচ্ছে। গান শুনছে!মাঝে মাঝে আবার গুনগুনও করছে।শ্রেয়ার এই পরিবর্তনে জয়াদেবী ভীষণ খুশি। আবিরকে এক ঝলক দেখার জন্য শ্রেয়া অস্থির হয়ে থাকে। কারণে অকারনে সে আবিরের চেম্বারে যায় শুধুমাত্র আবিরকে দেখার জন্য। আবিরের ব্যবহার করা পেন, রুমাল সে চুরি করে এনে ঘরে যত্ন করে রেখেছে। যখন ঘরে একা থাকে আবিরের ব্যবহার করা পেন, রুমাল ছুঁয়ে শ্রেয়া আবিরের উপস্থিতি অনুভব করে।
আজ রুমালটা বালিশের উপর রেখে শ্রেয়া শুয়ে শুয়ে ভাবে― কত বছর? পনেরো বছর তো হবেই। পনেরো বছর আগে মামার বাড়িতে গিয়ে, মামাদের পাশের বাড়ির তিন্নি দিদির মাসতুতো ভাই আবিরের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় শ্রেয়ার। সেই শুরু। তখন থেকে ভালো লাগতো আবিরকে। বড় হবার পর আর দেখা হয়নি। ফেসবুকে খুঁজে খুঁজে আবিরকে বের করেছিল শ্রেয়া বছর পাঁচেক আগে। কিন্তু আবিরকে সে ভয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়নি। যদি আবির শ্রেয়ার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট না করে!শ্রেয়াকে যদি ব্লক করে দেয়! তাহলে তো সে আর আবিরের ছবিটুকুও দেখতে পাবেনা।
আবিরকে দেখার ইচ্ছে হলেই আবিরের প্রোফাইল সার্চ করে তাকে দেখে নিত শ্রেয়া। তাই তো এত বছর পরও আবিরকে চিনতে শ্রেয়ার এতোটুকুও অসুবিধে হয়নি। শ্রেয়া চাইলেই ছোটবেলার পরিচয়টা দিতে পারে আবিরকে। কিন্তু ভয় হয়, কারণ তিন্নি দিদির কাকাতো বোন নীরার সঙ্গে আবিরের খুব ভাব ছিল ছোটবেলায়। শ্রেয়া নীরার সঙ্গে আবিরের ভাব কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। শ্রেয়ার মনে হতো নীরা আবিরকে শ্রেয়ার থেকে কেড়ে নেবে। তাই শ্রেয়া নীরাকে একবার পুকুরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল আবিরের সামনেই।যদিও নীরা বেঁচে গিয়েছিল। তবুও সেই থেকে আবির শ্রেয়াকে পছন্দ করত না। শ্রেয়া খেলতে গেলে আবির আর নীরা দূরে সরে যেত। যত দিন যাচ্ছে আবিরের প্রতি আকর্ষণের পাগলামোটা বড্ড বেড়ে যাচ্ছে শ্রেয়ার। কি করলে সে আবিরকে পাবে? শ্রেয়া নানা রকম চিন্তা করে আবিরকে পাবার। শ্রেয়া বুঝতে পারে আবিরকে না পেলে তার জীবন বৃথা। যেমন করেই হোক আবিরকে তার পেতেই হবে। কিন্তু আবিরকে মনের কথাটা বলবেই বা কী করে সে?
নভেম্বরের শেষদিকের সকাল। ঘুম থেকে উঠে শ্রেয়া দেখলো প্রকৃতি আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মগ্ন। কুয়াশার অবগুন্ঠন ছিড়ে নিস্তব্ধতার বুক চিরে সূর্য উকি দিচ্ছে।শীতের ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। যে বাড়িতে শ্রেয়ারা থাকে সেই বাড়ির লনের ঘাসের ডগায় শিশির যেন প্রকৃতির বুকে মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য বেরিয়ে আসতেই শ্রেয়া তৈরি হয় অফিসে যাবার জন্য। আবির আজ অফিসে সবাইকেই একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছিল। শ্রেয়া বেরিয়েও ছিল সময়ের অনেকটা আগেই। কিন্তু বাদ সাধলো রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম। ট্রাফিকে আটকে শ্রেয়ার অনেকটা সময় নষ্ট হয়েগেল।অফিসে পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়েগেল তার।
অফিসে পৌঁছে শ্রেয়া দেখে সবাই আবিরকে নিয়ে বেশ হৈ হুল্লোড় করছে। হলোটা কি? কিছুই বুঝতে পারছিলনা শ্রেয়া। শ্রেয়াকে দেখেই আবির বলল― "শ্রেয়া তুমি এসে পড়েছ? এত দেরি হল কেন?"
শ্রেয়া― "ট্রাফিকে আটকে গিয়েছিলাম স্যার।"
আবির― "আচ্ছা , তুমি যখন এসে গেছ শোনো, সবাইকে বললাম তোমাকেও বলছি আগামী দশই ডিসেম্বর আমার বিয়ে। তাই সবার সাথে তোমারও নিমন্ত্রণ রইল, আসবে কিন্তু। আর হ্যাঁ কাল থেকে আমি ছুটি নিচ্ছি। তোমরা সবাই মিলে কাজগুলো ঠিকমতো করে নিও কেমন।"
আবিরের বিয়ে! শ্রেয়ার পায়ের তলার মাটি যেন এক মুহূর্তে সরে গেল। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠলো। কোনও মতে নিজেকে সামলে ওয়াশরুমে গিয়ে, চোখের জল মুছে ,ফ্রেশ হয়ে নিজের চেম্বারে এলো। আজ কোন কাজেই মন দিতে পারছে না শ্রেয়া। কার্ডটা একবার খুলে দেখবে কি দেখবে না এই ভাবতে ভাবতে কার্ডটা খুলেই ফেলল সে। বিয়ের কার্ডে আবিরের ছবির সঙ্গে তার হবু স্ত্রীর ছবি। নামটা এবার খেয়াল করল শ্রেয়া। পাত্রীর নাম নীরা! কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা শ্রেয়া এই বিয়েটা। কারণ আবির যে শুধু তার! আর কারোর আবির হতেই পারে না। মনে মনে শ্রেয়া বলে― "যেমন করেই হোক এই বিয়ে আমি হতে দেবইনা, কিছুতেই না।তুমি যে শুধু আমার আবিরদা। শুধুই আমার।"
সারাটা দিন কোন কাজই করতে পারল না শ্রেয়া। শরীরটা খারাপ লাগছে তার। সন্ধ্যের দিকে ছুটির আগেই বেরিয়ে পড়ল সে। বুকে আবারো তার প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠেছে। পনেরো বছর আগে নীরাকে যেমন আবিরের থেকে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল, আজ সেই ইচ্ছেটাই আবারো জেগে উঠলো শ্রেয়ার। অফিস থেকে শ্রেয়ার বাড়িটা বেশ দূরে। তবুও সে আজ ট্যাক্সি না নিয়ে হেঁটে চলেছে বাড়ির দিকে, নানা রকম চিন্তা করতে করতে।
মনে মনে শ্রেয়া ভাবে― "কিভাবে আমার পথের কাঁটা আবিরের হবু স্ত্রী নীরাকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেওয়া যায়, কি ভাবে? নীরার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এই সাত দিনের মধ্যে বিষ দিয়ে মেরে ফেলবো নাকি নীরাকে? নাকি টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করাব? কিছুতো একটা করতেই হবে। নানা আবিরকে আমি কারো হতে দেবো না কিছুতেই না।আবির আমার ভালোবাসা,আমার জীবন।আবির শুধু আমারই।"
এমন সময় হঠাৎ একটা গাড়ি এমন বেপরোয়া ভাবে এলো যে গভীর ষড়যন্ত্রের চিন্তায় মগ্ন শ্রেয়া খেয়ালই করল না। গাড়ির ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো শ্রেয়া। চোখ দুটো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছিল তার। ঝাপসা চোখে শ্রেয়া দেখল আবির তাকে বলছে― "ছি শ্রেয়া ছি! তুমি এত্ত স্বার্থপর! তুমি নীরার ক্ষতি করার কথা ভাবছিলে?"
শ্রেয়া― "সবটা তোমার জন্য আবিরদা, আমি যে তোমায় ভালোবাসি।"
আবির―"না তুমি আমাকে তো নয়ই, তুমি কাউকেই ভালোবাসতে পারো না। তোমার মত স্বার্থপর মেয়ে কাউকে ভালবাসতেই পারে না। তুমি জানো না অন্যের ক্ষতি করতে চাইলে নিজেরই ক্ষতি হয়।দেখো তোমার পরিণতির জন্য শুধু তুমিই দায়ী।"
আশেপাশের সমস্ত লোক ঘিরে রয়েছে শ্রেয়াকে।তারা দেখছে চির নিদ্রার পথযাত্রী শ্রেয়া বিরবির করে বলছে― "হ্যাঁ আমি জানি, আমি স্বার্থপর।আমি তবু তোমায় ভালোবাসি। আমি জানি ভালোবাসা আসলে অনুভূতি। এর সঙ্গে প্রিয়জনকে পাওয়া না পাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। আবিরদা আমি তোমায় ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।"
Comments
Post a Comment